প্রবন্ধ ২...
দয়া করে নিজেদের সামলান
প্রথমে চলচ্চিত্রের কাল্পনিক জগতে প্রবেশ করা যাক। ১৪ অক্টোবর ১৯৮৮ মুক্তি পায় জোনাথন কাপলান-এর সিনেমা ‘দি অ্যাকিউজড’। শ্রমিকশ্রেণির মেয়ে সারা টোবিয়াস স্থানীয় বারে গিয়ে প্রচুর মদ্যপানের পর তিনটি মদ্যপ পুরুষের শিকার হয়। পিনবল খেলার টেবিলের ওপরে তাকে সেই মদ্যপরা পর পর ধর্ষণ করে, তাদের উৎসাহ দিতে থাকে আরও মদ্যপ দর্শক। ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি ক্যাথারিন মার্ফি দেখেন সেই সন্ধ্যায় সারা’র হাবেভাবে এমন সাক্ষ্য প্রচুর যে, ‘শি ইনভাইটেড ইট’ (সাধ করে ধর্ষণ ডেকে এনেছে)। তাঁরও প্রথমে মনে হয়েছিল যে, সারা’র ওপর অন্যায় করা হলেও সে দিনের প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য পাওয়া মুশকিল হবে। আর প্রত্যক্ষদর্শী না পাওয়া গেলে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে মামলা সাজানো কঠিন, বিশেষত সেই মামলা যখন জুরি পর্যন্ত যাবে। সারা মদ্যপ ছিল, ড্রাগ নেয়, গা-দেখানো পোশাকে বারে গিয়ে মদ খাচ্ছিল। মার্কিন দেশে জুরির বিচার আছে, তাই রায় দেওয়ার সময় বহু ক্ষেত্রে চলতি ভাবনাই প্রাধান্য পায়। তাই সারা’র প্রতি অন্যায় হয়েছে, এটা প্রমাণ করা তাঁর পক্ষে অসুবিধে হবে। তবু তাঁর প্রশ্ন, সারা’র আচরণ যা-ই হয়ে থাকুক, তাঁকে কারও শারীরিক ভাবে আঘাত বা ধর্ষণ করার অধিকার জন্মায় কি? বিচার কি সবার জন্য এক রকম নয়? তথাকথিত সামাজিক লক্ষ্মণরেখা না মানলে বিচার পালটে যাবে? সম্প্রতি পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের অভিযোগকারিণীও যেন সারা টোবিয়াস-এর মতোই অভিযুক্ত। ‘দি অ্যাকিউজড’। ভদ্রলোকদের ফাঁসানোর জন্য তিনি সব কিছু করেছেন, ধর্ষিতাও হয়েছেন!
৬ মার্চ, ১৯৮৩, ম্যাসাচুসেটস্-এর বিগ ড্যান’স বারে গণধর্ষণের শিকার হন চেরিল আরোউজো। ‘দি অ্যাকিউজড’ সেই ঘটনার ছায়ায় নির্মিত। এই ছবি প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়, সারা টোবিয়াস-এর ভূমিকায় জোডি ফস্টার পান অ্যাকাডেমি আর গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার। আর জন্ম হয় তুমুল বিতর্কের, সুবিচার মানে কী? যৌনমুক্তির দেশের অভিধা পাওয়া পশ্চিমে ১৯৮৮ সালে বিতর্ক উঠেছিল, কোনও মেয়ে নেশা করলেই কি পুরুষের তাকে নিগ্রহের অধিকার জন্মায়? তা হলে এই রাজ্যে, ২০১২ সালে পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-কাণ্ডে অভিযোগকারিণীকে যে অবমাননার মধ্য দিয়ে হাঁটতে হয়েছে, তাকে আর বিচিত্র লাগে না। জীবন ও চলচ্চিত্র এই ভাবেই জড়িয়ে যায়, এক দেশ থেকে আর এক দেশের সমাজে।
বেসামাল। আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ডে অভিযুক্ত দু’জনকে। ছবি: পি টি আই
পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-কাণ্ডে, চলতি ভাবনার নিরিখে, সমস্ত ঘটনা অভিযোগকারিণীর বিরুদ্ধে ছিল। তিনি শাড়ি-পরিহিতা গৃহবধূটি নন, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, আট বোতল বিয়ার খেয়ে আউট, নাবালিকা দুই মেয়ে থাকলেও নাইট ক্লাবে গিয়ে রাত করে ফেরেন, তার পর আবার সবে-চেনা পুরুষ-সঙ্গীদের গাড়িতে লিফ্ট নিচ্ছেন, স্বামীর সঙ্গে থাকেন না অতএব তাঁর শরীর-সত্তা সব কিছু দখলের অধিকার অন্যদের আছে। তার ওপর ধর্ষণের ঘটনার পর পরই তিনি অভিযোগ দায়ের করেননি, পোশাক ধুয়ে ফেলেছিলেন, ভুল লোকেদের, যারা নাম ভাঁড়িয়ে এসেছিল, তাদের আসল অপরাধী বলে চিহ্নিত করেছেন, প্রকাশ্যে বলছেন নেশাগ্রস্ত ছিলেন। তাই তাঁর কথন ঘিরে নানা বুনন, তিনি টাকা খেয়ে সাজানো অভিযোগ করছেন, অভিযুক্তদের সঙ্গে তাঁর পুরনো শত্রুতা আছে, বাবার মতো তিনিও জালিয়াত, আরও কত কী! এক কথায়, ভদ্রলোকদের ফাঁসানোর একটি গভীর চক্রান্তে তিনি নিমজ্জিত। তাই তাঁকে ঠিক ভদ্রমহিলা বলা যায় না। পুলিশের একাংশের প্রধান বক্তব্যই হয়ে ওঠে, তাঁর বয়ানের অসঙ্গতি।
যে যে চিহ্ন থাকলে পাবলিকের ‘সহানুভূতি’ পেতে পারতেন এই ঘটনার অভিযোগকারিণী, সে সব কিছুই তাঁর নেই। আছে এক তথাকথিত লক্ষ্মণরেখা পেরোনো জীবনযাপনের আবহ। তাই দেশের মুখ্যমন্ত্রী, বিরোধী নেত্রী থাকার সময়, ১৯৯২ সালে ফুলিয়ার এক মূক-বধির ধর্ষিতাকে নিয়ে বিচারের জন্য সে সময়ের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর চেম্বার-এর সামনে অবস্থানে বসলেও, আজ ক্ষমতার অলিন্দে পৌঁছে বলে দেন, ঘটনাটি সাজানো, সরকারকে কালি মাখানোর জন্য। আবার ১৯৯৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের সময় চম্পলা সর্দার নামে এক তৃণমূল প্রার্থী সি পি আই এম সদস্যদের হাতে ধর্ষিতা হয়েছেন দাবি করার পর ২০০৩ সালে যখন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে আদালত বেকসুর ছাড় দেয়, সারা রাজ্য জুড়ে তৎকালীন শাসক দলের পোস্টারে দেখেছি অশ্লীল আস্ফালন। সেই ইতিহাস ভুলতে পারি না বলেই আজ, ক্ষমতার অলিন্দে পৌঁছনো নতুন মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে সংবেদনশীলতার সম্পূর্ণ অভাব লজ্জা নয় ক্ষোভের জন্ম দেয়। সেই মেয়েরা লক্ষ্মণরেখা পেরোননি বলে কি তাঁদের জন্য নেত্রীর স্নেহচ্ছায় ছিল? তাঁর মন্ত্রীরাও যেন একটু নিজেদের সামলান লক্ষ্মণরেখা কেন পেরিয়েছে কোনও মেয়ে, সেই প্রশ্ন তোলার আগে। অন্তত তদন্তটা শেষ করতে দিন!
সাহস থেকে সাহস মেয়েরা মোটামুটি ধর্মবর্ণনির্বিশেষে জন্ম থেকেই লক্ষ্মণরেখা চিনতে শিখি। আমাদের শেখানো হয়, যে মেয়ে সেই রেখা পেরোবে, তাকে শাস্তি দেওয়া যেতেই পারে। তাই বাপু, পেরিয়ো না লক্ষ্মণভাইয়ের টানা রেখা, যা কিনা আমাদের সুরক্ষার জন্যই। এই মেয়ে অনেক ভাবে সেই সীমানা পেরিয়েছেন, তাই তাঁকে শাস্তি দিতে, ‘সবক’ শেখাতে অনেকেই আগ্রহী। সরাসরি আগ্রহ না দেখালেও, অন্য কেউ ‘শেখালে’, মনে মনে বলছেন ‘বেশ হয়েছে’! পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ডে অভিযোগকারিণী পদে পদে সেই ‘বেশ হয়েছে’ ভাবনার শিকার হয়েছেন। তাই তাঁর এগিয়ে এসে অভিযোগ জানানোর সাহস আমাদের অনেককে সাহস দিচ্ছে। আমরা জোর গলায় বলছি, আমাদের ‘মঙ্গলের জন্য’ কোনও লক্ষ্মণরেখা না টানলেও চলবে। আমরা একটা ধাপ যাচ্ছি বলে পরেরটাও যেতে রাজি কি না, দেখে নিন প্লিজ। আমরা মদ খেয়েছি, সিগারেট ধরিয়েছি, নাচছি, মাতলামো করছি, গায়ের আঁচল খসে পড়ছে, তবু আপনার হাতটা সামলে রাখবেন এর পর। নইলে দিনকাল পাল্টাচ্ছে, ‘ঠাকুর’দের এই সব হাতও কাটা পড়তে পারে। আর লজ্জায় মাথা কাটা পড়তে পারে সরকারি ‘বিশিষ্ট’দের।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.