|
|
|
|
দুষ্কৃতীরাই ‘নিয়ন্ত্রণ’ করে হাবরা স্টেশন এলাকা |
সীমান্ত মৈত্র ও অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য • কলকাতা |
মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী দীপঙ্কর মিস্ত্রিকে সোমবার রাত সাড়ে ৭টা নাগাদ যখন হাবরা স্টেশনের ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মে মারধর করছে তোলাবাজেরা, তখন আশপাশে অনেক লোকজন। কিন্তু এগিয়ে আসেননি কেউই। স্থানীয় মানুষ ও ব্যবসায়ীদের অনেকেই জানালেন, হাবরা স্টেশনে এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। নানা অসামাজিক কাজকর্ম সব সময়েই চলে এই এলাকায়। স্টেশন ও সংলগ্ন রেলবস্তি এলাকা কার্যত দুষ্কর্মের ‘আঁতুরঘর।’
দীপঙ্করকে রেলবস্তির বাড়ি থেকে টেনে বের করে পাশের একটি ক্লাবঘরে নিয়ে গিয়ে ফের মারধর করে দুষ্কৃতীরা। তাদের দু’জনকে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করা হলেও বাকি ৪ অভিযুক্ত পুলিশের চোখে এখনও ‘ফেরার’। পুলিশ কর্তারা যথারীতি দাবি করেছেন, ওই চার জনের সন্ধানে তল্লাশি চলছে। যদিও স্থানীয় মানুষের একাংশ জানান, ‘বহাল তবিয়তে’ ঘুরে বেড়াচ্ছে দুষ্কৃতীরা। দীপঙ্করের কাছ থেকে মদ খাওয়ার টাকা চেয়ে হামলা চালিয়েছিল তারা। বস্তুত, হাবরা স্টেশন এবং সংলগ্ন এলাকায় সাট্টা, তোলাবাজি, চোলাই-গাঁজার ঠেকের রমরমা। পুলিশ ও রেলপুলিশ দেখেও না দেখার ভান করে থাকে বলে মানুষের দীর্ঘদিনের অভিযোগ। অভিযোগ করতে গেলে হেনস্থা হতে হয় বলেও নালিশ জানিয়েছেন বাসিন্দারা।
বেশ কয়েক বছর আগে রেল কলোনিতে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেন এক কলেজ ছাত্রী। তাঁর বাড়িতে ঢুকে দুই মদ্যপ দুষ্কৃতী শ্লীলতাহানি করেছিল। সেই ‘অপমানে’ ওই রাতেই আত্মহত্যা করেন তিনি। ধৃত দু’জনের সম্প্রতি ৬ বছরের কারাবাসের নির্দেশ দিয়েছে বারাসত আদালত। স্থানীয় মানুষ জানালেন, এত বছর কেটে যাওয়ার পরেও রেলকলোনি ও স্টেশন চত্বরের ছবিটা একেবারেই বদলায়নি। মদ্যপ দুষ্কৃতীরা এখনও নানা ভাবে উত্যক্ত করে মহিলাদের। রাতে স্টেশন চত্বর দিয়ে চলাফেরা করতে সাহস পান না মহিলারা।
হাবরা স্টেশন হয়ে আশপাশের কয়েকটি স্কুল-কলেজের ছাত্রীরা চলাফেরা করেন। তাঁদের অনেকেরই বক্তব্য, সন্ধের পর যেতে-আসতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের কটূক্তি শুনতে হয়েছে। ওড়না কিংবা হাত ধরে টানাটানির ঘটনাও ঘটেছে। বছর খানেক আগে চৈতন্য কলেজের এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে স্টেশন চত্বরের কিছু দুষ্কৃতী। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোলমাল ছড়ায়। নিত্যযাত্রীদেরও বক্তব্য, মদ্যপ যুবকেরা প্ল্যাটফর্মে এসে ‘গায়ে পড়ে,’ কটূক্তি করে। এমনিতেই স্টেশনে ‘জবরদখলের’ জন্য দাঁড়ানো মুশকিল। তার উপরে এ সব হাঙ্গামা পোহাতে হয়। ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে মহিলা কামরার সামনে শৌচাগারের পাশে প্রকাশ্যেই চোলাই, গাঁজা বিক্রি হয়। গত ২০ জানুয়ারি নদিয়ার এক ব্যবসায়ীর বেশ কয়েক লক্ষ টাকা ছিনতাই হয় প্ল্যাটফর্মে।
হাবরা স্টেশনের রেল কলোনির পাশেই বছর দু’য়েক আগে একটি রক্তদান শিবিরে দুষ্কৃতী হানায় খুন হয়েছিলেন বাপি চৌধুরী নামে এক কংগ্রেস নেতা। তাঁকে ‘রক্ষা’ করতে গিয়ে তৃণমূল কর্মী রঞ্জিত দাসও নিহত হন। ওই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত রাজু দাম এখনও পলাতক। তবে পুলিশি তদন্তে উঠে আসে কিছু তথ্য। জানা যায়, এলাকায় সাট্টার ঠেক চালানো, তোলাবাজির ‘বখরা’ নিয়েই গোলমালের সূত্রপাত। যার কেন্দ্রস্থল হাবরা স্টেশন প্ল্যাটফর্ম চত্বরই।
স্থানীয় মানুষ, ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, তোলাবাজি, দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্যের সামনে মুখ খুলতে সাহস করেন না তাঁরা। কারণ, পুলিশ পাকাপাকি কোনও ব্যবস্থা নেবে না, সে কথা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। দুষ্কৃতীরা নানা রাজনৈতিক দলের ‘ছত্রচ্ছায়ায়’ থাকে। এলাকায় চুরি-ছিনতাই-বোমাবাজির ঘটনাও ঘটে আকছার। যার কোনও ক্ষেত্রেই পুলিশকে তেমন ‘কড়া’ পদক্ষেপ করতে দেখা যায় না।
সম্প্রতি প্ল্যাটফর্মের ‘দখল’ নিয়ে তৃণমূল ও কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে শুরু হয়েছে সঙ্ঘাত। তাকে ঘিরেও স্টেশন চত্বরের পরিস্থিতি মাঝে মধ্যেই উত্তপ্ত হচ্ছে। পুলিশের ‘একাংশের’ সঙ্গে দুষ্কৃতীদের ‘দহরম-মহরম’ আছে বলে স্থানীয় মানুষের অভিযোগ। ‘রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া’ থেকেই দুষ্কৃতী, তোলাবাজেরা এলাকায় দাপিয়ে বেড়ায় বলেও স্থানীয় মানুষের ‘অভিজ্ঞতা।’
হাবরা পুরসভার বিরোধী দলনেতা সিপিএমের ঋজিনন্দন বিশ্বাস বলেন, “এলাকা দখল নিয়ে তোলাবাজদের মধ্যে গোলমাল লেগেই থাকে।” দুষ্কৃতীদের ‘বাড়বাড়ন্ত’ নিয়ে কী ভাবছে পুরসভা? হাবরা পুরসভার উপ পুরপ্রধান তপন সেনগুপ্তের বক্তব্য, “আমরা সমস্যাটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কিছু দিন আগে পুরসভার তরফে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, কিছু দোকানে চোলাই বিক্রি হচ্ছে। আমরা বারণ করে এসেছি।”
শিয়ালদহ রেলপুলিশ সুপার তাপসরঞ্জন ঘোষ বলেন, “মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর উপরে আক্রমণের ঘটনায় কড়া পদক্ষেপ করা হবে। হাবরা স্টেশনে রেল পুলিশের কোনও থানা নেই। এটিকে নিয়ন্ত্রণ করে বনগাঁর রেলপুলিশ। সেখানে কর্মী সংখ্যা কম। এ সব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হাবরায় রেলপুলিশের নতুন একটি থানার পরিকল্পনা করা হবে।” |
|
|
|
|
|