সিপিএমের ‘সফল’ ব্রিগেডে আপাতত ‘কাঁটা’র মত বিঁধছেন অমিতাভ নন্দী। উত্তর ২৪ পরগনার এই ‘দাপুটে নেতা’ রবিবার ব্রিগেডেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, গৌতম দেবের পাশে বসে প্রকাশ্যেই প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেন তাঁকে রাজ্য কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হল? সোমবার এক ধাপ এগিয়ে তিনি বলেন, “২০০৮ সালে রাজ্য সম্মেলনের পরে চার বছরে একটাও কাগজ ধরিয়ে বলা হয়নি, আমার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আছে। জেলার দায়িত্বে থাকা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু মৌখিক ভাবেও কিছু জানতে চাননি। দলীয় নেতৃত্ব যখন যা বলেছেন, তখন তাই করেছি। তা হলে কোন নীতিতে দল চলছে?”
অমিতাভবাবুর দাবি, তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ জেলা কমিটির সদস্যরা এ দিন তাঁকে ফোন করে ‘পাশে থাকা’র আশ্বাস দিয়েছেন। ভাষা দিবস নিয়ে উত্তর ২৪ পরগনার দুর্গানগরে একটি সাইকেল-যাত্রারও সূচনা করেন অমিতাভবাবু। তাঁর কথায়, “রাজ্য কমিটি থেকে বাদ পড়ায় মানুষ যে ভাবে আমার প্রতি সহানুভূতিশীল, তাতে আমি অভিভূত। গত ৪০ বছর ধরে সাধারণ মানুষের জন্য পার্টি করছি। সব ব্যাপারে তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। সে কারণেই তাঁরা আমার প্রতি সহানুভূতিশীল।” আজ, মঙ্গলবার বনগাঁ সীমান্তে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তিনি ‘ভাষা দিবস’ পালন করবেন। ওই অনুষ্ঠানে দলের সাংসদ শ্যামল চক্রবর্তীও উপস্থিত থাকবেন। শ্যামলবাবু এ দিন বলেন, “ব্রিগেডে আমার একদিকে বুদ্ধ-গৌতম, অন্যদিকে অমিতাভ বসেছিল। তা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে। অমিতাভ কিছু বলে থাকলে সেটা ওর নিজস্ব মতামত।” স্পষ্টতঃই, শ্যামলবাবু কোনও ‘বিতর্কে’ জড়াতে নারাজ।
অমিতাভবাবু কিন্তু এ দিনও বলেছেন, রাজ্য নেতৃত্বের ‘জবাবে’র জন্য আরও দু’দিন দেখবেন। তারপরেই আত্মপক্ষ সমর্থনে মুখ খুলবেন। তাঁর মতে, রাজ্য কমিটি থেকে বাদ পড়ার বিষয়টিকে যে ভাবে সংবাদমাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং রাজ্য নেতৃত্ব তার কোনও প্রতিবাদ করেনি, তাতে তাঁর সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়েছে। অমিতাভবাবুর বক্তব্য, “কেউ আমার সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন করতে পারে না। দলীয় নেতৃত্বও নন।” অমিতাভবাবুকে রাজ্য কমিটি থেকে বাদ দেওয়ার পিছনে বুদ্ধবাবু ছাড়াও জেলা সম্পাদক গৌতমবাবুর ‘উদ্যোগ’ রয়েছে বলে দলীয় সূত্রে খবর। গৌতমবাবু পাল্টা কোনও মন্তব্য করতে নারাজ। বস্তুত, রাজ্য নেতৃত্ব কোনও প্রতিক্রিয়া না-জানিয়ে অমিতাভবাবুর উপরেই ‘পাল্টা চাপ’ সৃষ্টি করতে চাইছেন। দলের এক নেতার কথায়, “অমিতাভবাবু যদি প্রকাশ্যেই এ ভাবে বার বার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন, তাহলে দল তাঁর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ আনতে পারে।”
ব্রিগেড সমাবেশ সফল করতে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা নেতৃত্ব যথেষ্ট উদ্যোগ নিয়েছিল। তাতে সামিল ছিলেন অমিতাভবাবুও। ‘সফল’ ব্রিগেড নিয়ে জেলার নেতারা উচ্ছ্বসিত। কিন্তু অমিতাভবাবুর বিষয়টি নিয়ে তাঁরা আবার ‘অস্বস্তি’তে। নেতারা বুঝতে চেষ্টা করছেন, অমিতাভবাবু মুখ খুললে কী বলতে পারেন? কার বিরুদ্ধে বলতে পারেন? তবে দলের একাংশের বক্তব্য, অমিতাভবাবুর বিরুদ্ধে দলের রাজ্য নেতৃত্বের কাছে বিভিন্ন লিখিত অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে তাঁর ‘অ-কমিউনিস্ট’ সুলভ জীবনযাপন এবং জেলায় দলের অন্দরে ‘একাধিপত্য’ তৈরি করার আগ্রহ নিয়েও।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্মেলনে গৌতমবাবুকে জেলা সম্পাদক করার প্রতিবাদে অমিতাভবাবু রাজ্য কমিটি থেকে ইস্তফা দিতে চেয়েছিলেন। তখন আলিমুদ্দিনের নেতারা তাঁকে বুঝিয়ে নিরস্ত করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে তাঁকে রাজ্য কমিটি থেকেই ছেঁটে দেওয়া হবে, তিনি তা ভাবতে পারেননি। তাঁর এক আত্মীয়ের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা নিয়ে দলের একাংশে নানা প্রশ্ন আছে। তবে অমিতাভবাবুর যুক্তি, “দলের কোনও নেতা বা কর্মীর আত্মীয় ব্যবসা করতেই পারেন। কিন্তু ব্যবসা করতে গিয়ে তিনি কোনও বাড়তি সুবিধা পেয়েছেন কিনা, সেটাই দলের বিচার্য উচিত।” তাঁর দাবি, “ওই আত্মীয় নিজের প্রচেষ্টাতেই উদ্যোগপতি হয়েছেন। আমার কোনও সাহায্য নেননি।”
জেলা কমিটিতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে এখনও অমিতাভ-ঘনিষ্ঠর সংখ্যা বেশি। যদিও গোষ্ঠী-বিভক্ত জেলা রাজনীতিতে সামগ্রিক ভাবে তিনি সংখ্যালঘু। ওই জেলার নেতা প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তী বিভিন্ন সময় দলীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন। কিন্তু পরে নেতৃত্বের কাছে ক্ষমা চেয়ে তিনি পার পেয়ে যান। সুভাষবাবুর পিছনে ছিলেন স্বয়ং জ্যোতি বসু। অমিতাভবাবুর পাশে কিন্তু তেমন মাপের কেউ নেই। শেষ পর্যন্ত তিনি কত দূর যান, এখন সেটাই দেখতে চায় আলিমুদ্দিন।
বয়সের কারণে রাজ্য কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন দীপেন ঘোষও। সোমবার আলিমুদ্দিনে পত্রপত্রিকার সেলে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তাঁর অভিযোগ, কমিটি থেকে বাদ দেওয়ার আগে বিমানবাবু তাঁকে এক বার জানালেন না। সেলের কর্মীরা এবং রাজ্য কমিটির নেতারা ছুটে আসেন, সান্ত্বনা দেন দীপেনবাবুকে। তাঁকে বলা হয়, তিনি কমিটি থেকে বাদ পড়লেও আগের মতোই লেখালেখি করতে পারবেন। এ কথা শুনে শান্ত হন দীপেনবাবু। |