মঞ্চের মধ্যমণি মাত্র চব্বিশ ঘন্টা আগে এশিয়া কাপের জন্য জাতীয় দলে ঢোকা বাংলা ক্রিকেটের নতুন সম্ভাবনা। স্যুট পরে সুসজ্জিত অশোক দিন্দা। ঘনঘন ছবি উঠছে। পাশেই দাঁড়িয়ে বাংলার আর এক প্রবাদপ্রতিম অগ্রজ প্রাক্তন, যাঁর বিষাক্ত অফকাটার-লেগকাটার এখনও একটুও মলিন না হওয়া ময়দানি লোকগাথার মধ্যে পড়ে। সমর চক্রবর্তী তরুণ পেসারের কাঁধে দেন স্নেহশীল চাপড়, মঞ্চে দাঁড়িয়েই তাঁকে বলেন, “দেখিস বাবা, বন্ধুবান্ধব বেছে করিস!”
কল্যাণ মিত্র জড়িয়ে ধরলেন ঋদ্ধিকে। বলছেন, “আমরা যেটা পারিনি, সেটা তোরা করে দেখিয়েছিস। আরও বড় হ।”
এই মরসুমে ঘরোয়া ক্রিকেটে দেশের সেরা জোরে বোলার অশোক দিন্দা ভারতীয় ক্রিকেটের জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠা রাস্তায় বন্ধুবান্ধব বেছে করবেন কি করবেন না, তাঁর ব্যাপার। ঋদ্ধিমান কত বড় হবেন, সময় বলবে। কিন্তু অগ্রজ সমর চক্রবর্তী বা ময়দানের চাকুদা, কিংবা কল্যাণ মিত্র বা কান্তুদাদের এই পরামর্শে মিশে থাকল আবেগ আর আন্তরিক শুভেচ্ছা। টেস্ট কোনওদিন খেলেননি চাকুদা, কিন্তু খেলতেই পারতেন। যেমন পারতেন শ্যামসুন্দর মিত্র, কল্যাণ মিত্র বা পুণ্যব্রত দত্তরা। সঞ্চালক বর্ণিত ‘ফুটবলের উত্তমকুমার, ক্রিকেটের অনিল চট্টোপাধ্যায়’ হয়ে না উঠলে পারতেন চুনী গোস্বামীও। |
বৃহস্পতিবার বিকেলে মোহনবাগান ক্লাবের লন রাতারাতি ভোল পাল্টে বাংলা ক্রিকেটের মিলনমেলা। উপলক্ষ্য প্রথমবার দলীপ জিতে ইতিহাস সৃষ্টিকারী পূর্বাঞ্চল দলে থাকা বাংলার পাঁচ ক্রিকেটারের সংবর্ধনা। স্মারক উপহার দিয়ে গলায় মালা পরিয়ে দেওয়া মার্কা আর পাঁচটা ময়দানি সংবর্ধনার চেয়ে এই অনুষ্ঠান আলাদা। এ যে শুধু ঋদ্ধি-দিন্দা-অনুষ্টুপ-সামি-শ্রীবৎসকে বরণ করে নেওয়া নয়, একই সঙ্গে প্রবীণেরও স্বীকৃতি। এক কথায় একাকার বাংলা ক্রিকেটের সেকাল-একাল। সিএবি যা করে উঠতে পারেনি, তাই করে দেখাল মোহনবাগান। ক্লাবের সহ-সচিব সৃঞ্জয় বসুর উদ্যোগে দলীপজয়ীদের জন্য এই ব্যতিক্রমী সংবর্ধনা। মোহনবাগানের স্বপনসাধন বসু, অঞ্জন মিত্র ও কুমারশঙ্কর বাগচী ছিলেন, ছিলেন সিএবি প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়া, বোর্ডের ভাইস প্রেসিডেন্ট চিত্রক মিত্র ও সিএবি-র প্রাক্তন যুগ্ম সচিব গৌতম দাশগুপ্তও। অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা দেওয়া হল দলীপ জয়ী দলের ম্যানেজার সমীর দাশগুপ্তকেও। ডালমিয়া টুটুবাবুর অনুরোধে মঞ্চেও উঠলেন। এসেছিলেন মোহনবাগানপ্রেমী দুই মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় ও অরূপ বিশ্বাস, ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র। প্রবীণদের দেওয়া হল উত্তরীয় আর দলীপজয়ীদের জন্য থাকল ল্যাপটপ, স্মারক, উত্তরীয় আর টাই। শহরের বাইরে থাকায় শ্রীবৎস গোস্বামী শুধু আসতে পারেননি। জ্বরের জন্য আসতে পারেননি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও।
খুব সংক্ষেপে বাংলার ক্রিকেট ইতিহাস ও তার পরম্পরাকেই যেন এক বসন্তের বিকেলে বেঁধে ফেলার ঐকান্তিক এক প্রচেষ্টা। ঘন ঘন তৈরি হচ্ছিল আবেগমথিত সব মুহূর্ত। আলোকচিত্রীদের জন্য থাকছিল বিরল সব ছবি। আইপিএল-এর এই জগঝম্পের যুগে দম আটকে যাওয়া বিশুদ্ধবাদী ক্রিকেটপিপাসুর কাছে এ হল মন ভাল করে দেওয়া এক ঝলক টাটকা বাতাস। সবুজ মেরুণ মঞ্চ, দু’দিকে জায়েন্ট স্ক্রিন, যেখানে ভেসে উঠছে দলীপ জয়ের নানা মুহূর্তের ছবি, বাজছে মোহনবাগানকে নিয়ে তৈরি ‘আমরাই মোহনবাগান’ গান।
কোথাও আড্ডায় মেতে দীপ দাশগুপ্ত, দেবাঙ্গ গাঁধী, লক্ষ্মীরতন শুক্লরা। দিন্দাকে দেখে দেবাঙ্গ গাঁধীর রসিকতা, “এখনও কিন্তু তুই আমাকে আউট করতে পারিসনি!” দিন্দার পাল্টা পেসারসুলভ জবাব, “তুমি অফিস ম্যাচ এখনও খেলো তো। এসো না একদিন, দেখা যাবে!” কোথাও স্মৃতি রোমন্থনে ব্যস্ত সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অরূপ ভট্টাচার্যরা। যেখানে উঠে আসছে বাংলা ক্রিকেটের নানা রঙিন মুহূর্ত। এসেছিলেন গোপাল বসু, রাজু মুখোপাধ্যায়, বরুণ বর্মণ, প্রণব রায়, তপনজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়, সুব্রত পোড়েল, বরুণ বর্মণ, উৎপল চট্টোপাধ্যায়রা। ছিলেন অনুষ্ঠানের অন্যতম নেপথ্য নায়ক পলাশ নন্দী। দলীপ ট্রফির ইতিহাসে পাঁচবার ফাইনালে উঠেও জেতা হয়নি পূর্বাঞ্চলের। তাই এ বারের জয়ে বাংলা ক্রিকেটের আপাতধূসর ক্যানভাস রাতারাতি রঙিন। টেস্ট দলে ঋদ্ধি, ওয়ান ডে টিমে মনোজ, দিন্দা। এতটাই রঙিন যে বলতে উঠে অনুষ্টুপ বললেন, “দলীপ জিতেছি ঠিক আছে। পাঁচ জনের সংবর্ধনার জন্যও অভিনন্দন। আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি আমাদের ১৪ জনকে সংবর্ধনা দিতে হবে। যে দিন আমরা রঞ্জি ট্রফি জিতব। ছোটবেলা থেকে এই স্বপ্নটা দেখে আসছি।” ঋদ্ধি বলে গেলেন, “যে কোনও স্বীকৃতিই আনন্দের, কিন্তু তাতে দায়িত্বও বাড়ে।”
অনুষ্ঠানের শুরু শৈলেন মান্নার স্মৃতির উদ্দেশে এক মিনিট নীরবতা পালন দিয়ে। হোক না দলীপজয়ীদের সংবর্ধনা, মঞ্চের ডানদিকে তো তাঁরই মালা পরা ছবি। হাসছেন। কেন ক্লাবে আনা হয়নি তাঁর মরদেহ, তা নিয়ে এখনও ক্লাব লনে ইতিউতি আক্ষেপ। তাতে কী? প্রিয় ক্লাবের এই উদ্যোগে তো কোথাও না কোথাও থেকে গেলেন মান্না। নয়তো কেন বলতে উঠে সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলবেন, “আমি অন্য কিছুতে যাচ্ছি না, আমাদের কাছে মোহনবাগান মানেই মান্নাদা। কেন এখানে ওঁকে আনা হল না, জানি না। কিন্তু ব্যাপারটা মানতে পারিনি।”
বিতর্ক থাক। যেখানেই থাকুন, এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগের জন্য মান্নাদার আশীর্বাদের হাত নিশ্চয়ই ক্লাবের উপর থাকল। |