রাতারাতি উধাও আস্ত একটা নদ! খরস্রোত ব্রহ্মপুত্র অরুণাচলপ্রদেশের পাসিঘাটে আচমকাই শুকিয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পূর্ব সিয়াংয়ের জেলা সদরে গত কাল দুপুর থেকেই ব্রহ্মপুত্র বা সিয়াং-এর জল আচমকা নামতে শুরু করেছিল বলে জানান রাজ্য সরকারের মুখপাত্র তাকো দাবি। রাতেই প্রায় পুরো শুকিয়ে যায় নদীখাত। গোটা ঘটনায় সন্দেহের তির বেজিংয়ের দিকে। বিদেশ মন্ত্রক-সূত্রে বলা হয়েছে, ঘটনার কারণ এবং এর পিছনে ‘অন্য কোনও দেশের’ হাত রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
২০০০ সালে এক বিধ্বংসী বন্যা দেখেছিল পাসিঘাট। পরে জানা যায়, তিব্বতে একটি বাঁধ ভেঙে ওই বন্যা হয়েছিল। কিন্তু এ বারের ঘটনাটির ভৌগোলিক কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। নয়াদিল্লির কূটনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, অরুণাচল নিয়ে ভারত-চিনের সাম্প্রতিক টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে ঘটনাটিকে দেখা দরকার। সম্প্রতি ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অরুণাচল সফর নিয়ে চিন সরকার বিরূপ মন্তব্য করায় অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী নাবাম টুকি কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। তার কিছুদিন পরেই কেন এমন ঘটল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বস্তুত, চিনের ‘আপত্তি’ উপেক্ষা করে আজই ইটানগরে যান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মুল্লাপল্লি রামচন্দ্রন।
বিদেশ মন্ত্রকের যুগ্মসচিব (চিন) গৌতম বাম্বেওয়ালার বক্তব্য, “ভারত এবং চিনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলির গতি পরিবর্তন নিয়ে দু’দেশই বহু বার আলোচনা করেছে। চিন কথা দিয়েছে যে তারা এমন কিছু করবে না যাতে ভারত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।” কিন্তু এর পরেই তিনি বলেছেন, “চিনের মুখের কথা মেনে না নিয়ে আমরা নিজেদের মতো করে ব্রহ্মপুত্র শুকিয়ে যাওয়ার বিষয়টি দেখছি।”
পশ্চিম তিব্বতে মানস সরোবরের কাছে আংসি হিমবাহ ব্রহ্মপুত্রের উৎস। তখন অবশ্য নদীটির নাম ইয়ারলুং সাংপো। সেই নদীই তুতিং এলাকায় সিয়াং নাম নিয়ে ঢুকেছে অরুণাচলে। অরুণাচল সরকারের একটি সূত্রের দাবি, উত্তর-পূর্বকে ‘শাস্তি’ দিতে চিনের তরফে ব্রহ্মপুত্রের উৎস ও উপরিভাগে প্রবাহ বন্ধ করার প্রচ্ছন্ন হুমকি একাধিক বার দেওয়া হয়েছে। উপগ্রহ চিত্রেও স্পষ্ট যে, তিব্বত, ব্রহ্মপুত্রের পার্বত্য গতিপথ এবং মালভূমি অংশে একাধিক বাঁধের কাজ চলছে। ইউনান প্রদেশে মেকং অববাহিকায় সাংপোর উপরে আটটি পর্যায়ে বাঁধ গড়ায় হাত দিয়েছে চিন। এর মধ্যে ১৯৯৬-এ মানওয়ান বাঁধের কাজ শেষ হয়েছে।
তাকো দাবি আজ বলেন, “মনে হচ্ছে, নদীর উৎসে চিন কলকাঠি নেড়েছে। হয় জল অন্য দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, নয়তো কৃত্রিম ভাবে জলের গতিপথে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। এই নদীই আমাদের জীবনরেখা। এখানে জল শুকিয়ে গেলে অসমেও দ্রুত প্রভাব পড়বে। ব্রহ্মপুত্রকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে ভারত সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নিক।” কেন্দ্রীয় জল কমিশনের প্রতিনিধিদের ঘটনাস্থলে আসার আর্জিও জানিয়েছেন তিনি। ঘটনাস্থল ঘুরে তাকো বলেন, নদীর জল দ্রুত কমতে দেখেই এলাকার বাসিন্দারা বিষয়টি প্রশাসনকে জানিয়েছিলেন। পরে সকলের চোখের সামনে বাকি জলটুকুও প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। পাসিঘাটে ব্রহ্মপুত্রের বিরাট প্রস্থ জুড়ে এখন শুধু সরু এক জলের ধারা।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা? জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অবসরপ্রাপ্ত ভূবিজ্ঞানী জ্ঞানরঞ্জন কয়ালের কথায়, “প্রাকৃতিক কারণে এমনটা হলে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটত। সাধারণত বড় ধরনের কোনও ভূমিকম্প হলেই নদীর তলদেশে ফাটল ধরতে পারে। সে ক্ষেত্রে এ ভাবে নদীর জল কমে যাওয়াটা স্বাভাবিক।” কিন্তু ওই অঞ্চলে এ ধরনের ভূমিকম্প সাম্প্রতিক কালে হয়নি। তাই এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই অন্য কোনও কারণে জলের প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে কিংবা অন্য দিকে ঘুরে গিয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। |