দেরি নিয়ে প্রশ্ন
ধর্ষণে অভিযুক্ত বাঁকুড়ার সেই হাউসস্টাফ গ্রেফতার, বরখাস্ত
বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মূক-বধির তরুণীকে ধর্ষণে অভিযুক্ত হাউসস্টাফকে বরখাস্ত করল রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বৃহস্পতিবার এই খবর জানিয়েছেন। অভিযুক্তকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। বুধবার রাত তিনটে নাগাদ বাঁকুড়া শহরের গোবিন্দনগরের এক লজে রামকৃষ্ণ সরকার নামে ওই হাউসস্টাফকে ধরা হয়। বৃহস্পতিবার বাঁকুড়ার সিজেএম চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য ধৃতকে ১৪ দিন জেল-হাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
এ দিকে এ দিনই কাঁথির মূক ও বধির স্কুলের এক শিক্ষকের সাহায্যে বাঁকুড়া জেলা আদালতের অতিরিক্ত দায়রা বিচারক (৫) সংযুক্তা সেনগুপ্তের কাছে ওই তরুণী গোপন জবানবন্দি দেন। পাশাপাশি এ দিন সন্ধ্যায় রামকৃষ্ণকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য বিষ্ণুপুর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। পরীক্ষার জন্য হাসপাতালের সুপার রবীন্দ্রনাথ প্রধান, স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞ প্রদ্যুৎ পান ও প্যাথলজিস্ট তড়িৎকান্তি পালকে নিয়ে তিন সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গড়া হয়েছে। পুলিশ-সূত্রের খবর, ‘নিরপেক্ষ’ জায়গায় পরীক্ষা করাতেই ধৃতকে বিষ্ণুপুরে নিয়ে যাওয়া হল। প্রসঙ্গত, বুধবার তরুণীটিরও ডাক্তারি পরীক্ষা হয় এসএসকেএমে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, অভিযুক্তকে গ্রেফতারে এত দেরি হল কেন? অভিযোগ জমা পড়ার পরে কেন গড়িয়ে গেল ছত্রিশ ঘণ্টা?
ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরাও জানিয়েছেন, এত দেরিতে অভিযুক্তের মেডিক্যাল পরীক্ষা হলে প্রকৃত সত্য সামনে আসার সম্ভাবনা যথেষ্ট কমে যায়। বাঁকুড়া মেডিক্যালের সুপারের কাছে ধর্ষণ সংক্রান্ত অভিযোগপত্রটি মঙ্গলবার সকালে জমা পড়লেও বিকেল পর্যন্ত তিনি তা পুলিশকে দেননি। মেয়েটির বাবা সে দিন সন্ধ্যায় বাঁকুড়া থানায় গিয়ে লিখিত অভিযোগ দাখিল করার পরে পুলিশ কিছুটা নড়েচড়ে বসলেও অভিযুক্তকে গ্রেফতার ও শনাক্তকরণে ঢিলেমি চলছিল বলে অভিযোগ। বিভিন্ন মহলের অভিমত, সংবাদমাধ্যমের লাগাতার চাপের মুখেই রামকৃষ্ণকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
অভিযুক্ত হাউসস্টাফ। ছবি: শুভ্র মিত্র
বস্তুত বাঁকুড়া মেডিক্যালের ঘটনাটিকে ঘিরে গোড়া থেকেই নানা সংশয়-বিতর্ক-প্রশ্ন দানা বেঁধেছে। কী রকম?
প্রথমত, সুপ্রিম কোর্ট ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের চিহ্ন পাওয়ায় ততটা জোর না-দিলেও পুলিশ-প্রশাসনের একাংশ এখনও তদন্ত শুরুর ক্ষেত্রে প্রাথমিক মেডিক্যাল রিপোর্টকেই গুরুত্ব দিয়ে চলেছে। এমনকী, ধর্ষণ হয়েছে না হয়নি, সে সম্পর্কে মেডিক্যাল রিপোর্টের ভিত্তিতেই মতামত জানিয়ে দিচ্ছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! অথচ সেই পরীক্ষা দ্রুত ও যথাযথ ভাবে সম্পন্ন করায় পুলিশ-প্রশাসন কতটা তৎপর, তা নিয়েও সংশয় থেকে যাচ্ছে।
যেমন থেকে গিয়েছে এসএসকেএমে মূক-বধির তরুণীটিকে পরীক্ষার সময়ে। সেখানে ফরেন্সিক, স্ত্রী-রোগ ও মনোরোগ বিভাগের ডাক্তারেরা হাজির ছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, মূক ও বধির তরুণীর বক্তব্য তাঁরা বুঝবেন কী করে? মেয়েটিই বা কী ভাবে ওঁদের জানাবেন তাঁর উপরে হওয়া শারীরিক নির্যাতনের কথা? ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ অজয় গুপ্তের মতে, “শুধু বিচারপতিকে জবানবন্দি দেওয়ার সময়ে থাকলেই হবে না। এ রকম ক্ষেত্রে ইশারায় মনোভাব বুঝতে পারেন, এমন বিশেষজ্ঞেরও মেডিক্যাল পরীক্ষার সময়ে হাজির থাকা জরুরি। না-হলে পরীক্ষা কার্যত অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।” সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের পাশাপাশি তদন্তকারী অফিসারেরও এ বিষয়ে উদ্যোগী হওয়া দরকার ছিল বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
প্রশ্ন উঠেছে অভিযুক্ত পুরুষের ডাক্তারি পরীক্ষায় বিলম্ব নিয়েও। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দাবি: পরিবারের তরফে অভিযোগ পাওয়ার পরে মঙ্গলবার সকালেই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে চিহ্নিত করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আরও উদ্যোগী হতে হতো। অজয়বাবুও জানাচ্ছেন, “মহিলার মতো পুরুষের ক্ষেত্রেও যত দ্রুত সম্ভব পরীক্ষা করালে প্রমাণ মেলার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যত ঘণ্টা পেরোবে, সম্ভাবনা তত ফিকে হয়ে আসবে। আর তারই ফাঁক গলে রেহাই পেয়ে যাবে আসল অপরাধী।” সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য বলেন, “মূক-বধির মেয়েটির বক্তব্য জানতে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া হল না কেন? মেয়েটির বক্তব্য ঠিকমতো বোঝাটা তো তদন্তেরই অঙ্গ! অভিযুক্ত চিকিৎসকের মেডিক্যাল পরীক্ষাতেই বা এত দেরি কেন?”
এই ‘দেরি’র প্রসঙ্গেই ‘সদিচ্ছা’র প্রশ্ন তুলে ধরেছেন নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষ। যাঁর বক্তব্য, “সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা অনুযায়ী, কোনও মহিলা এই জাতীয় অভিযোগ জানানোমাত্র পুলিশ তাঁর জন্য আইনি সাহায্যের ব্যবস্থা করবে। কোন আইনজীবীরা এই ধরনের কাজে ইচ্ছুক, তাঁদের তালিকাও থানায় থাকার কথা। এ সব মানা হয় না বলেই মেডিক্যাল পরীক্ষাটুকু হতেও এত দেরি হয়ে যায়।” শাশ্বতীদেবীর অভিযোগ, ধর্ষণের ঘটনায় ডাক্তারি পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রামীণ হাসপাতাল স্তরে না-থাকায় মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে। “মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য সব সময়ে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ লাগে না। স্ট্যান্ডার্ড মেডিক্যাল প্র্যাক্টিস চালু থাকা উচিত। মহিলা থানা তৈরির বদলে প্রতি থানায় আলাদা ভাবে এক মহিলা অফিসারকে দায়িত্ব দিলেও মেয়েদের অস্বস্তি কমতে পারত।” বলছেন তিনি।
একই সঙ্গে শাশ্বতীদেবী-সুচিত্রাদেবীরা মনে করছেন, অভিযোগের ছত্রিশ ঘণ্টা পরে অভিযুক্তকে যে গ্রেফতার করা হল, সেটাও অনেকটা সংবাদমাধ্যমের চাপে পড়ে। বাঁকুড়া জেলা সারদামণি মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ সিদ্ধার্থ গুপ্তের কথায়, “ইদানীং এমন অপরাধ মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। সংবাদমাধ্যম তা টানা প্রচার করছে, এটা খুবই ইতিবাচক দিক।”
উপরন্তু সুপ্রিম কোর্ট যখন বারবার ধর্ষিত মহিলার মানসিক চাপ (ট্রমা) কমাতে উদ্যোগী হতে বলছে, তখন নানা অজুহাতে তাঁর অভিযোগকে সন্দেহ করার প্রবণতা আদতে তাঁর উপরে চাপই আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে না কি?
সুচিত্রাদেবীর কথায় এ দিন সেই সংশয়েরই সুর। তাঁর আক্ষেপ, “বহু ক্ষেত্রে অপরাধীকে ধরার চেষ্টার বদলে কার্যত অভিযোগকারিণীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে। খুবই অমানবিক। পুলিশ ও প্রশাসনকে জোড়হাতে অনুরোধ করছি, প্রথমেই সাজানো ঘটনা বলে দাগ না-মেরে তদন্তের কাজটা ঠিকঠাক করুন।”

(সহ প্রতিবেদন: রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.