প্রবন্ধ ১...
শ্রীরামকৃষ্ণ মন-মুখ এক করার কথাই বলেছেন
৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকা থেকে সতীর্থ স্বামী শিবানন্দকে একটি চিঠিতে গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে লিখছেন, ‘আমি তাঁর জন্মজন্মান্তরের দাসএই আমার পরম ভাগ্য। তাঁর একটা কথা বেদ-বেদান্ত অপেক্ষা অনেক বড়।’ গুরুভাইদের স্বামীজি অকপটে জানান, ‘এ জন্ম এ শরীর সেই “মূর্খ” বামুন কিনে নিয়েছেন।...তিনি যে তাঁর কার্যভার আমার স্কন্ধে নিক্ষেপ করে গেছেন। তা যে পর্যন্ত না সমাপ্ত করতে পারি, সে পর্যন্ত তিনি তো বিশ্রাম করতে দেবেন না।’
নরেন্দ্রনাথকে দেখিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন: ‘তুই আমি কি আলাদা? এটাও আমি, ওটাও আমি।’ বস্তুত রামকৃষ্ণ যন্ত্র, বিবেকানন্দ যন্ত্রী। রামকৃষ্ণ ভাষা, বিবেকানন্দ ভাষ্য। রামকৃষ্ণ ভাব, বিবেকানন্দ আন্দোলন। বিবেকানন্দের তীব্র-তীক্ষ্ন অনুভব‘আমি দেহহীন এক কণ্ঠস্বর’ (voice without a form)। এই কণ্ঠস্বরও শ্রীরামকৃষ্ণেরএকই সঙ্গে সেই কণ্ঠস্বর শাশ্বত ভারতবর্ষের। সে ভারত দরিদ্র, অজ্ঞতায় পূর্ণ, কাতর কিন্তু প্রজ্ঞাসম্পদে ধনী, ঐতিহ্যে প্রাচীন, বহমানতায় সজীব, নবীন। এখানেই ভারত সুমহান। কোটি কোটি ভারতবাসীর ঐতিহ্যমণ্ডিত ভারতবর্ষের দু’হাজার বছরের সাধনার ঘনীভূত রূপ তিনিই (শ্রীরামকৃষ্ণ)রম্যাঁ রলা সমগ্র বিশ্বকে জানান সে কথা। রবীন্দ্রনাথের ‘বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা’র মিলিত রূপের concept রল্যাঁর ভাবনা থেকেই সঞ্জাত। ম্যাক্সমুলারের ‘প্রকৃত মহাত্মা,’ অল্ডাস হাক্সলি বা ক্রিস্টোফার ইশারউডের ফিনোমেন্যান ‘তিনিই’রামকৃষ্ণ পরমহংস।
আজ শ্রীরামকৃষ্ণের ১৭৭তম জন্মতিথি
শ্রীরামকৃষ্ণ অনন্ত ভাবময়। সেই ভাবের পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ নিরূপণ সম্ভবপর নয়। পাশ্চাত্য থেকে প্রথম বার ফেরার পর (১৮৯৭) রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা, মানবসেবা যজ্ঞে সন্ন্যাসীদের অংশগ্রহণ, স্কুল-হাসপাতাল স্থাপনা ও পরিচালনা, আর্ত-পীড়িতদের মধ্যে ত্রাণকাজ--এ সবের যৌক্তিকতায় সংশয় প্রকাশ করেছিলেন স্বামী যোগানন্দ। তাঁর মনে হয়েছিল, এগুলি ঠাকুরের (শ্রীরামকৃষ্ণের) কাজ নয়। তাঁর সেই সংশয় কাটাতে বিবেকানন্দের উত্তর ছিল-- ‘তুই কী করে জানলি, এ সব ঠাকুরের ভাব (কাজ) নয়? অনন্ত ভাবময় ঠাকুরকে (শ্রীরামকৃষ্ণ) তোরা তোদের গণ্ডিতে বদ্ধ করে রাখতে চাস? ত্রিজগতের লোককে তাঁর (শ্রীরামকৃষ্ণের) ভাব দিতেই আমাদের জন্ম...তিনি পেছনে দাঁড়িয়ে সব কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। তিনি অনন্ত ভাবময়। ব্রহ্মজ্ঞানের ইয়ত্তা যদিও হয় তো, প্রভুর অগম্য ভাবের ইয়ত্তা নেই। তাঁর কৃপাকটাক্ষে লাখো বিবেকানন্দ এখনই তৈরি হতে পারে।’
এ বিনয় নয়। গুরুদেবের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশও নয়। বাস্তবকে স্বীকার। সেই স্বীকারোক্তি ধরা পড়ে শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে কথোপকথনে, ‘তাঁর (শ্রীরামকৃষ্ণের) ভাবসমুদ্রের উচ্ছ্বাসের এক বিন্দু ধারণা করতে পারলে মানুষ তখনই দেবতা হয়ে যায়। সর্বভাবের এমন সমন্বয় জগতের ইতিহাসে আর কোথাও কি খুঁজে পাওয়া যায়? এ থেকেই বোঝতিনি কী দেহ ধরে এসেছিলেন! অবতার বললে তাঁকে ছোট করা হয়।’
শ্রীরামকৃষ্ণ মানুষের জন্য আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁর বিশেষ আকাঙ্ক্ষা ‘প্রকৃত’ মানুষের জন্য। সেই মানুষ তাঁর আপন মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হোক ‘মান’ আর ‘হুঁশ’ নিয়ে। মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়, মানুষ হয়ে উঠতে হয়। জন্মালেই এটা সম্ভবপর নয়। পাশব প্রবৃত্তির অপসারণে দেবত্বে উত্তীর্ণ হওয়াএ মানুষই পারে। তাই মানুষেই আস্থা শ্রীরামকৃষ্ণের। আত্মচৈতন্যে ভর দিয়েই অমৃতত্বের সন্ধানে তার এগিয়ে যাওয়াঅতঃপর অমৃতস্বরূপ হয়ে ওঠা। এই স্বরূপকে নিজের মধ্যে খুঁজতে হবে, বুঝতে হবে, প্রকাশ করতে হবে। আবার তেমনই, অন্য সকলের মধ্যেও সামাজিক অবস্থানে, সমদৃষ্টিতে অনড় থাকতে হবে। বেদান্ত দর্শনের মূল কথা এটাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্ম প্রচার করেননি, কোনও স্বতন্ত্র ধর্মগোষ্ঠী গড়েননি, বরং যা নিত্য, যা সত্যসর্বকালীন-সর্বজনীন একাধারে মনননিষ্ঠ এবং প্রাণে-প্রাণে অনুভবে সহজ-সরলসে দিকেই ছিল তাঁর অমেয় দৃষ্টিপাত। সকলকে এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ করা। শ্রীরামকৃষ্ণ জানতেন খালি পেটে ধর্ম হয় না। আবার, ভরা পেটেও আত্মসুখী-আত্মপর হয়ে ওঠে মানুষ। এই আত্মপরতন্ত্রতার ঘোর বিরোধিতা করেছেন তিনি। বিবেকানন্দ যখন নিজের কথা ভেবে শুকদেবের মতো নির্বিকল্প সমাধিতে ডুবে থাকতে চেয়েছিলেন, শ্রীরামকৃষ্ণের ধিক্কার ঝরে পড়েছিলকারণ, বহু মানুষের জন্য নরেন্দ্রনাথ জীবন উৎসর্গ করবেসেটিই ছিল শ্রীরামকৃষ্ণের ঈপ্সিত। ঈশ্বর লাভ তো সম্ভব মানুষের মধ্যেই। মানুষকে বাদ দিয়ে নয়। শ্রীরামকৃষ্ণের নামে যে সন্ন্যাসী সঙ্ঘ গড়ে উঠতে যাচ্ছিল, তার লক্ষ্য তিনি নিজেই নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। তাই বিবেকানন্দ বলেছেন যে, গেরুয়া ভোগের নয়ত্যাগের প্রতীক। আত্মপরতার নয়পরহিতের। সন্ন্যাসী, শিষ্য অনুরাগীদের বলেছেন, ‘পরহিতায় পরসুখায়’ জীবন বিসর্জন দিতে। একটা গোটা জীবন।
ত্যাগে-প্রেমে-ভালবাসায় শ্রীরামকৃষ্ণ অতুলনীয়। গলরোগে আক্রান্ত হয়ে অশক্ত শরীরে দুঃসহ যন্ত্রণা উপেক্ষা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষের কল্যাণে নানা প্রসঙ্গ যখন তিনি আলোচনা করছেন, তখন দেহের কথা স্মরণ করিয়ে কেউ বাধা দিলেই বলে উঠেছেন ‘দেহের কষ্ট!...যদি একজন লোকের (এতে) যথাযথ উপকার হয়, সে জন্য আমি হাজার হাজার দেহ দিতে প্রস্তুত আছি। আমি বার বার জন্মাতে রাজি আছি, এমনকী কুকুর হয়ে জন্মাতেও রাজিযদি তাতে একজন লোকেরও উপকার হয়, সাহায্য হয়।’ এই কথারই প্রতিধ্বনি আমরা শুনি বিবেকানন্দের কণ্ঠে, ‘আমায় যদি হাজারো জন্ম নিতে হয়, তাও নেবো। তাতে যদি কারো এতটুকু দুঃখ দূর হয়, তা করবো।’
সমাজে মানুষের মধ্যে যত বেশি ঈর্ষা, অহঙ্কার, অভিমান, সঙ্কীর্ণতা, যুদ্ধ-সংঘাত, হিংস্রতাততই বেশি সারশূন্যতা, পতন, পরাজয়, বিদূষণ। তাই, রামকৃষ্ণের নিদান অভেদভাব, জ্ঞানলাভসেই অনুভবে সহাবস্থানসহধর্মিতা-সহযোগিতা। সত্য কলির তপস্যা ও সিদ্ধি। সত্যকে ছাড়া চলবে না। শ্রীরামকৃষ্ণ প্রবল ভাবেই সত্যাশ্রয়ী, সত্যানুরাগী, সত্যানুসন্ধানী। মন-মুখ এক করার মধ্যেই এই ‘সত্য’-র স্বতোচ্ছল উদযাপন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.