|
|
|
|
দুই সিপিএম নেতা খুনে কাঠগড়ায় তৃণমূল |
রানা সেনগুপ্ত • বর্ধমান |
বর্ধমান শহরের উপকণ্ঠে সকাল ১০টায় সর্বসমক্ষে পিটিয়ে-থেঁতলে খুন করা হল সিপিএমের এক প্রাক্তন বিধায়ক এবং জেলা কমিটির সদস্য, ৭৩ বছরের এক বৃদ্ধকে।
এই ‘নৃশংস হত্যাকাণ্ডের’ প্রতিবাদে আজ, বৃহস্পতিবার বর্ধমানে ১২ ঘণ্টা বন্ধের ডাক দিয়েছে সিপিএম। পরীক্ষা-সহ যাবতীয় জরুরি পরিষেবাকে বন্ধের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বিবৃতি দিয়ে বুধবার এবং আজ, বৃহস্পতিবার রাজ্য জুড়ে ‘ধিক্কার দিবস’ পালনের ডাক দিয়েছেন। ঘটনার খবর পেয়েই এ দিন ঘটনাস্থলে পৌঁছন পলিটব্যুরো সদস্য নিরুপম সেন এবং মদন ঘোষ, রবীন দেবের মতো রাজ্য নেতারা। বিকালে বাম প্রতিনিধি দল নিয়ে এলাকায় আসেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। |
|
এখানেই খুন হন দুই সিপিএম নেতা। বুধবার উদিত সিংহের তোলা ছবি। |
রাতেই প্রাক্তন বিধায়ক প্রদীপ তা-র মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায়। আজ, বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর দেহ নিয়ে যাওয়া হবে বিধানসভায়। নিহত আর এক নেতা কমল গায়েনের দেহ কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়নি।
এই ঘটনার জন্য তৃণমূলের দিকেই অভিযোগের আঙুল তুলেছে সিপিএম। তাদের অভিযোগ, ‘পরিকল্পিত ভাবে’ হামলা চালিয়ে প্রদীপবাবুদের খুন করা হয়েছে। ঘটনায় জড়িত সন্দেহে যে চার জনকে এ দিন গ্রেফতার করা হয়েছে,
তারা তৃণমূলের সমর্থক বলেই পরিচিত। পুলিশ অবশ্য ‘আনুষ্ঠানিক’ ভাবে ধৃতদের ‘রাজনৈতিক পরিচয়’ জানাতে চায়নি। ধৃতদের মধ্যে দু’জন এর আগে প্রদীপবাবুর উপরেই হামলার ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছিল। সেই মামলায় এখন তারা জামিনে মুক্ত।
বর্ধমান-১ ব্লক তৃণমূল সভাপতি দেবনারায়ণ গুহ অবশ্য বলেন, “এখন (রাজ্যে ক্ষমতায় পালাবদলের পরে) তো সকলেই তৃণমূল! পুলিশ তদন্ত করুক।” ঘটনার দায় কোনও ভাবেই তাঁদের নয় বলে জানিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব। মৃত্যুর ঘটনা ‘দুঃখজনক’ জানিয়েও তাঁদের বক্তব্য, প্রথমে তৃণমূলের উপরেই হামলা হয়েছিল। তার পরের ঘটনা ‘গণরোষ’-এর ফলেই ঘটেছে। যে কথা জানিয়েছিলেন রাজ্যের একাধিক মন্ত্রীও। রাতে মুখ্যমন্ত্রী যে ‘তথ্য’ দিয়েছেন, তার সঙ্গে মিল রয়েছে তৃণমূলের বর্ধমান (গ্রামীণ) জেলা সভাপতি তথা বিধায়ক স্বপন দেবনাথের বক্তব্যের। তিনি সকালেই বলেছিলেন, এই ঘটনা সিপিএমের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের ফল।
সিপিএম নেতারা তৃণমূলকে অভিযুক্ত করলেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য সন্ধ্যায় দিল্লিতে জানিয়েছেন, সিপিএমের অন্তর্দ্বন্দ্বের জেরেই এই খুন। যদিও মহাকরণে রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ বলেছেন, “ফ্ল্যাগ-ফেস্টুন ছেঁড়াকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের বচসা বাধে। সিপিএমের রূপকুমার গুপ্ত এবং তৃণমূলের বিদ্যুৎ হাজরা নামে দু’জন জখম হন।” |
|
বাবা প্রদীপ তা-র মৃতদেহ জড়িয়ে কান্না মেয়ের। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র |
প্রাথমিক ভাবে খবর মিলেছে, সম্প্রতি সিপিএমের ছত্রচ্ছায়া ছেড়ে তৃণমূলের আশ্রয়ে চলে যাওয়া একটি দুষ্কৃতী দল এ দিনের খুনে জড়িত। সিপিএমে থাকার সময়েও তারা প্রদীপবাবুর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীতেই ছিল। মমতা-ঘনিষ্ঠ মহলের মতে, সম্ভবত সেই কারণেই মুখ্যমন্ত্রী সিপিএমের ‘অন্তর্দ্বন্দ্বের’ কথা বলেছেন। প্রদীপবাবুর ভাই প্রবীর তা বর্ধমান থানায় খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন। তাতে নির্দিষ্ট করে ২০ জনের নাম দেওয়া হয়েছে। এঁরা প্রত্যেকেই তৃণমূলের নেতা-কর্মী বলে সিপিএমের দাবি।
বুধবার সকাল ১০টা নাগাদ দেওয়ানদিঘিতে সিপিএমের বর্ধমান সদর জোনাল অফিস থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে পিটিয়ে, থেঁতলে মারা হয় প্রাক্তন বিধায়ক প্রদীপবাবুকে (৫৮)। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। মারাত্মক জখম হন জোনাল কমিটির সদ্য-প্রাক্তন সম্পাদক কমলবাবুও। কিছু ক্ষণের মধ্যে তাঁরও মৃত্যু ঘটে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, অশান্তির সূত্রপাত মঙ্গলবার থেকে। সেটাই বড় আকার নেয় এ দিন। সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ সাধারণ ধর্মঘটের সমর্থনে বর্ধমান-কাটোয়া রাস্তায় মিছিল বের করেছিল সিপিএম। বিভিন্ন দোকানে-বাড়িতে লাল ঝান্ডা লাগানো হচ্ছিল। দেওয়ানদিঘি মোড়ে বিদ্যুৎবরণ হাজরা নামে এক তৃণমূল কর্মীর কাপড়ের দোকানে পতাকা লাগাতে গেলে তিনি আপত্তি করেন। এই নিয়ে বাগ্বিতণ্ডার জেরে মেরে তাঁর মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। তৃণমূলের লোকজন ছুটে আসেন। পাল্টা মারে রূপকুমার গুপ্ত নামে এক সিপিএম সমর্থক জখম হন।
পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়। |
দিনের আলোয় |
সকাল ৮.৩০
তৃণমূল কর্মীর
দোকানে লালঝান্ডা
লাগানো
নিয়ে গণ্ডগোল। |
সকাল ৯.০০
বর্ধমান থানায়
অভিযোগ জানালেন
প্রদীপ তা। |
সকাল ৯.৫০
পুলিশ সুপারকে
প্রদীপের ফোন,
‘মিছিল করব’। |
সকাল ১০.০০
পুলিশের ‘আপত্তি’
সত্ত্বেও মিছিল শুরু
সিপিএমের। |
সকাল ১০.১৫
দুই সিপিএম
নেতাকে
রাস্তায়
ফেলে মার। |
বেলা ১১.০০
বর্ধমান
মেডিক্যালে মৃত
ঘোষিত প্রদীপ। |
বেলা ১২.১৫
দুর্গাপুরের
পথে মৃত
কমল গায়েন। |
|
আহত সমর্থককে বর্ধমান মেডিক্যালে ভর্তি করাতে গিয়েছিলেন প্রদীপবাবু নিজেই। পরে বর্ধমান থানায় অভিযোগ দায়ের করে তিনি দেওয়ানদিঘিতে ফিরে আসেন। পুলিশকে তিনি জানান, তৃণমূলের হামলার প্রতিবাদে তাঁরা মিছিল করবেন। এলাকায় উত্তেজনা থাকায় পুলিশ তাঁকে নিষেধ করেছিল। এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) বলেন, “সকাল ৯টা ৫০ নাগাদ প্রদীপবাবু পুলিশ সুপারকে ফোন করেছিলেন। পুলিশ সুপার তাঁকে মিছিল করতে বারণ করেন। তা সত্ত্বেও মিছিল বেরোয়।”
প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য, মিছিল খুব বড় হয়নি। লাঠিসোঁটা-রড নিয়ে জনা পঞ্চাশেক লোক মোড় থেকে দেওয়ানদিঘি-নাদনঘাট রাস্তা ধরে এগোচ্ছিল। খবর পেয়ে উল্টো দিক থেকে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা তেড়ে আসেন। বর্ধমান-কাটোয়া রাস্তার দু’পাশ থেকেও তৃণমূলের লোকেরা মোড়ের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সিপিএম সমর্থকেরা যে দিকে পারেন, ছুটে পালাতে থাকেন। প্রদীপবাবু ও কমলবাবু বড় রাস্তা ছেড়ে গলি দিয়ে কাছেই পার্টি অফিসে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ৫০-৬০ জন তাঁদের ধাওয়া করে ঘিরে ফেলে। জোনাল অফিস থেকে শ’খানেক গজ দূরে তাঁদের রাস্তায় পেটানো হয়। বর্ধমান শহরের অদূরে ঘটনাস্থল এমনিতে জমজমাট জায়গা। তবে এ দিন সকালে পতাকা লাগানো নিয়ে ঘটনার জেরে এলাকায় উত্তেজনা ছিল। তার মধ্যেই প্রদীপবাবুদের উপরে আক্রমণ হয়।
ঘটনাচক্রে, এই এলাকাতেই বহু বছর আগে কংগ্রেসের প্রাক্তন বিধায়ক কাশীনাথ তা-কে এই ভাবেই পিটিয়ে খুন করা হয়েছিল। সেই ঘটনারও উল্লেখ রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ এ দিন করেছেন। দু’বছর আগে, ২০১০ সালে নানুরের প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক আনন্দ দাসকেও তাঁর গ্রামে খুন হতে হয়েছিল। তবে এ দিনের ঘটনার সঙ্গে আনন্দবাবুর ঘটনার তফাত হল, এ দিনের ঘটনা ঘটেছে বর্ধমান শহরের উপকণ্ঠে, ‘জমজমাট’ এলাকায়। পুলিশ-প্রশাসনের কার্যত নাকের ডগায়। আনন্দবাবু খুন হয়েছিলেন প্রত্যন্ত গ্রামে। |
|
প্রদীপ তাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন দলের কর্মী-সমর্থকরা। বর্ধমান জেলা পার্টি অফিসে। ছবি: উদিত সিংহ |
এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) বলেন, “পুলিশের আর টি অফিসার সেখানে গিয়েছিলেন। কিন্তু ঢুকতে পারেননি। পরে ঘটনাস্থল থেকে চার জনকে গ্রেফতার করা হয়।” পুলিশ জানায়, ধৃতেরা হলেন ভূপাল গোস্বামী, ছোটন চক্রবর্তী, পতিতপাবন তা ও তাঁর ছেলে সুরজিৎ তা। এর মধ্যে ছোটন ও পতিতপাবন এলাকায় তৃণমূলের নেতা বলেই পরিচিত। কয়েক মাস আগে স্থানীয় একটি কারখানায় প্রদীপবাবুকে নিগ্রহের অভিযোগেই ওই দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। মাসখানেক আগে জামিনে তাঁরা ছাড়া পান। কিন্তু আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) গঙ্গেশ্বর সিংহ বা বর্ধমানের পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা কেউই ধৃতদের ‘রাজনৈতিক পরিচয়’ জানাতে চাননি।
বর্ধমান মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়ার পরেও কমলবাবু বেঁচে ছিলেন। সেখান থেকে দুর্গাপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে গোলাপবাগে তাঁর মৃত্যু হয়। পুলিশের এক কর্তা জানান, সিটু নেতা প্রদীপবাবুর উপরে এই নিয়ে তিন বার হামলা হল। এর আগে একটি চালকল ও তেলকলে হামলা হলেও তিনি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। |
|
জখম তৃণমূল সমর্থক বিদ্যুৎবরণ হাজরা। (ডান দিকে) সিপিএম সমর্থক রূপকুমার গুপ্ত। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র |
তৃণমূলের দিকে আঙুল তোলার পাশাপাশি পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সরব হয়েছে সিপিএম। প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপমবাবুর কথায়, “গণতন্ত্রের পক্ষে লজ্জার দিন। পুলিশের ভূমিকাও ন্যক্কারজনক! পুলিশের সামনেই তো খুন হয়েছেন দু’জন! এ রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার কতটা অবনতি হয়েছে, তা এই ঘটনাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।” বর্ধমান জেলারই নেতা, সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মদনবাবুর বক্তব্য, “দিনেদুপুরে যে ভাবে প্রদীপবাবু ও কমলবাবু খুন হয়েছেন, তার প্রতিবাদের ভাষা হয় না। বুঝে নিন, কোন রাজত্বে বসবাস করছেন!” আর জেলা সম্পাদক অমল হালদার বলেন, “তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা কতটা তীব্র আক্রমণ শুরু করেছে, তা এই ঘটনায় প্রকাশ পেয়েছে। দলীয় কার্যালয়ের কাছে যদি প্রকাশ্য দিবালোকে এক জন প্রাক্তন বিধায়ক এমন নৃশংস ভাবে খুন হন, তা হলে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা?”
জেলা সভাধিপতি উদয় সরকারের অভিযোগ, “খুনিরা যে ভাবে ভীতির পরিবেশ তৈরি করেছে, তা এলাকায় ঘুরলেই বোঝা যায়। শুনলাম, কেউ-ই খুন নিয়ে পুলিশের কাছে মুখ খুলতে চাননি। কতটা আতঙ্ক তৈরি হলে তবে এটা হয়!” |
|
|
|
|
|