|
|
|
|
বাবা নেই, খবর পেতেই ফোন ছুড়ে ফেলেন পৃথা |
রানা সেনগুপ্ত • বর্ধমান |
দেওয়ানদিঘি মোড়ের কাছে হাল্কা নীল রঙের তিন তলা বাড়িটা দুপুর থেকেই তালাবন্ধ। সাংবাদিকেরা হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন চিত্রলেখা তা ও তাঁর মেয়ে পৃথাকে।
কোথায় গেলেন নিহত প্রদীপ তা-এর স্ত্রী ও মেয়ে?
অনেক চেষ্টার পরে দু’জনের খোঁজ মিলল সিপিএমের জেলা সম্পাদক অমল হালদারের কাছে। যিনি জানালেন, মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত মা-মেয়েকে আনা হয়েছে বর্ধমান শহরে জেলা সিপিএমের কার্যালয়ে। সেখানেই বসে তখন সিপিএম নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে নিজের দাদা ও কমলবাবুর খুনের এফআইআরের খসড়া করতে ব্যস্ত প্রদীপবাবুর ভাই প্রবীর তা। তাঁর কাছে এগোনোর চেষ্টা করতেই বাধা এল সিপিএম নেতাদের কাছ থেকে। কড়া সুরে তাঁরা বললেন, “উঁহু। এখন ওঁকে একদমই বিরক্ত করা যাবে না।” |
|
তখনও বেঁচে। হাসপাতালে সিপিএম নেতা কমল গায়েন। —নিজস্ব চিত্র |
পরে কথা বলা গেল চিত্রলেখাদেবী ও পৃথার সঙ্গে। নিহত নেতার স্ত্রী-র অভিযোগ, “বিধানসভা ভোটে ওই কেন্দ্রে সিপিএম জিতেছে ঠিকই। কিন্তু তার পর থেকে ওদের (তৃণমূল) আক্রমণ প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছিল। প্রায়ই আমাদের বাড়িতে ইট-পাটকেল মারা হত। বাড়ির গেটে দিনভর বসে থাকত তৃণমূলের লোকেরা। ওদের হাতে হেনস্থার ভয়ে মাঝেমধ্যেই আমি বাড়ির বাইরে বের হতাম না। কিন্তু আমার স্বামীকে কখনওই এ সবে ভয় পেতে দেখিনি।” গত বছর বিধানসভা ভোটের অব্যবহিত পরেই প্রদীপবাবুকে নিগ্রহ করা হয় স্থানীয় একটি কারখানার গেটে। কিন্তু এই শ্রমিক নেতা তাতে দমে যাননি।
বুধবার সকাল ৭টা নাগাদ প্রদীপবাবু বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। মাঝে এক বার বাড়ি ফেরেন। কিছু পরে ফের বেরোন। গলসি গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা চিত্রলেখাদেবীর কথায়, “গণ্ডগোলের খবর পাচ্ছিলাম। বেলার দিকে বাড়ির সামনে অবরোধ করে একদল লোক। মেয়েকে নিয়ে বেরোতেই পারছিলাম না। ১২টা নাগাদ এক নিকটাত্মীয়ের ফোন এল পৃথার মোবাইলে।” ওই ফোনেই তাঁরা জানলেন, প্রদীপবাবু খুন হয়েছেন। শুনেই মোবাইল ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন— সিপিএমের কার্যালয়ে বসে এ কথাই জানালেন বর্ধমানের একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের এই ছাত্রী।
পৃথা বললেন, “এর পরে আমার সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনার ইচ্ছা ছিল। বাবাও তাই চাইতেন। সেটা কি আর হবে?”
ইতিমধ্যে একের পর এক সিপিএম নেত্রী এসে মা-মেয়েকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। মেমারি থেকে বিনয় কোঙারের স্ত্রী মহারানিদেবী জেলা কার্যালয়ে এসে চিত্রলেখাদেবীর পাশে বসে সমানে কাঁদছিলেন। চিত্রলেখাদেবীও বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। কালনার প্রাক্তন বিধায়ক অঞ্জু করকে পৃথার হাত ধরে ববলতে শোনা গেল, “তোমার বাবা দলের জন্য জীবন দিয়েছেন।”
তুলনায় কিছুটা শক্ত ছিলেন এ দিন আর এক নিহত সিপিএম নেতা কমল গায়েনের স্ত্রী কাকলিদেবী। তিনি বলেন, “খবর পেয়েছিলাম উনি দুষ্কৃতীদের হাতে মারাত্মক জখম হয়েছেন। ছুটতে ছুটতে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যাই। এখানে পা রেখেই খবর পেলাম, একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে গোলাপবাগের কাছে মারা গিয়েছেন তিনি।”
প্রবীণ এই সিপিএম নেতাকে নিয়মিত দেখা যেত দলের কর্মীদের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁদের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে। এ হেন নেতাকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন দলের সাধারণ কর্মী-সমর্থকেরা। তাঁদেরই এক জন, বর্ধমানের বাবুরবাগের বাসিন্দা শুক্লা সরকার কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমাদের অভিভাবক চলে গেলেন। সমস্যায় পড়লে এ বার কার কাছে যাব? উনি যে কতখানি ছিলেন এলাকার গরিব মানুষের কাছে, তা বলে বোঝানো যাবে না।” |
|
|
|
|
|