মহাকরণে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ওই মহিলার (কাটোয়া-আমোদপুর লাইনের ট্রেন থেকে গত শনিবার যাঁকে নামিয়ে নেওয়া হয়েছিল) ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের কোনও প্রমাণ মেলেনি। ঘোষণার সময়ে মুখ্যমন্ত্রী সাক্ষী মেনেছিলেন পাশে দাঁড়ানো রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়কে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায় সায় দিয়ে পুলিশ-প্রধানও জানিয়েছিলেন, ওই মহিলার ডাক্তারি পরীক্ষায় কিছুই পাওয়া যায়নি। কিন্তু এক জন মহিলা ধর্ষিত হয়েছেন কি না, তা জানতে যে ‘ডাক্তারি পরীক্ষা’ই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্ণায়ক নয়, তার সমর্থন মিলেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের একাধিক রায়ে। একই কথা বলছে দেশের ফৌজদারি আইনও।
কী রকম?
যেমন, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৫ নম্বর ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, নিম্নলিখিত ছ’টির মধ্যে যে কোনও একটি পরিস্থিতিতে কোনও পুরুষ তাঁর স্ত্রী ব্যতীত কোনও মহিলার সঙ্গে যৌন সংসর্গ করলে তা ধর্ষণ বা বলাৎকার হিসেবে গণ্য হবে। পরিস্থিতিগুলি হল:
১) মহিলার ইচ্ছের বিরুদ্ধে
২) মহিলার সম্মতি ছাড়া
৩) সম্মতি যদি মৃত্যু কিংবা ক্ষতিসাধনের ভয় দেখিয়ে আদায় করা হয়
৪) মহিলার সম্মতি থাকলেও পুরুষটি যদি জানেন তিনি ওঁর স্বামী নন, এবং মহিলা যদি সম্মতি দিয়ে থাকেন এই বিশ্বাসে যে, পুরুষটির সঙ্গে তাঁর আইনানুগ বিয়ে হয়েছে
৫) মানসিক বিকারগ্রস্ততা বা নেশার ঘোরে মহিলা সম্মতিদানের প্রকৃত কারণ ও পরিণতি বুঝতে অসমর্থ হয়ে থাকলে এবং
৬) মহিলার বয়স যদি ষোলোর কম হয়। অর্থাৎ পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, ১৬ বছরের কম বয়সী যে কোনও মেয়ের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করাটা ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধি মোতাবেক সব সময়ে ধর্ষণ হিসেবেই গণ্য হবে।
এবং ধর্ষণ হয়েছে কি না, তা জানার জন্য সংশ্লিষ্ট মহিলার ‘ডাক্তারি পরীক্ষা’র কথা এ সবের মধ্যে কোথাও বলা নেই। মহাকরণে রাজ্যের এক পুলিশ-কর্তা বলেন, “আইনে কিন্তু কোথাও ডাক্তারি পরীক্ষা আবশ্যিক বলে উল্লেখ নেই। পরিস্থিতি বিচারের উপরেই ভরসা রাখা হয়েছে।” বস্তুত এক জন মহিলাকে যখন একাধিক পুরুষ জবরদস্তি ট্রেন থেকে নামিয়ে নিয়ে যায়, তখন তাদের উদ্দেশ্যকেই তদন্তে ‘পাখির চোখ’ করা উচিত বলে মনে করছেন তিনি। রাজ্য গোয়েন্দা-পুলিশ (সিআইডি)-এর এক কর্তাও একই সুরে বলেছেন, “খুব কম ক্ষেত্রে ধর্ষণের ঘটনার সাক্ষী পাওয়া যায়। তাই নির্যাতিতার বক্তব্যকেই প্রাধান্য দেওয়া জরুরি। অভিযুক্ত ধরা পড়লে তদন্তের প্রয়োজনে তাকে জেরা করা যেতেই পারে।”
তা হলে কি মেডিক্যাল টেস্টের কোনও গুরুত্ব নেই?
ওই পুলিশ-কর্তাদের বক্তব্য: ডাক্তারি পরীক্ষা আদতে একটি বিশেষজ্ঞ-মত। তা যে সব সময়ে ধর্ষিতার পক্ষে যাবে, তা-ও বলা যায় না। আর পারিপার্শ্বিক প্রমাণকে যথেষ্ট বলে মনে হলে বিশেষজ্ঞ-মত নেওয়ারও দরকার পড়ে না। ওঁদের মতে, পুলিশ অধিকাংশ ক্ষেত্রে মহিলার মেডিক্যাল পরীক্ষা করিয়ে থাকে অনেকটা প্রথা হিসেবে, কখনও বা তদন্তের দুর্বলতা ঢাকতে।
এ প্রসঙ্গেই উঠে আসছে বরাহনগরে এক ঝুপড়িবাসিনীকে ধর্ষণের সাম্প্রতিক ঘটনাটি। ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ওই মহিলার যোনিতে
কোনও আঘাতের চিহ্ন ছিল না। কিন্তু মলদ্বার ছিল ক্ষতবিক্ষত। সেখান দিয়ে ধর্ষণের পরে স্ক্রু-ড্রাইভার বা লোহার রডের মতো ভোঁতা কিছু ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ফলে প্রবল রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়। রাজ্য পুলিশের একাধিক কর্তার প্রশ্ন, “তা হলে কি তিনি ধর্ষিতা হননি?
সব সময়ে যোনিতে আঘাত থাকতে হবে, তার বাধ্যবাধ্যকতা কোথায়?”
ওঁদের বক্তব্য, “ঝুপড়িবাসিনী জীবিত থাকলে তাঁর মেডিক্যাল পরীক্ষাতেও যোনিতে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যেত না। তা হলে ডাক্তারি পরীক্ষাকে কোন যুক্তিতে চূড়ান্ত হিসেবে ধরা যাবে?”
বস্তুত কোনও মহিলাকে ‘ধর্ষণ’ বলতে শুধু যোনিমুখে পুরুষাঙ্গ প্রবেশের উপরেই জোর দেওয়ার যে প্রবণতা, তার দিকেও আঙুল তুলেছেন ওই পুলিশ-কর্তারা। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, কোনও মহিলাকে ভয় দেখিয়ে ইচ্ছের বিরুদ্ধে মুখ-রতিতে বাধ্য করা হলে কিংবা পায়ুমৈথুন করা হলে কি তাঁর যোনিতে আঘাতের চিহ্ন থাকবে? একই ভাবে, আঙুল দিয়ে যৌন অত্যচার চালালেও ডাক্তারি পরীক্ষায় পুরুষ-বীর্য মিলবে না। অথচ দু’টি ক্ষেত্রেই মহিলা নিশ্চিত ভাবে ধর্ষিতা হয়েছেন বলে মনে করেন পুলিশকর্তারা।
আইনের এই ‘সীমাবদ্ধতা’ দূর করার দাবিতে একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে। তাদের অভিযোগ: ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৫ নম্বর ধারায় শুধু ধর্ষণের পরিস্থিতি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে, অসম্মতিতে কিংবা ভয় দেখিয়ে সম্মতি আদায় করে যৌন সংসর্গ করাটাই ধর্ষণ। কিন্তু কোনও মহিলার শরীরে পুরুষের মানসিক বা শারীরিক বিকৃতির চিহ্ন মিললেই তা ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত বলে সংগঠনগুলি মনে করে।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে খবর: ১৯৯৭-এ এমনই একটি সংস্থা সুপ্রিম কোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করে জানতে চেয়েছিল, ভারতীয় দণ্ডবিধিতে ধর্ষণের যথাযথ সংজ্ঞা কী? শীর্ষ আদালত তখন ল’ কমিশনকে বিষয়টি স্পষ্ট করার নির্দেশ দেয়। যদিও এ বিষয়ে ল’ কমিশনের দাখিল করা রিপোর্ট আবেদনকারী সংস্থাটিকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সুপ্রিম কোর্টও তাদের ‘অসন্তোষের’ যৌক্তিকতা মেনে নেয়। ১৯৯৯-এ কমিশনকে বলা হয় নতুন করে রিপোর্ট দিতে।
আর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ধর্ষণের সংজ্ঞা নির্ধারণ সংক্রান্ত যে খসড়া রিপোর্ট কমিশন তৈরি করেছে, তাতে ‘ধর্ষণ’-এর বদলে ‘যৌন নিগ্রহ’ কথাটি ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়েছে। কমিশনের মতে, নিছক যোনিমুখে পুরুষাঙ্গ প্রবেশের বাইরেও মহিলাদের উপরে নানা ভাবে যৌন নিগ্রহ হতে পারে। যে কারণে মহিলার কোনও অঙ্গে পুরুষের কোনও অঙ্গ প্রবেশকেই ধর্ষণ বলে বিবেচনা
করা উচিত।
ল’ কমিশনের সেই সুপারিশের ভিত্তিতেই বছর দুয়েক আগে সব রাজ্যকে চিঠি দিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ধর্ষণের সংজ্ঞা বদলানোর বিষয়ে মতামত জানতে চেয়েছিল। মহাকরণ সূত্রের খবর, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ওই সুপারিশের পক্ষেই মত দিয়েছে। |