প্রবন্ধ ১...
আমরা সকলেই একদিন যে মিছিলে হেঁটেছিলাম,
তার বুকে ক্ষত ছিল, কিন্তু ক্ষতস্থানে রং ছিল না

“ওরা এসে আমার ভাল করতে চাইলে
ঘর ছেড়ে এগিয়ে যাই
ওরা কেটে নেয় আমার ডান হাতখানা...”


দুঃস্বপ্নের’ সঙ্গে আমরা ঘর করছি বহুদিন। রোজ না হলেও প্রায়শই সে এসে দাঁড়ায় আমার-আমাদের বাসার সামনে ভোরের নরম আলোয় সদ্য ছাপা টাটকা খবর হয়ে, খুব শান্ত-নিরীহ মুখে ‘দুঃস্বপ্ন’ আমাদের সোফায় ব্রেকফাস্ট টেবিলে, খাটের পাশে, ধোঁওয়া ওঠা চায়ের কাপের খুব কাছ ঘেঁষে ঘোলাটে চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমরাও নানা রকম ছল করি, ভান করি, যেন তাকে চিনি না। চিনতে পারলেও এমন ভান করি যেন ‘ও’ আমাকে ভয় দেখাতে আসেনি, যেন ‘ভয়’ পাওয়ার মতো কোনও কারণ ঘটেনি আমার। ‘ভয়’ তো পাবে ‘ওরা’ যারা ‘নন্দীগ্রাম’ না ‘নেতাই’, কোথায় যেন সব থাকত, ভয় তো পাবে ‘ওরা’, যারা কত হিমরাত পার হয়ে মাটির নীচে কঙ্কাল হয়ে গেল। এমনকী ‘ডি এন এ’ পরীক্ষায় পাশ করা কঙ্কালরাও ফের ভয় পেতে পারে, ভয়ে তাদের ‘হাড়ে-হাড়ে’ ঠোকাঠুকি লাগতে পারে, যখন অভিযুক্ত ‘মাননীয়’ সুশান্ত ঘোষ ‘লাল গোলাপ’-এর সুগন্ধ মেখে ‘সর্বহারা’দের মাঝে হাসিমুখে বেরিয়ে আসেন। ‘জেল-ফেরত’ ওই ‘সম্পদ’কে কাছে পেয়ে সি পি আই(এম) নেতৃত্বের গর্বিত হাসিমুখ দেখে ‘ওরা’ ভয় পেলেও আমরা পাব না, এমন একটা কঠিন প্রতিজ্ঞা মনে মনে জপতে-জপতে বেলা গড়ায়, তার পর কলকাতায় সন্ধ্যা নামলে হঠাৎই টের পাই কখন আমার অজান্তে আমার ডান হাতখানা খসে পড়েছে।
“এরা এসে আমার ভাল করতে চাইলে
মাঠ ছেড়ে এগিয়ে যাই
এরা কেটে নেয় আমার বাঁ হাতখানা...”

‘দুঃস্বপ্নের’ প্রকোপ বাড়তে থাকে, তার ঠান্ডা চাহনি আমি দেখেও দেখি না। আমার ঘরের দেওয়াল এখনও শুকনো, কোনও রক্তদাগ লাগেনি, সুতরাং আমি নির্ভয়। ‘ভয়’ পাবে ওই নারী, যে পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষিতা হল ‘ভয়’ পাওয়ার দায় তার, কারণ সম্ভবত ভেবেছিল সে, মূর্খের মতো, যে, সে ‘স্বাধীন’। সুতরাং ‘মাননীয়া’ মুখ্যমন্ত্রীর যদি মনে হয়, এ আসলে ‘তৃণমূলের’ বিরুদ্ধে, ‘সরকারের’ বিরুদ্ধে এক হীন চক্রান্ত, তা হলেও ‘আমি-আমরা’ ভয় পাব না, মনে করব না আমাদের হৃদয়ে কোনও সামান্যতম ক্ষত সৃষ্টি হল। প্রয়োজন হলে ক্ষতস্থানে রঙের প্রলেপ দেব আমার উঠোনে পড়ে নেই কোনও দুর্দশাগ্রস্ত কৃষকের ঠান্ডা নিথর দেহ, অথবা ‘প্রদীপ তা’ আর ‘কমল গায়েন’-এর রক্তাক্ত শরীর, সুতরাং ভয় পাক ‘দেওয়ানদিঘি’-র সাধারণ মানুষ ‘আমি-আমরা’ ভয় পাব না। আমরা খুঁজতে চাইব মৃতদের ইতিহাস, না হলে অন্তত ‘চুপ’ করে থাকব, যখন ‘মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী’ দাবি করবেন এই হত্যাকাণ্ড ‘তৃণমূলের কর্মীরা’ করেনি এটা সি পি আই(এম)-এর গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফল অবশ্যই ‘আমি-আমরা’ চুপ করে থাকব, কারণ আমরা ‘ভীত’ নই, আমার হৃদয়ে নেই কোনও ক্ষত। প্রয়োজন হলে ক্ষতস্থানে লাগাব রং, সংলাপ কিংবা ছন্দের প্রলেপ...
প্রতিবাদ। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে তদানীন্তন বাম শাসকের তৎপরতার বিরুদ্ধে মিছিল। কলকাতা, ২০০৭
তবুও মাঝরাতে খুব নিঃশব্দে খসে পড়ে আমার বাঁ হাতখানা। ‘দুঃস্বপ্ন’ এখন আমার বড় বেশি নাগালে, এতটাই যে, আমি তার ঘ্রাণ পাচ্ছি। সেই নোনা গন্ধ আমাকে ‘টান মারে গূঢ় অন্ধকারে’...‘মধ্য রাত্রির বন্ধ দ্বার’ খুলে যেতে দেখি কাশীপুর-বরানগর মরিচঝাঁপি, সাঁইবাড়ি, বিজন সেতু, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, লালগড় সংহার-মিছিল চলছেই, চলতেই থাকছে। ক্ষমতার শীর্ষে বসে থাকা সব বিখ্যাত মানুষ কখনও প্রয়াত সিদ্ধার্থশংকর রায় বা জ্যোতি বসু, কিংবা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অথবা বর্তমান মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনও না কোনও সময়ে কী অদ্ভুত ভাবে একই রকম কণ্ঠস্বরে কথা বলেছেন বা বলছেন তবু কী আশ্চর্য, ‘আমরা’ সব বুঝেও সব জেনেও ‘আমরা-ওরা’ হয়ে গেলাম। বামফ্রন্টের বিরোধিতায় ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ় যে নাগরিক মিছিল এক দিন কলকাতা শহরকে চমকে দিয়েছিল, স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সেই মিছিলের তো চলমান থাকারই কথা ছিল। সেই মিছিল ছিল অন্যায়-এর বিপক্ষে। সেই মিছিলের পুরোভাগে থাকা, সাহস জোগানো মুখগুলোর তো দায়বদ্ধতা ছিল নিপীড়িত যে-কোনও মানুষের কাঁধে ভরসার হাতটা রাখার! আমরা কী করে এত সহজে বিশ্বাস করলাম ‘পাড়ায় পাড়ায়’ রবীন্দ্রসংগীত বেজে উঠলেই রাজনৈতিক দলগুলি অমনি অহিংস হয়ে উঠবে।
সি পি আই(এম)-এর রাজনৈতিক পরাজয়ে পশ্চিমবাংলায় খুলে গেছে এক দারুণ সম্ভাবনা, এসেছে সু-বাতাস, কিন্তু সচেতন নাগরিক সমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশের অলৌকিক নৈঃশব্দ্য আবারও ফিরিয়ে আনতে পারে সেই দম বন্ধ করা পরিবেশ। পশ্চিমবাংলায় আমরা যারা ‘পরিবর্তন’ চেয়ে নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিলাম, মনে করে দেখুন, ক্ষমতায় থাকা তখনকার সি পি আই(এম)-এর চেহারা কী আস্ফালন, কী কুৎসিত আচরণ, কী পরিমাণ ঔদ্ধত্য। আজকে তাঁদের মুখে ‘নরম-নরম’ কথা, কথায়-কথায় শুদ্ধিকরণের ডাক শুনলে শিশুও হেসে ফেলে। স্পষ্টতই বোঝা যায় ‘ক্ষমতাচ্যুত’ না হলে এঁদের ব্যবহার কোনও ভাবেই বদলাত না। ক্ষমতার পালাবদলে তাঁদের ভাষা, ভঙ্গি, আচরণ খুব দ্রুত আয়ত্ত করছেন বর্তমান শাসককুল। যে শহর গোটা ভারতের কাছে নানান সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য শ্রদ্ধা-ভালবাসা পায়, সেই শহরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য বিভাগের ছেলেমেয়েরা কী পরিমাণ অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন! তাঁদের অপরাধ কি এই যে, তাঁরা ‘থিয়েটার’কে ভালবেসে পড়াশোনা করতে এসেছেন? ‘উপযুক্ত কাঠামো’ দিতে না-পারা আগের শাসক দল ছাত্রছাত্রীদের দাবিয়ে রাখার জন্য ব্যবহার করত তাদের ‘ছাত্র সংগঠন’কে (এস এফ আই), এখন সেই একই মহান দায়িত্ব পালন করছেন ‘তৃণমূল ছাত্র সংগঠন’ সেই হুমকি, সেই মারধর, সেই কুৎসিত ভাষা। ‘রবীন্দ্রনাথ’ ও ‘হেরিটেজ’ নিয়ে যাঁরা প্রবল চিন্তিত, ছাত্রছাত্রীদের উপযুক্ত পরিকাঠামো দিতে যাঁরা ব্যর্থ, তাঁদের নাকের ডগায় বসে চলছে নানারকম দৌরাত্ম্য, যার এক ঝলক আমরা দেখলাম টেলিভিশনের পর্দায়, রবীন্দ্রভারতীর ‘মরকতকুঞ্জ’ ক্যাম্পাসে ইউনিয়ন রুমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবির সামনে তৃণমূল ছাত্র সংগঠনের কিছু ছাত্রের অভব্য উল্লাস এ সব নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলা অথবা এ সবের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ করা মানেই নতুন সরকারে বিপক্ষে ‘চক্রান্ত’? কৃষকের আত্মহত্যা, শিশুমৃত্যু, এক শ্রেণির নেতৃবর্গের ছত্রছায়ায় ফুলে-ফেঁপে ওঠা সিন্ডিকেট রাজ, স্কুল-কলেজে বিপক্ষকে যেনতেন ভাবে হয়রান করা এই সব কিছু দেখেও চুপ করে থাকলেই কি প্রমাণ করা যাবে যে ‘আমরা ভাল আছি’?
বাণভট্টের ‘কাদম্বরী’ গ্রন্থে সম্রাট হর্ষবর্ধনের প্রচুর প্রশস্তি আছে, কিন্তু তাঁর রচনাভঙ্গির মধ্যেই আছে এক অদ্ভুত কৌতুক, যে কৌতুক এক অমোঘ সাবধানবাণী হয়ে ‘রাজশক্তি’কে সতর্ক করে ‘শুকনাসোপদেশ’ পর্বে তরুণ রাজাকে মন্ত্রী ‘শুকনাস’ সতর্ক করে দিয়েছেন সেই সব ধূর্ত চাটুকারদের সম্পর্কে, যারা রাজাকে অমানুষোচিত স্তুতি করে, আর রাজার দোষগুলিকেই মহৎ গুণ বলে বর্ণনা করে এবং ওই দোষগুলোকে প্ররোচনা দেয়। সর্বকালে এই চলে আসছে, আজও। এখনও কি সতর্ক হওয়ার সময় হয়নি? এখনও কি ঢেকে রাখব ক্ষতস্থান?
অথচ আমরা সকলেই একদিন একসঙ্গে, হাতে হাত রেখে মিছিলে হেঁটেছিলাম। সেই মিছিলের বুকে ক্ষত ছিল, কিন্তু ক্ষতস্থানে রং ছিল না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.