রানিকে হারিয়ে মনমরা হলেও কর্তব্যে অবিচল ‘রাজা’। তাঁর উপরেই যে তিনটি গ্রামের ভার। পথ, বিদ্যুৎ এবং ডাক্তারহীন গ্রাম তিনটির অসুস্থ মানুষজন রাতবিরেতে রাজার সৌজন্যেই পৌঁছতে পারেন দুরের হাসপাতালে। বলতে গেলে ‘জীবন্ত অ্যাম্বুলেন্স’ তিনি।
তাই দরিদ্র তিন গ্রামের ছোটবড়ো সকলেরই নয়নের মণি এই রাজা।
এই ‘রাজা’ কিন্তু মানুষ নন। চারপেয়ে ক্ষয়াখর্বুটে বংশগর্বে কৌলীন্যহীন এক খচ্চর। শহরের লোক যতই নাক সিঁটকোন, গুয়াহাটির উপান্তে আমসাং জঙ্গল ঘেঁষা জনপদে এই রাজা কিন্তু জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ‘মেট্রো’ শহর গুয়াহাটির কোল ঘেঁষেই আমসাং অভয়ারণ্য। সেই অরণ্যের বুক চিরে সারি সারি পাহাড়। তেমনই এক পাহাড়ের চড়াই ভেঙে সাড়ে সাত কিলোমিটার উপরে উঠলে সামপাথার গ্রাম। সামপাথারের পাশেই কিলিং হপ ও সুয়ালি লুকুয়া গ্রাম।
তিনটি গ্রাম মিলিয়ে জনসংখ্যা মেরেকেটে সাড়ে তিনশো। বাসিন্দারা অধিকাংশই গারো। ভোটার তালিকায় নাম থাকলেও এবং জনপদের অবস্থান রাজধানীর কাছাকাছি হলেও সভ্য জগতের সুযোগসুবিধা কিছুই পান না গ্রামবাসীরা। বিদ্যুৎ নেই। গ্রামগুলিতে পৌঁছনোর উপায় একটি মাত্রই পাকদণ্ডী পথ। তা এমনই সরু ও বিপজ্জনক, যে সাইকেলও চালানো যায় না। বছর চারেক হল, অবহেলিত এমন জনপদেই কিন্তু তাক লাগিয়ে দিয়েছেন চারপেয়ে রাজা।
তার আগে ছবিটা কেমন ছিল? এই গ্রামগুলিতে কেউ অসুস্থ হলে প্রায় পনেরো কিলোমিটার চড়াই-উৎরাই ভাঙতে হত যেতে আসতে। রোগীকে ঘাড়ে করে পানিখাইতি অবধি নিয়ে যেতেই প্রাণান্ত। ধকল সহ্য করতে না পেরে অধিকাংশ অসুস্থ রোগী মারা যেত পথেই। শেষ পর্যন্ত তিন গ্রামের বাসিন্দারা ২০০৮ সালে একজোট হয়ে সিদ্ধান্ত নেন ঘোড়া কেনার। চাঁদা উঠেছিল ১৩ হাজার টাকা। গ্রামবাসীরা বকোর হা-হিম বাজারে যান ঘোড়া কিনতে। কিন্তু, ওই টাকায় কি আর ঘোড়া মেলে! শেষ অবধি মিলল এক খচ্চর দম্পতি। রাজা আর রানি। |
রাজা-রানির জুটি বেশিদিন টেকেনি। কিনে আনার এক মাসের মধ্যেই রানির মৃত্যু হয়। সেই থেকে তিন গ্রামে একমাত্র ‘গাড়ি’ রাজাই। ‘অ্যাম্বুল্যান্স’ও বটে। সামপাথারের গ্রামপ্রধান থিক সাংমা বলেন, “রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ১০৮ মৃত্যুঞ্জয় পরিষেবার কথা বলে দাবি করেছিলেন, রাজ্যের সর্বত্র ফোন করার আধ ঘণ্টার মধ্যেই অ্যাম্বুল্যান্স হাজির হয়ে যাবে। চার চাকার অ্যাম্বুলেন্স তো দূরের কথা, সাইকেলই ঢুকতে পারে না আমাদের গ্রামে। ভাল রাস্তাই তো নেই। আমাদের একমাত্র ভরসা রাজাই। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেই রাজা তাকে পিঠে চাপিয়ে নিয়ে যায় পানিখাইতি অবধি। সেখান থেকে হাসপাতাল। ও না থাকলে গ্রামের অনেকেই বিনা চিকিৎসায় মারা যেত।”
রাজা শুধু ‘অ্যাম্বুল্যান্স’ নয়, খুদে ‘গাড়ি’ও। পাহাড়ে ফলানো হলুদ, আদা, শাকসব্জি, লঙ্কা বা চাল পিঠে চাপিয়ে নিত্যই পাহাড়ি চড়াইপথ ভেঙে তিনি যান পানিখাইতি অবধি। কখনও কখনও ১২০ কেজি বোঝাও চাপানো হয় তাঁর পিঠে। পাহাড় বেয়ে রাজার বিনা প্রতিবাদে বিশ কিলোমিটার আসা-যাওয়ার সূত্রেই তিন গ্রামের মানুষের পকেটে খানিক টাকা আসে। সেই টাকায় কিছুদিন হল একটি স্কুল গড়েছেন গ্রামবাসীরা। সরকার সম্পর্কে ক্ষোভ উগরে দিলেও রাজার প্রশংসায় পঞ্চমুখ অবহেলিত এই জনপদের সবাই।
অবহেলার কথা তুলতেই আমসাং অভয়ারণ্যের অশোককুমার দাস পাল্টা যুক্তি দেন, “সরকার ওদের সাহায্য কেনই বা করবে?সরকারের চোখে ওরা তো জবরদখলকারী।” রাজা অতশত বোঝেন না। তবে জানেন, আশপাশের সাড়ে তিনশো দু-পেয়ে সঙ্গী তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে। সাদা-বাদামি, ফুট পাঁচেক উচ্চতার রাজা গ্রামের কচিকাঁচাদের অল্প আদরেই তুষ্ট। রাতটুকু জিরেন। সকাল হতেই ফসল বা রোগী পিঠে চাপিয়ে ফের চড়াই ভাঙা। ঝাঁকড়া কেশরে আটকে থাকে বুনো ফুল আর ধুলোর প্রসাধন। |