দিনের শেষে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যে রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্যদের একাংশ (ব্যাখ্যাকারী মন্ত্রীরা ছাড়া) যথেষ্ট ‘বিড়ম্বিত’। মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রীর নির্দেশেই চার মন্ত্রীর মধ্যে তিন জন মুখ খুলেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই সুব্রতবাবু তাঁর অন্য কর্মসূচি বাতিল করে তড়িঘড়ি তৃণমূল ভবনে গিয়েছিলেন বর্ধমানের ঘটনা নিয়ে পার্থবাবুর সাংবাদিক বৈঠকে থাকবেন বলে। যদিও তিনি ‘মুখ খোলেননি’। রাজ্যের এক মন্ত্রীর কথায়, “পতাকা-ফেস্টুন লাগানো নিয়ে সিপিএম-তৃণমূল বচসা থেকেই গোটা ঘটনার সূত্রপাত বলে প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই মন্ত্রীরা ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। হয়তো দলের তরফে অন্য কেউ মুখ্যমন্ত্রীকে সিপিএমের অন্তর্দ্বন্দ্ব সংক্রান্ত তথ্য দিয়ে থাকবেন। কিন্তু তিনি এখন প্রকাশ্যে মুখ না-খুললেই ভাল হত। মন্ত্রিসভার সদস্য এবং মুখ্যমন্ত্রীর এই পরস্পর বিরোধী বক্তব্যের সুযোগ বিরোধীরা নেবে।”
হয়েছেও তা-ই। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাখ্যা শোনার পরে সরকারের মধ্যে নানা কথা এবং তার সঙ্গে পুলিশের পদক্ষেপের ফারাককেই নিশানা করেছেন। বাম প্রতিনিধি দল নিয়ে ঘটনাস্থলে রওনা হওয়ার আগে বিধানসভার বাইরে সূর্যবাবু দাবি করেছিলেন, এই ঘটনায় অন্য মন্ত্রীরা নন, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকে ‘জবাবদিহি’ করতে হবে। কারণ, পুলিশ রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই এবং প্রধান শাসক দলের সর্বময় নেত্রীও তিনি।
মুখ্যমন্ত্রীর ‘জবাব’ শোনার পরে রাতে বর্ধমান থেকে ফেরার পথে সূর্যবাবুর মন্তব্য, “পার্ক স্ট্রিটের মতোই আবার একটি কাণ্ড ঘটালেন মুখ্যমন্ত্রী! মন্ত্রিসভার সদস্যেরা বলছেন এক। মুখ্যমন্ত্রী বলছেন এক। আর তাঁর পুলিশ করছে আর এক! সিপিএমের অন্তর্দ্বন্দ্ব হলে মুখ্যমন্ত্রীর পুলিশ তৃণমূলের চার জনকে গ্রেফতার করল কেন?” সূর্যবাবুর সাফ দাবি, সিপিএমের দলীয় কোন্দল তো নয়ই, ‘জনরোষ’ বা সংঘর্ষেও প্রদীপবাবুদের মৃত্যু ঘটেনি। তাঁর কথায়, “পতাকা লাগানো নিয়ে সিপিএম-তৃণমূল সমর্থকদের বচসায় আমাদের আহত সমর্থককে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে ফেরার সময় প্রদীপবাবুর উপরে হামলা হয়। এটা পরিকল্পিত, নৃশংস হত্যাকাণ্ড!”
মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর সতীর্থ মন্ত্রীদের বক্তব্যে যেমন অমিল, তেমনই শাসক জোটের শরিক কংগ্রেসের সুরও ‘ভিন্ন’। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “বর্ধমানের ঘটনায় সত্যিই আমরা উদ্বিগ্ন। এমন হত্যাকাণ্ড ঘটবে, ভাবিনি। পরিবর্তনের পর নতুন সরকারের পুলিশ-প্রশাসন কঠোর হাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবে, এটাই প্রত্যাশা ছিল।” প্রদীপবাবুর ‘আক্ষেপ’ “সিপিএমের ৩৪ বছরের রাজত্বে যে হত্যার রাজনীতি চলেছে, চেয়েছিলাম, পরিবর্তনের পরে তাতে ছেদ পড়ুক। এই খুনের ঘটনায় সেই ভাবনা হোঁচট খেল! বর্ধমানে নরহত্যার সেই ‘ট্র্যাডিশন’ চলছেই!”
তার আগে গোটা দিন রাজ্য-রাজনীতি দেখেছে, ক্ষমতার ‘পরিবর্তন’ ঘটে গেলেও রাজনীতির ভাষা ও প্রকরণের কোনও বদল ঘটেনি! রাজনীতিতে রক্তপাত অব্যাহত। অব্যাহত বিরোধীদের অভিযোগ তাদের নেতাদের ‘পরিকল্পিত’ ভাবে খুন করা হয়েছে। অব্যাহত শাসক শিবিরের দাবি, ‘গণরোষে’র শিকার নিহতেরা। বাম জমানায় যে ধরনের চাপান-উতোর অসংখ্য ঘটেছে! এখন শাসকের আসনে বসে তৃণমূল অতীতের শাসকদের ‘ভাষা’ই বলছে! বিরোধী আসনে গিয়ে সিপিএম বলছে সেই কথা, যা আগে শোনা যেত কংগ্রেস-তৃণমূলের মুখে!
গড়বেতার ছোট আঙারিয়া, বীরভূমের নানুর বা নন্দীগ্রামে ‘সূর্যোদয়’কে শাসক সিপিএম ব্যাখ্যা করেছিল ‘গণরোষ’ বলে। যখন তৃণমূল অভিযোগ করেছিল ‘গণহত্যা’র। আবার ঠিক যে ভাবে বিরোধী নেত্রী মমতা সিপিএমের হাতে নিহত কর্মী-সমর্থকদের মৃতদেহ বিভিন্ন জেলা থেকে নিয়ে আসতেন কলকাতায়, সে ভাবেই সিপিএমও প্রদীপবাবুর দেহ নিয়ে আসছে শহরের রাজপথে। এ দিন রাতেই কলকাতায় এনে বৌবাজারের একটি শব সংরক্ষণাগারে রাখা হয়েছে সেই দেহ। যা আজ, বৃহস্পতিবার সকালে নিয়ে যাওয়া হবে বিধানসভায়। যাওয়ার কথা আলিমুদ্দিন এবং লাগোয়া সিটুর রাজ্য দফতরেও। তবে বিরোধী দলের ব্যাখ্যা, নিহত প্রদীপবাবু প্রাক্তন বিধায়ক হওয়ায় রীতিমাফিক তাঁর মরদেহ বিধানসভায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু কমলবাবুর দেহ কলকাতায় আনা হয়নি।
সিপিএমের অভিযোগ, রবিবারের ব্রিগেড সমাবেশ দেখে শাসক শিবির ‘উদ্বিগ্ন’ হয়ে আক্রমণের পথ নিয়েছে। আর তৃণমূলের মহাসচিব পার্থবাবু মঙ্গলবার যে ভাবে ‘শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক ভাবে পথে নেমে’ ধর্মঘট বিরোধিতার কথা বলেছেন, তাতেই সংঘাতে ‘উস্কানি’ দেওয়া হয়েছে। সূর্যবাবুর কথায়, “তৃণমূলের মহাসচিব বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, শান্তিপূর্ণ ভাবে পথে নামবেন। তাঁদের শান্তির ভাষা যে কী, তার প্রমাণ মিলে গেল!”
মন্ত্রীরা অবশ্য তার জবাব দিয়েছেন। পার্থবাবুর কথায়, “সিপিএম মিছিলের নাম করে গ্রামে ঢুকে এলাকা দখলের চেষ্টা করছিল। গ্রামবাসীরা আতঙ্কিত হয়ে প্রতিরোধ করাতেই ওই ঘটনা ঘটেছে। তৃণমূল ওই ঘটনায় জড়িত নয়।” কিন্তু ওই ঘটনায় জড়িত অভিযোগে তো চার তৃণমূল সমর্থকই ধরা পড়েছে? পার্থবাবুর জবাব, “দোষীদের শাস্তির ব্যাপারে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। তবে তৃণমূলের চার জন গ্রেফতার হলেই তারা দোষী প্রমাণিত হয়ে যায় না! এই ঘটনায় তৃণমূলকে জড়িয়ে যে রাজনৈতিক নাটক শুরু হয়েছে, তাতে কোনও লাভ হবে না!”
তাঁর বিরুদ্ধে ‘উস্কানি’র অভিযোগ উড়িয়ে পার্থবাবু পাল্টা অভিযোগ করেন, সিপিএম-ই বরং তৃণমূল কর্মীদের উপরে হামলা চালিয়েছে। তাঁর কথায়, “ব্রিগেড সমাবেশে সিপিএম নেতারাই উস্কানিমূলক কথা বলেছেন। তার পর থেকেই সিপিএমের প্রাক্তন মন্ত্রী-নেতা-হার্মাদরা পথে নেমে পুরনো কায়দায় এলাকা দখলের চেষ্টা করছেন!” নিহত দুই সিপিএম নেতা ওই এলাকায় অশান্তির ‘পরিচিত মুখ’ ছিলেন বলেও মন্ত্রীর দাবি। তার আগে মহাকরণে আইনমন্ত্রী মলয়বাবু বলেন, দেড়শো-দু’শো মানুষের সশস্ত্র মিছিল তৃণমূলের পতাকা খুলে নিয়ে গ্রাম দখল করতে ঢোকায় হাজার পাঁচেক গ্রামবাসী তাদের ঘিরে ফেলে ‘প্রতিরোধ’ করায় এই ঘটনা। ঘটনায় পুুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী ফিরহাদের মন্তব্য, “প্রত্যেক মানুষের পিছনে পুলিশ দেওয়া তো সম্ভব নয়! পুলিশ থাকলেই যে দুর্ঘটনা ঘটবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই!”
ঘটনার কড়া নিন্দা করে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘ন্যক্কারজনক ভাবে তৃণমূল দুষ্কৃতীদের আড়াল করতে ভুয়ো সংঘর্ষের কথা প্রচার করছে’। প্রদীপবাবুর বিরুদ্ধে মামলার ‘অভিযোগ’ নিয়ে সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তী বলেন, “রাজনৈতিক লোকেদের বিরুদ্ধে এমন অনেক মামলা থাকে। আমার বিরুদ্ধেও কয়েকটা পাওয়া যাবে! তা দিয়ে কিছু প্রমাণ হয় না!” তৃণমূল ‘গ্লানি’ আড়াল করতে ‘গণরোষে’র তত্ত্ব সাজাচ্ছে বলে অভিযোগ করে শ্যামলবাবুর প্রশ্ন, “গ্রামবাসীদের হাতে অস্ত্র আসবে কী করে? আসলে রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু নেই।” সিটুর রাজ্য সম্পাদক কালী ঘোষের আশঙ্কা, এর পরে পুলিশকে দিয়ে ‘অন্য রকম ঘটনা সাজানো’ হতে পারে, সেটাও তাঁরা ধরে রেখেছেন!
শ্যামলবাবুর মন্তব্য “একনায়কতন্ত্রী, স্বৈরতন্ত্রী, ফ্যাসিবাদী আক্রমণ হচ্ছে। ’৭২ সালকেও ছাড়িয়ে যাবে মনে হচ্ছে! এ ভাবে প্রতিবাদকারীদের খুন করা হতে থাকলে প্রতিবাদ কিন্তু প্রতিরোধে উত্তীর্ণ হবে! মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ, রাজ্যের মানুষকে সে দিকে ঠেলে দেবেন না! তা না-হলে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি হবে!”
সেই ‘প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ’। যেমন ‘পরিকল্পিত হত্যা’ এবং ‘গণরোষ’। ক্ষমতাসীনের মুখ বদলে গিয়েছে বটে। ভাষা বদলায়নি। যেমন বদলাচ্ছে না রাজনৈতিক সংঘর্ষে রক্তপাতের আশঙ্কাও। |