সেই মান্ধাতা আমলের প্রযুক্তিবঞ্চিত, কূপমণ্ডূক মান আর পদ্ধতি,
সেই ‘আর কিছু হল না, তাই বাংলা’।
অথচ অনেক কিছুই করা যেত, করা যায়।
আমাদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পঠনপাঠন নিয়ে লিখছেন শম্পা সেন |
আবার একুশে ফেব্রুয়ারি। আবার সরকারি বিজ্ঞপ্তি আর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপনের বাৎসরিক পার্বণ। এবং আবার পরের দিন, বাইশে ফেব্রুয়ারি থেকেই উপেক্ষার বহুকালীন অন্ধকারে ম্লান হয়ে যাবে এ রাজ্যের বাংলা ভাষা। কেমন একটা দীনতার আবরণ ঢেকে ফেলবে আমাদের মাতৃভাষার মুখচ্ছবি। কলকাতার কিছু বাংলা-মাধ্যম বিদ্যালয়, পুরনো পাড়ার সংকীর্ণ গলির দোকান বা ক্লাব অথবা তেলেভাজার দোকানের সাইনবোর্ডে কিংবা রাজনৈতিক তরজার চিৎকৃত বাক্যবিন্যাসে লটকে থাকবে ‘আ মরি বাংলা ভাষা’-র জীর্ণ কঙ্কালটি। তবু গ্রাম ও ছোট শহরতলির যাপিত জীবনচর্যায় বাংলা এখনও প্রাধান্য পায়। কিন্তু কলকাতায়? ক্রমশ প্রান্তিক হয়ে যাচ্ছে আমাদের মাতৃভাষা। তবে কি বাংলা আজকের দিনে আত্মবিশ্বাস আর আত্মপ্রতিষ্ঠার ভাষা হতে পারে না? সমস্যাটি বহুমাত্রিক। আপাতত চোখ রাখা যাক একটি দিকে। ব্যক্তিগত, সামাজিক বা সরকারি উদ্যোগে বাংলাভাষার ব্যবহার-চর্চা ইত্যাকার বিষয়ের বাইরে গিয়ে দৃষ্টিপাত করি ‘বাংলাভাষা ও সাহিত্য’-র পঠনপাঠনের দিকটিতে।
|
এ রাজ্যে বিদ্যালয় পেরিয়ে স্নাতক স্তরের গণ্ডিতে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী পড়ে ‘বাংলাভাষা ও সাহিত্য’ নিয়ে। এদের মধ্যে অনেকেই উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিষয়ে ধাক্কা খেয়ে, অন্য বিষয় নিয়ে পড়বার সুযোগ না পেয়ে কিংবা অন্য বিষয় আয়ত্ত করতে পারবে না ভেবে বাংলা নিয়ে স্নাতক স্তরে ভর্তি হয়। আবার বাংলা ছাত্রছাত্রীর পছন্দের বিষয় হলেও অনিচ্ছুক অভিভাবকের সংখ্যাও কম থাকে না। ফলে মাতৃভাষা সম্বন্ধে প্রাণের আবেগ কিংবা এ বিষয়ে পঠনপাঠনের পর ভবিষ্যতের লক্ষ্য বা দিশা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত ও অস্পষ্ট থেকে যায়। সাধারণত বাংলাভাষা ও সাহিত্যের বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী বছরের পর বছর চর্যাপদ থেকে শাক্তপদ ঘুরে মধ্যযুগের পাঠক্রমের আবর্তে পাক খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত পরম কাঙ্ক্ষিত এসএসসি পরীক্ষার দোরগোড়ায় উপস্থিত হয়। সিলেবাস-নোটবই এবং নোটবই-সিলেবাস আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে মূলত প্রাইভেট টিউশন নামক সমান্তরাল একটি শিক্ষা ব্যবস্থার যে আবর্ত, তার বাইরে ‘বাংলাভাষা ও সাহিত্য’-র পরিসর যে কতখানি প্রসারিত হতে পারে, এ সম্বন্ধে তাদের প্রায় কোনও ধারণাই তৈরি হয় না। ধারণাটা দেওয়া হয় না। তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বায়িত দুনিয়ায় এই প্রজন্মের বাংলা-সাম্মানিকের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী কম্পিউটারের ব্যবহার না জানা, তার সুযোগ না থাকা, আর ইংরেজি ভাষা চর্চার চরম অনভ্যাসের ফলে পিছিয়ে পড়তে থাকে। হীনম্মন্যতা ও আত্মবিশ্বাসের অভাব তৈরি হয় বস্তাবন্দি এক প্রাচীন শিক্ষাভ্যাসের কারণে। শিক্ষার যথাযথ দিশার অভাবে আত্মপ্রতিষ্ঠার ভূমিও খুঁজে পায় না অনেক যোগ্য ছেলেমেয়ে।
|
প্রসঙ্গত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। পটভূমি পূর্ব ইউরোপ। ভ্লাতাভা নদী, জার্মানরা বলে ‘মোলেদোউ’, তার দু’পারে বিছিয়ে আছে রূপকথার মতো সুন্দর শহর প্রাগ বা প্রাহা। পুরনো প্রাহায় থমকে আছে মধ্যযুগের ইউরোপের ইতিহাস তার ‘বারোক’ কাস্ল, ওল্ড স্কোয়ার, প্রাচীন পাথরে বাঁধানো রাস্তার আনাচেকানাচে। পুরনো প্রাহায় গাড়ি নিয়ে ঢোকা নিষেধ, রাস্তায় নেমে হেঁটে খুঁজছি চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথ। হঠাৎ বিশুদ্ধ বাংলায় পিছন থেকে ডাকলেন এক নীলনয়ন দীর্ঘাঙ্গী যুবক। আলাপ হল। চার্লস বিশ্বাবিদ্যালয়ের বাংলা ভাষার অধ্যাপক মার্টিন থ্রিবেক্। চেক প্রজাতন্ত্রের বোহেমিয়া অঞ্চলের এই যুবকের বিষয় নৃতত্ত্ব হলেও বাংলা ভাষা চর্চার জগতে এঁর প্রবেশ এক আশ্চর্য ভালবাসায়। এর পর যখন চার্লস বিশ্ববিদ্যালয় বা পোল্যান্ডের ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে পড়াতে গেছি, প্রাচ্যবিদ্যা বিভাগের ক্লাসে আশ্চর্য মুগ্ধতায় অনুভব করেছি বাংলা ভাষার প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা। সুদূর পূর্ব ইউরোপে কোনও চেক-ছাত্র বা রোমানিয়ার ছাত্রী, কিংবা স্লাভ-পোলিশ-সার্বিয়ান-জার্মান ছেলেমেয়েরা কী অসাধারণ মনোযোগে-ঔৎসুক্যে-শ্রদ্ধায় বাংলা ভাষার পাঠ নেয়! বস্তুত ইউরোপের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালেয়ই প্রতি বছর প্রাচ্যবিদ্যা বিভাগে হিন্দি-মান্দারিন-তেলুগু প্রভৃতি ভাষার তুলনায় বাংলা ভাষাই শেখে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী। এরা বাঙালি বা ভারতীয় তো নয়ই, অধিকাংশই ভারতে আসেওনি, এলেও নামমাত্র। ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা দানুতা স্ট্যামিক, এলিজাবেথরা আমাদের মাতৃভাষার প্রসার ঘটাচ্ছেন বিশ্বের বৃহত্তর পরিধিতে। জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কথা অনেকটা জানলেও পোল্যান্ডের মতো ছোট একটি দেশের বাংলাপ্রেমী পণ্ডিত মানুষদের কথা আমাদের অনেকেরই জানা নেই। কী অসামান্য মমতায় তাঁরা আপন ভাষায় অনুবাদ করে চলেছেন নানা বাংলা বই।
দুঃখের কথা, এ রাজ্যের স্নাতক স্তরে বাংলা-সম্মানিকের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই এ সব তথ্য একেবারেই জানে না। ফলে বাংলা ভাষার ব্যাপ্তি, সে সম্পর্কে গবেষণার পরিধি, শিক্ষায়তনের মানচিত্র কোথায় কী থাকতে পারে এ ব্যাপারেও ‘অদ্ভুত আঁধারে’ ঢাকা আমাদের বর্তমান।
|
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যে অধ্যাপকদের জন্য ‘ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম’ ও ‘রিফ্রেশার্স কোর্স’ চালু করেছেন, তার নিশ্চয়ই একটা বৃহত্তর মহৎ উদ্দেশ্য আছে। যে অভিমুখীনতার পাঠ আমরা নিই, তার সূত্রগুলিকে শিক্ষাদানে প্রয়োগ করলে সত্যিই একটা বিকল্প পরিসর তৈরি হয় পাঠক্রমের বাইরে। কেন বাংলা ভাষার ছাত্ররা অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে আদানপ্রদানের একটা উপযুক্ত পরিসর খুঁজে পাবে না তার ক্লাসের পরিধিতে? কেন ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ শব্দবন্ধ বোঝাতে গিয়ে আমরা ছেলেমেয়েদের ‘অডিয়ো-ভিশুয়াল মাধ্যম’ বা অন্তত ‘শিন্ডলার্স লিস্ট্’ নামক মহান চলচ্চিত্রটি দেখিয়ে পাঠ নিতে শেখাব না? অন্তত যেখানে পরিকাঠামো আছে? কেন ঐচ্ছিক বাংলার পাঠ্যক্রমে বিজ্ঞাপনের ডিজাইন আঁকতে বই মুখস্থ করাব, অথচ কোনও বিজ্ঞাপন সংস্থার ব্যক্তিত্বকে আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি আলোচনাসভায় বাংলার ছাত্রদের সামনে হাজির করাব না? বিজ্ঞাপনের বাংলা কপি লেখার চাহিদাও তো ছাত্রদের ভবিষ্যতে পথ দেখাতে পারে। কেন বাংলা ভাষা শিক্ষার সঙ্গে ইংরেজি ছাড়াও অন্য বিদেশি ভাষার ঐচ্ছিক বিভাগ খোলার কথা ভাবব না আমরা? বাংলা ভাষার শিক্ষার্থীদের জন্য ‘কেরিয়ার কাউন্সিলিং’ আবশ্যিক করার কথা ভাবব না আমরা? শিক্ষার্থীকে তার বিষয়ের উপযোগিতা ও প্রাসঙ্গিকতার দিশা তো দেখানোই উচিত। পরিকাঠামোগত যাবতীয় সীমাবদ্ধতার মধ্যে দাঁড়িয়েও ভাবনার বিকল্প প্রস্তাব তো রচনা করা যায়!
এক কালে আমরা যারা শুধু হৃদয়ের আবেগের তাড়নায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়তে এসেছিলাম, তারা প্রেসিডেন্সির পোর্টিকোয় ঝলসে উঠতে দেখতাম ‘গান্ধীনগরে রাত্রি’র অবিস্মরণীয় পঙ্ক্তি, অথবা কলেজ স্ট্রিটে শিকড় গেড়ে চেতনার প্রশাখা মেলতে যেতাম যাদবপুরে শঙ্খ ঘোষের ‘রক্তকরবী’র ক্লাসে, তাদের কাছে বাংলা ভাষা ছিল পাঠ্যক্রমের বাইরে এক অনন্ত প্রেমের কবিতা।
‘আ মরি বাংলা ভাষা’ ফিরে এসো সেই সপ্রাণ দীপ্রতায়। পৃথিবীর উদার পরিধিতে আমাদের ছেলেমেয়েরা খুঁজে পাক তাদের ভাষার উন্মুক্ত প্রসার, মাতৃভাষার সত্যিকারের ভুবনায়ন হোক।
|
হুগলি মহসিন কলেজে বাংলার শিক্ষক |