রাজ্যেরই দুই বাহিনীর সংঘর্ষে অগ্নিগর্ভ সালুয়া |
বরুণ দে • খড়্গপুর |
দুই বাহিনীর মধ্যে সংঘাতের ক্ষেত্র প্রস্তুতই ছিল। বৃহস্পতিবার সেটাই চরম আকার নিল। খড়্গপুরের সালুয়ায় কাউন্টার ইনসার্জেন্সি ফোর্সের (সিআইএফ) শিবিরে হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলেন ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলসের (ইএফআর) জওয়ানেরা এবং তাঁদের পরিবারের লোকজন। কোনও রকমে পালিয়ে বাঁচলেন সিআইএফ জওয়ানেরা। দু’টি বাহিনীই রাজ্য সরকারের অধীন হওয়ায় বিষয়টি অন্য মাত্রা পেয়েছে।
হামলাকারী ইএফআর-এ গোর্খা জওয়ানের সংখ্যাই বেশি। ঘটনাচক্রে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবারই দার্জিলিংয়ে গিয়ে গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিটিএ) চুক্তি নিয়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাকে ‘আর একটু ধৈর্য’ ধরতে বলেছেন। এ দিনও তিনি কালিম্পংয়ে রয়েছেন।
কী হয়েছিল সালুয়ায়? এক কলেজ ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার ঘটনায় অভিযুক্ত সিআইএফের জওয়ানের শাস্তির দাবিতে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই সালুয়ায় খড়্গপুর-কেশিয়াড়ি সড়কে সিআইএফ ব্যারাকের অদূরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন ইএফআর জওয়ানের পরিবারের লোকজন। তাঁরা ব্যারাকে ঢোকার চেষ্টা করলে লাঠি চালাতে শুরু করে পুলিশ। এর পরেই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। পাল্টা হামলায় সিআইএফ জওয়ান ও পুলিশকর্মীদের এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেয় ইএফআর। দু’পক্ষেরই অনেকে জখম হন। ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় সিআইএফ ব্যারাকে। অন্তত ৮টি পুলিশের গাড়িতে ভাঙচুর চলে। একটিতে আগুন লাগানো হয়। জেলা প্রশাসনের একাধিক গাড়িও উল্টে ফেলে দেন ক্ষিপ্ত ইএফআর জওয়ানেরা। সংঘর্ষের সময় ৩ রাউন্ড গুলির শব্দ শোনা যায়। তবে গুলি কে ছুড়ল, তা নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। |
|
মহিলা বিক্ষোভকারীকে লাঠি মহিলা পুলিশের। সালুয়ায়। |
হামলার পরেই পালিয়ে অদূরে কলাইকুন্ডার বায়ুসেনা ঘাঁটি এলাকায় আশ্রয় নেন সিআইএফ জওয়ানেরা। সন্ধ্যার পর থেকে পুরো এলাকাই কার্যত ইএফআরের ‘দখলে’। ঢুকতে পারেনি পুলিশও। পরিস্থিতি বুঝে ইএফআরকে ঘাঁটাচ্ছে না পুলিশ-প্রশাসনও। রাতে অবশ্য কলাইকুন্ডা থেকে সিআইএফ জওয়ানদের কড়া পুলিশি পাহারায় নিয়ে যাওয়া হয় মেদিনীপুর পুলিশ লাইনে। সেখানে তাঁরা নিরাপত্তা সংক্রান্ত দাবিদাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ দেখালে তাঁদের বার করে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। পুলিশ লাইনের সামনের রাস্তায় ঘণ্টাখানেক অবস্থান করেন সিআইএফ জওয়ানেরা। পরে ঝাড়গ্রাম পুলিশ জেলার সুপার গৌরব শর্মা এসে তাঁদের শান্ত করেন। জওয়ানদের ফের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়।
সালুয়ায় ইএফআরের এমন বিক্ষোভ শেষ বার দেখা গিয়েছিল ২০১০ সালে। ওই বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে শিলদায় ইএফআর শিবিরে মাওবাদী হামলায় ২৪ জন জওয়ানের মৃত্যুর পরে উত্তাল হয়েছিল এই এলাকা। নিরাপত্তা এবং অন্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রশ্ন তুলে জওয়ানদের পরিবার এবং জওয়ানদের একাংশ শুরু করেছিলেন বিক্ষোভ-আন্দোলন। ইএফআরের তৎকালীন স্পেশাল আইজি বিনয় চক্রবর্তী প্রথা ভেঙে মুখে কালো কাপড় বেঁধে সাংবাদিক সম্মেলন করে তোপ দেগেছিলেন রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে। রাজ্যপাল
এম কে নারায়াণন নিজে তখন সালুয়ায় গিয়ে বিক্ষোভ প্রশমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।
ঘটনাচক্রে মাওবাদী দমনেই গড়ে তোলা হয়েছে সিআইএফ। তাদের ব্যারাকেই হামলা চালাল ইএফআর। এই পরিস্থিতিতে সিআইএফের অন্দরে সালুয়ার ‘অস্থায়ী’ ক্যাম্প স্থানান্তরের জোরালো দাবি উঠেছে। সিআইএফ জওয়ানদের বক্তব্য, তাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। যখন-তখন এলাকার লোক ক্যাম্পের সামনে চলে আসছে। |
|
|
অগ্নিগর্ভ সালুয়ায় খণ্ডযুদ্ধ রাজ্য সরকারের দুই বাহিনীর। ভাঙচুরের
পরে সিআইএফ ব্যারাক। বৃহস্পতিবার সৌমেশ্বর মণ্ডলের তোলা ছবি। |
|
রাজ্য সরকারেরই একটি বাহিনীর সঙ্গে আর এক বাহিনীর এমন সংঘাত এবং এ দিনের সংঘর্ষের ঘটনায় সামগ্রিক ভাবে আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নই সামনে চলে আসায় বিড়ম্বনায় পড়েছেন পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংবাদমাধ্যমকে বারবার বলেছেন কোনও ঘটনা ঘটলে প্রশাসনের কাছ থেকে তা ‘ক্রস চেক’ (যাচাই) করে নেবেন। সেই মতো এ দিন সালুয়ার ঘটনা নিয়ে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব জ্ঞানদত্ত গৌতমের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা হলে তাঁর অফিস থেকে জানানো, তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করবেন না। তখন ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তাঁর অফিস থেকে বলা হয়, ডিজি সালুয়ার ঘটনা নিয়ে ব্যস্ত। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন না। এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ বলেন, “বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে জেনে নিন।”
কিন্তু রাজ্য প্রশাসনের মতোই মুখে কুলুপ এঁটেছেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারাও। খড়্গপুরে ইএফআরের ফার্স্ট ব্যাটেলিয়নের দফতরে সন্ধ্যায় রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন ডিআইজি (মেদিনীপুর) বিনীত গোয়েল, জেলার পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠী, সিআইএফের এসপি মনোজ বর্মা-সহ শীর্ষ পুলিশ কর্তারা। ছিলেন তৃণমূল বিধায়ক মৃগেন মাইতি, শ্রীকান্ত মাহাতো, খড়্গপুরের পুরপ্রধান জহরলাল পাল। ডিআইজি জানান, আপাতত শান্তি ফেরানোই প্রথম কাজ। সংঘর্ষ বা সিআইএফ ব্যারাক সরানোর দাবি নিয়ে তিনি মন্তব্য করতে চাননি। মন্তব্য করেননি মনোজ বর্মাও। মৃগেনবাবুর কথায়, “যে হেতু দু’টি বাহিনীই রাজ্য সরকারের, তাই অশান্তি মিটিয়ে এলাকায় শান্তি ফেরানোই প্রশাসনের প্রাথমিক লক্ষ্য। ওই কলেজ ছাত্রীর অভিযোগও পুলিশ গুরুত্ব সহকারে দেখছে।” সালুয়ার ঘটনা নিয়ে রাজ্য প্রশাসনের কর্তারাও মহাকরণে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছেন।
সালুয়ায় ইএফআরের তিনটি ব্যাটেলিয়নের সদর দফতর রয়েছে। কয়েক দশক হল জওয়ানদের পরিবারের বসতিও গড়ে উঠেছে এলাকায়। বছর দেড়েক আগে এখানে মাওবাদী দমনে বিশেষ বাহিনী সিআইএফের অস্থায়ী ব্যারাক তৈরি হওয়ার পরে চাপা ক্ষোভ জন্মায় ইএফআরের। সিআইএফ ব্যারাকের শ’দেড়েক জওয়ান এলাকার পরিবেশ ‘নষ্ট’ করবে বলে আশঙ্কা ছিল তাদের। সম্প্রতি দু’টি শ্লীলতাহানির অভিযোগকে ঘিরে সেই ক্ষোভ প্রকাশ্যে আসে। দু’টি ঘটনাতেই পুলিশ পরোক্ষে সিআইএফ জওয়ানদের ‘পক্ষ নেওয়ায়’ ক্ষোভ বাড়ে। তবে বিবাদ কখনওই চরমে পৌঁছয়নি। |
|
সালুয়ায় অবস্থান-বিক্ষোভ ইএফআরের। |
গত শুক্রবার রাতে শিবরাত্রি উপলক্ষে আয়োজিত মেলার মাঠে সিআইএফের এক জওয়ান ইএফআর পরিবারের এক মহিলাকে কটূক্তি করেন বলে অভিযোগ। রাতেই দুই বাহিনীর মধ্যে বচসা-মারপিট হয়। জখম হন কমপক্ষে ৩৫ জন। পুলিশি তৎপরতায় ধীরে ধীরে যখন স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছিল সালুয়া, তখন মঙ্গলবার রাতে ইএফআর পরিবারের এক কলেজ ছাত্রীকে ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ এক সিআইএফ জওয়ানের উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ ঘিরে ফের উত্তেজনা বাড়ে।
প্রতিবাদে গভীর রাতে সিআইএফ ব্যারাক ঘেরাওয়ের চেষ্টা হয়। বুধবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দফায়-দফায় বিক্ষোভ দেখান ইএফআর পরিবারের লোকেরা। এ দিন সকাল আটটা নাগাদ ফের বিক্ষিপ্ত অবরোধ শুরু হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবরোধকারীদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। খবর পেয়ে বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছন খড়্গপুরের এসডিপিও দীপক সরকার। অভিযোগ, শুরু থেকেই ইএফআর পরিবারের লোকেরা সিআইএফ ব্যারাকে ঢুকতে চাইছিলেন। পুলিশ বাধা দেয়। দুপুর পর্যন্ত এই টানাপোড়েন চলে। সাড়ে ১২টা নাগাদ হঠাৎই পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। |
|
জ্বলছে পুলিশের গাড়ি। সৌমেশ্বর মণ্ডলের তোলা ছবি। |
ইএফআর পরিবারের লোকেদের অভিযোগ, পুলিশ বেপোরোয়া ভাবে লাঠি চালিয়েছে। মহিলাদের উপরও লাঠিপেটা করা হয়েছে। শুধু বিক্ষোভকারীদের উপরেই নয়, ইএফআর জওয়ানদের আবাসনে ঢুকেও লাঠি চালায় পুলিশ। এই ঘটনায় ইএফআর পরিবারের অন্তত ১৬ জন আহত হন। তাঁদের অন্যতম রাজু রানা বলেন, “আমি টিউশনের পর বাড়ি ফিরছিলাম। পুলিশ হঠাৎ ধরে মারতে শুরু করে। মহিলাদেরও লাঠিপেটা করা হয়।” রাজুর বাবা, ইএফআর জওয়ান গণেশ রানা বলেন, “পুলিশ অন্যায় কাজ করেছে। আমরা ন্যায়-বিচার চাই।”
দুপুর দেড়টা নাগাদ ইএফআর পরিবারের লোকজন পাল্টা হামলা চালান। এক দল লোক (জওয়ানেরাও ছিলেন) সিআইএফ ব্যারাকে ভাঙচুর চালান। অগ্নিসংযোগ করা হয়। ইটের ঘায়ে মহিলা-সহ অন্তত ১২ জন পুলিশকর্মী আহত হন। আহতদের মধ্যে রয়েছেন খড়্গপুরের এসডিপিও দীপক সরকার, সিআই অরুণাভ দাস, ওসি বিশ্বজিৎ সাহা। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়েও পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়।
ঘটনাস্থলে পৌঁছন পশ্চিম মেদিনীপুরের অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) শুভাঞ্জন দাস, জেলা পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মীরেজ খালেদ, খড়্গপুরের মহকুমাশাসক সুদত্ত চৌধুরী। এঁরা কেউই সালুয়ায় ঢুকতে পারেননি। ঘটনাস্থল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে গোপালি পর্যন্ত এসে তাঁরা আটকে পড়েন। বিকেলে সালুয়ায় এসে স্থানীয় কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলেন খড়্গপুরের পুরপ্রধান। তাতেও পরিস্থিতির কোনও হেরফের হয়নি। এঁটে ওঠা মুশকিল বুঝে এক সময় এলাকা ছেড়ে চলে যায় পুলিশ। এর পরেই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেন ইএফআর পরিবারের লোকজন।
|
সংঘাতের চার দিন |
২৪ ফেব্রুয়ারি |
ইভ-টিজিংয়ের অভিযোগে ইএফআর-সিআইএফ সংঘর্ষ। |
২৮ ফেব্রুয়ারি |
সিআইএফ ব্যারাক ঘেরাওয়ের চেষ্টা। |
২৯ ফেব্রুয়ারি |
দফায়-দফায় বিক্ষোভ। |
১ মার্চ |
সিআইএফ ব্যারাকে ফের হামলা।
পুলিশের লাঠি। পাল্টা হামলা ইএফআরের।
পুলিশের গাড়ি-ব্যারাকে ভাঙচুর ও আগুন।
শোনা গেল গুলির শব্দ। ঢুকতে পারেনি পুলিশ।
সন্ধ্যার পরে এলাকার দখল নিল ইএফআর। |
|
|