|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
ইরানের পরমাণু অস্ত্র? দূর অস্ত্
মার্কিন-ইজরায়েলি আস্ফালন চলবেই |
ইরানের পরমাণু উদ্যোগ উত্তর কোরিয়ার চেয়েও দুর্বল। তার ওপর রয়েছে অন্তর্ঘাত
ইরানের
কয়েক জন নামী পরমাণু বিজ্ঞানী গুপ্তহত্যার শিকার। ইরানের পরমাণু শক্তির
মূল্যায়নে আমেরিকা
ও ইজরায়েল বিপুল অতিরঞ্জন করে চলেছে। জানাচ্ছেন প্রদীপ দত্ত |
অনেক বছর ধরেই আমেরিকা ও ইজরায়েল মনে করে ইরানের পরমাণু বিদ্যুৎ কর্মসূচির আসল উদ্দেশ্য পরমাণু অস্ত্র তৈরি করা। তবে ২০০২ সালের অগস্ট মাসে আমেরিকায় এক সাংবাদিক বৈঠকে ইরানের পরমাণু সক্ষমতা নিয়ে ন্যাশনাল কাউন্সিল অব রেজিস্ট্যান্স-এর প্রতিনিধিদের কথাবার্তার পর থেকেই সমস্যা ঘোরালো হয়ে ওঠে। সে বছর ডিসেম্বরে কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে ইরানের নাতান্জ-এ পরমাণু জ্বালানি উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ এবং আরাক-এ তৈরি ভারী জল গবেষণা চুল্লির ছবি দেখা গেল। তাতে আমেরিকা উদ্বিগ্ন হল। স্মরণীয়, ষাটের দশকে আমেরিকাই ইরানকে পাঁচ মেগাওয়াট তাপ উৎপাদনকারী পরমাণু গবেষণা চুল্লি সরবরাহ করেছিল। আমেরিকাই হট সেল সরবরাহ করেছে, তার প্রশিক্ষণ দিয়েছে যেখানে অল্প পরিমাণ নিঃশেষিত জ্বালানি রাসায়নিক প্রক্রিয়াকরণ করে প্লুটোনিয়াম-সহ নানা পদার্থ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
তখন ইরানের স্বৈরশাসক, ওয়াশিংটনের প্রিয়, মহম্মদ রেজা পহলভি এমন পরমাণু বিদ্যুৎশিল্প গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যার উৎপাদন ক্ষমতা হবে ২৩ হাজার মেগাওয়াট। ওই কর্মসূচি থেকেই ওয়াশিংটনের মনে সন্দেহ ঢুকেছিল। শাহ সে সময় বলেছিলেন, অঞ্চলের অন্য কোনও দেশ পরমাণু অস্ত্র তৈরি করলে ইরানও সে কথা ভাববে। শাহ আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপ থেকে পরমাণু চুল্লি কিনতে চেয়েছিলেন। দীর্ঘ আলোচনার পর ইরান ও আমেরিকা একমত হলেও, সত্তরের দশকের শেষে খোমেইনির ইসলামি বিপ্লবে সে সব পণ্ড হয়।
গত কয়েক বছর ধরেই আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ চালু করেছে। ইদানীং হরমুজ প্রণালীতে বিমানবাহী জাহাজ রেখে ইরানের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে। আশা এইটুকুই, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছরে আমেরিকা হয়তো নতুন করে যুদ্ধে জড়াতে চাইবে না।
|
জুজুর ভয় |
নব্বইয়ের দশকে মার্কিন ও ইজরায়েলি নীতিনির্ধারকরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ২০০০ সালের মধ্যে ইরানের হাতে পরমাণু বোমা এসে যাবে। তা যখন ঘটল না, তাঁরা ২০০৫ সালের কথা বললেন। তার পর বললেন, ২০১০; এখন বলছেন ২০১০-১৫; অথচ, ইরান কিন্তু ২০০৩-এই পরমাণু প্রসার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। যদিও ইরানে সেই সিদ্ধান্তের বিরোধীদের বক্তব্য ছিল, যেহেতু মাত্র ছ’শো কিলোমিটার দূরে ইজরায়েলে বিপুল পরমাণু অস্ত্র, পরমাণু অস্ত্রসজ্জিত ডুবোজাহাজ, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও পরমাণু অস্ত্রবাহী মার্কিন এফ ফিফটিন বিমান রয়েছে, তাই ইরানের অস্ত্র তৈরির রাস্তা খোলা রাখা দরকার।
|
|
আতঙ্ক। জার্মানির কোলন-এ একটি কার্নিভাল-এ ইরানের প্রেসিডেন্ট
মাহমুদ আহমদিনেজাদের মূর্তি, হাতে পরমাণু বোমা। ফেব্রুয়ারি, ২০১২। ছবি: এ পি |
অন্য দিকে, পরমাণু অস্ত্রমুক্ত পশ্চিম এশিয়া গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইজরায়েল-সহ নানা দেশকে অস্ত্র পরিহার করে পরমাণু প্রসার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষরের জন্য আবেদন করেছিল ইরান। তার সঙ্গে গলা মেলায় মিশর, সিরিয়া ও জর্ডন। ২০০৩-এর ডিসেম্বর মাসে নিরাপত্তা পরিষদের বিবেচনার জন্য এ বিষয়ে খসড়া প্রস্তাব তৈরি হয়। তবে মার্কিন ভেটোর জুজুতে ব্যাপারটি এগোয়নি। অন্য দিকে, পশ্চিমি সংবাদমাধ্যম বরাবরই ইজরায়েলকে ষষ্ঠ বৃহৎ পরমাণু অস্ত্রধর দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থাও (আই এ ই এ) তাদের পরমাণু অস্ত্রধর দেশ হিসেবেই ধরে।
এক বছরের বেশি তদন্ত চালিয়ে ২০০৪ সালের অক্টোবর মাসে আই এ ই এ-র প্রধান এলবারাদেই জানিয়েছিলেন, ‘ইরানে কোনও পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচি আমি দেখছি না,... তারা পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ প্রযুক্তি আয়ত্ত করার চেষ্টা করছে।’ আই এ ই এ-র প্রধান হিসেবে এলবারাদেইয়ের দ্বিতীয় দফার মেয়াদ ফুরোনোর কথা ছিল ২০০৫-এর শেষে। ইরাকের প্রতি তাঁর নরম মনোভাবে ক্ষুণ্ণ হয়ে আমেরিকা তাঁর তৃতীয় দফা নিয়োগের বিরোধিতা করছিল। শেষে তিনি ইরানের বিরুদ্ধে কড়া মতামত দিলেন। সে বছরের মাঝামাঝি জানা গেল, তাঁর পুনর্নিয়োগে আমেরিকার আপত্তি নেই। ২০০৫-এর সেপ্টেম্বরে ইরান কী কী ব্যাপারে সহযোগিতা করেনি, এলবারাদেই তার ফর্দ পেশ করলেন। ওই সেপ্টেম্বরেই আই এ ই এ-র প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ইরান তাদের পারমাণবিক জ্বালানিচক্র সম্পর্কিত নানা কাজকর্ম আই এ ই এ’কে সময় মতো জানায়নি। প্রাকৃতিক ইউরেনিয়াম আমদানি করা ও তা সমৃদ্ধকরণ সম্পর্কিত কাজকর্ম নিয়ে জানানো হয়নি। নমুনা প্লুটোনিয়াম বিচ্ছিন্ন ও প্রক্রিয়াকরণের জন্য তৈরি এসফাহান নিউক্লিয়ার টেকনোলজি সেন্টারের কাজকর্ম এবং কালায়ে ইলেকট্রিক কোম্পানি ওয়ার্কশপে নমুনা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রের অস্তিত্ব জানানো হয়নি। আরও নানা তথ্য গোপন করা নিয়ে অভিযোগ করা হয়েছিল। ইরান ১৩১ পৃষ্ঠার উত্তরে বলে, নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি অনুযায়ী স্বীকৃত পরমাণু জ্বালানিচক্রের কাজ চালাতে অসুবিধা হচ্ছে। ইরানের পরমাণু শক্তির মূল্যায়নে মার্কিন ও ইজরায়েলের নীতিনির্ধারকরা বিপুল অতিরঞ্জন করেছেন। প্রায় একই ভাবে ২০০৩ সালে ইরাকের পরমাণু ও অন্য গণবিধ্বংসী অস্ত্রের কথা বলেই আমেরিকা ইরাক যুদ্ধ শুরু করেছিল, পরে সে সব কিছুই মেলেনি। ২০২০-র মধ্যে ৬০০০ মেগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন ইরানের ঘোষিত লক্ষ্য। পরমাণু চুল্লি ও পরমাণু অস্ত্র যমজ ভাই বলেই সে কথা আমেরিকা ও ইজরায়েল জানতে চাইছে না।
|
অমূলক |
এখনও পর্যন্ত ইরানের হাতে রয়েছে শতকরা ৩ ভাগ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম খানিকটা এবং খুবই স্বল্প পরিমাণে শতকরা ২০ ভাগ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম। ২০ ভাগ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম আরও অনেকটা মজুত করার লক্ষ্য রয়েছে। তাতে সফল হলে তবেই বোমা তৈরির উপযুক্ত ৯০ ভাগ ইউরেনিয়াম জমা করার প্রশ্ন আসবে। এখনও পর্যন্ত সেই লক্ষ্যে ইরান এগোতে পারেনি। কাজ এগোচ্ছে শম্বুক গতিতে। কয়েক বছরে তাদের কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ পরমাণুবিজ্ঞানী গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছেন। তাতে ইরানের পরমাণু প্রকল্পে অসহায়তা বাড়ছে।
ইরান পাকিস্তানের শক্তিশালী পি টু সেন্ট্রিফিউজ মডেল আমদানি করেছিল নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। তার প্রায় দশ বছর পর প্রেসিডেন্ট আহমেদিনেজাদ শিগগিরই সেকেন্ড জেনারেশন সেন্ট্রিফিউজ প্রয়োগের কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে ২০১১-এর আগে তার ব্যবহার করতে পারেনি। ইরানের সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার বেশির ভাগই এখনও নির্ভর করে পুরনো পাকিস্তানি পি ওয়ান সেন্ট্রিফিউজ নকশার ওপরে। তাদের হাতে গ্যাস সেন্ট্রিফিউজের সংখ্যা কমেছে। এ সব কারণেই ২০১০ সালের গোড়ায় ইরানের পরমাণু কর্মসূচির গতি মন্থর হয়ে আসে। এ কথা বলেছেন আই এ ই এ-র নিরাপত্তা বিভাগের প্রাক্তন প্রধান অলি হেইলেনেন। নিচু মান ও দুর্বল প্রযুক্তির সাহায্যে হিরোশিমা মাপের একটি বোমাও তৈরি করা যাবে কি না, বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত নন। এর পর রয়েছে পশ্চিমি অন্তর্ঘাত। যেমন, ২০১০ সালে স্টাক্সনেট ভাইরাসের আক্রমণে নাতান্জ পরমাণু কেন্দ্রের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়। এর পরও যদি ইরান যথেষ্ট পরিমাণ অতি-সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম বানিয়ে ফেলে, সে ক্ষেত্রেও বলতে হয়, বিভাজনক্ষম পদার্থ মজুত করা এবং নিক্ষেপযোগ্য পরমাণু অস্ত্র তৈরি করে ফেলার মধ্যে ফারাক বিস্তর। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে উত্তর কোরিয়ার হাতে মজুত প্লুটোনিয়ামের হিসেব কষে আমেরিকা জানিয়েছিল, তাদের একটি বা দু’টি পরমাণু বোমা আছে। প্রায় দুই দশক পর, ২০০৯-এ উত্তর কোরিয়া কোনও মতে একটি পরীক্ষামূলক পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটাতে পেরেছিল। ইরানের পরমাণু উদ্যোগ এর চেয়েও দুর্বল।
কাজেই ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করে ফেলতে চলেছে বলে রব তোলা ভিত্তিহীন। সেই কল্পিত অস্ত্র শত্রু দেশের উপর প্রয়োগের ক্ষমতা অর্জনও কয়েক যুগের আগে সম্ভব নয়। এর পরেও আমেরিকা ও তাদের মিত্র ইজরায়েলের যে আস্ফালন দেখছি, তা তাদের অভ্যস্ত চোখ রাঙিয়ে পৃথিবী শাসনের শর্ত। |
|
|
|
|
|