কমবয়সিরা যদি পড়ে, তবেই একটা ভাষার ভবিষ্যৎ থাকে।
বাংলার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা সেখানেই। ভাষা দিবসে সুরাহা খুঁজেছেন বিশ্বজিৎ রায় |
বসন্ত এসেছে। বাংলা ভাষার গায়ে বসন্তের ফুরফুরে বাতাস লেগেছে, তা অবশ্য বলা যাবে না। বরং একুশে ফেব্রুয়ারির আগে পরে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে যেমন চিন্তা-চিন্তা হাওয়া ওঠে, এ ফাল্গুনেও তা উঠেছে। এ বছর ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর। কাজেই বাংলাদেশে খুবই আনন্দ ও উৎসাহের সঙ্গে ভাষা দিবস পালন করা হবে। কিন্তু ও পার বাংলার পুণ্যে এ পার বাংলার পুণ্য হওয়ার কোনও কারণ নেই।
যাদের বয়স কম তারা ভবিষ্যতে কোন ভাষা বেশি ব্যবহার করবে তার ওপরেই ভিত্তি করে গড়ে ওঠে ভাষার ভবিষ্যৎ। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ তাই নির্ভর করছে পাঁচ থেকে পঁয়তাল্লিশ-এর মধ্যবর্তী বাঙালিরা ভাষা নিয়ে কী ভাবছেন তার ওপর। এই পাঁচ থেকে পঁয়তাল্লিশ নানা অর্থনৈতিক শ্রেণির অন্তর্গত, ঊর্ধ্বসীমার দিকে যাঁরা আছেন সেই পঁয়ত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ হলেন এখনকার কমবয়সী বাবা-মা। তবে যে অর্থনৈতিক শ্রেণিরই অন্তর্গত হন না কেন, সকলেই কম-বেশি স্বপ্ন দেখেন, নিজেদের ছেলেমেয়েকে ভাল করে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ করবেন। এই স্বপ্নে ভাষার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
এই কমবয়সী বাবা-মায়েরা, অর্থাৎ ১৯৬৭ থেকে ’৭৭-এর মধ্যে যাঁরা পশ্চিমবঙ্গ নামক অঙ্গরাজ্যে জন্মেছিলেন, তাঁদের একটা বড় অংশ বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ে পড়েছিলেন। কারণ তাঁদের বাবা-মায়েরা মুক্ত অর্থনীতির যুগে বড় হয়ে ওঠেননি। সেই পিতামহ-পিতামহীদের স্মৃতিতে স্বাধীনতা আন্দোলন, দেশভাগ, বড় ছিল। শুধু তা-ই নয়, তখন তাঁরা এক রকম বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয় দেখে অভ্যস্ত ছিলেন যেখানে ইংরেজি-অঙ্কের ভিত পোক্ত হত। পড়া আর লেখার ইংরেজি ভালই শেখানো হত পাড়ার স্কুলে বা জেলা স্কুলগুলিতে। বলার ইংরেজিও যে চাইলে রপ্ত করে নেওয়া যায়, এমন উদাহরণও বিরল ছিল না। বাংলা মিডিয়মের ওপর ভরসা তাই চলে যায়নি। সে সময় আবার কোনও কোনও স্কুলে, যেমন রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালিত স্কুলে বাংলা আর ইংলিশ মিডিয়ম পাশাপাশি ছিল। ফলে দুই মিডিয়মের ছাত্রদের মধ্যে একটা সহজ আদানপ্রদান ছিল। আবার পরস্পর পাল্লা দেওয়ার উপভোগ্য লড়াই চোখে পড়ত। |
তার পর? বাংলা ভাষা শহিদ স্মারক উদ্বোধন।
অন্নদাশঙ্কর রায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কার্জন পার্ক, ১৯৯৮ |
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর নানা রকম নীতিগত বদল ঘটায়। যেমন অপারেশন বর্গা ভাগচাষিদের অধিকারের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন। কিন্তু জমি আর শিক্ষা তো এক জিনিস নয়। যাঁরা বেশি জমি দখল করে সংখ্যাগরিষ্ঠ চাষি আর শ্রমিকদের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে শোষণ কায়েম করছিলেন, ভূমি সংস্কার আন্দোলন ও আইনের মাধ্যমে সেই বড়লোকদের রোখা এক রকম, আর ইস্কুল থেকে ইংরেজিকে বড়লোকের ভাষা বলে নিকেশ করা আর এক রকম। এ তো টেনে নামানোর চেষ্টা। স্কুলের প্রাথমিক পর্বে ইংরেজি তুলে দেওয়ার পাশাপাশি ইংরেজি শেখানোর জন্য যে বই নির্মাণ করা হল সেই বই ব্যবহারিক ইংরেজি শেখানোর বই, ইংরেজি ভাষার সাহিত্য ও ভাবনামূলক লেখাপত্র আর তেমন করে সে বইতে পাঠ্য হিসেবে জায়গা পেল না। এই সংস্কারের যুক্তিটা ছিল, কয়েক প্রজন্মের শিক্ষাদীক্ষা যাদের আছে সেই ‘বড়লোক’ বাড়ির ছেলেরা স্কুলে ইংরেজিটা ম্যানেজ করে এগিয়ে যায়, কিন্তু কয়েক প্রজন্মের শিক্ষা যাদের নেই সেই হতভাগ্য গরিবেরা ইংরেজির ‘হেতুহীন’ চাপে পীড়িত হচ্ছে। সুতরাং ইংরেজি শিক্ষার ধারাটিকে সহজতর করে নেওয়া যাক।
ক্রমেই ইংরেজিবিহীন সহজ বাংলা মিডিয়মের প্রতি আস্থা কমে গেল বলে মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তরা এই স্কুলগুলি থেকে মুখ ফেরালেন। আর এই ফাঁক ভরানোর জন্য ক্রমে তৈরি হল অজস্র নানা কিসিমের ইংলিশ মিডিয়ম। আর যে গরিবদের জন্য এই সহজ বাংলা মিডিয়মের আয়োজন, তাঁরাও কি এতে খুশি ছিলেন? অমিত চৌধুরীর উপন্যাসের সেই বচ্ছর-বচ্ছর পিতা হওয়া ঝাড়ুদারটির কথা মনে নেই? সে তো তার স্কুলে না পাঠানো সন্তানদের ইংলিশ মিডিয়মেই পড়াতে চেয়েছিল। উপন্যাসের এই উল্লেখে অতিরঞ্জিত ব্যঙ্গ আছে, তবে বাস্তব খুব আলাদা ছিল না। ইংরেজি যে শিখতে হবে, এ কথা খুব সাধারণ মানুষও বুঝে ফেলেছিলেন।
ইংরেজি তুলে দিয়ে বাংলা মিডিয়ম স্কুলগুলির প্রতি মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের বিমুখ করে তোলার ফল কিন্তু বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতির পক্ষে ভাল হয়নি। এতে ইংলিশ মিডিয়ম স্কুলের রমরমা হয়েছে, বাংলা ভাষার ব্যবহারযোগ্যতা কমেছে। এখন যাঁদের বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ, সেই অভিভাবকরা কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও এখন ছেলেমেয়েদের বাংলা মাধ্যমে পাঠাতে পারেন না। কারণ ভাল বাংলা মিডিয়ম স্কুল প্রায় নেই। ফলে ইংলিশ মিডিয়ম অনিবার্য ভবিতব্য হয়ে উঠছে। আসলে ইংরেজি তুলে দেওয়া নেতিবাচক প্রক্রিয়া, এতে লাভ হয় না।
উনিশ শতকে বাংলা ভাষার পক্ষ নিয়ে যাঁরা কাজ করছিলেন তাঁরা কেউ ভাষার ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করেননি। বাংলা ভাষায় কী করে সুললিত ভাবে মিল-বেন্থামের ভাবনাকেও প্রকাশ করা যায়, বঙ্কিমের মতো ভাষাভাবুক সেই দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আর রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি কী ভাবে এবং কতটা পড়াতেন তাঁর স্কুলে, সে বৃত্তান্ত তো একটু চেষ্টা করলেই জানা যায়। যেমন ম্যাথু আর্নল্ডের কবিতা পড়াতে গিয়ে কবি কী পরিশ্রম করেছেন তা ভাবলে অবাক লাগে। কবিতার মূল বাক্যগুলিকে নানা রূপের ইংরেজি গদ্যে তর্জমা করে শোনাচ্ছেন লেখাচ্ছেন পড়ুয়াদের। কবি আসলে জানতেন অপর ভাষার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে বাংলা বাঁচবে না।
শঙ্খ ঘোষের হাসিখুশি মুখে সর্বনাশ নামের সদ্য প্রকাশিত বইতে ইস্কুলের বাবা-মা নামের একটা কবিতা আছে।
‘হাড়-জিরজিরে ইস্কুলবাড়িটার মুখ ঢেকে
মাঠের ওপর ছড়িয়ে গেছে লম্বা আর ফ্যাকাশে একটা পাঁচিল
পাশ কাটিয়ে ঢুকে এলেন ভিন্দেশি প্রাক্তনীরা’।
এই যে প্রতিষ্ঠিত প্রাক্তনীরা সঙ্গে, যাঁরা এখন কর্মসূত্রে ভিন প্রদেশে ও দেশে, তাঁদের সঙ্গে বাংলা মাধ্যম স্কুলের বিচ্ছেদ তো এক দিনে হয়নি। কোনও ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে যে সবল অর্থনীতি আর শিক্ষানীতি গড়ে তুলতে হয় সেটা না বুঝে শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে টেনে নামানোর সাম্য স্থাপনের এ অনিবার্য ফল। পশ্চিমবঙ্গ অর্থনীতি আর শিক্ষানীতিতে দুর্বল হওয়ায় পরিশ্রমী শিক্ষিত বাঙালি অন্যত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। বাংলা ভাষার সঙ্গে তাঁদের ছেলেমেয়েদের যোগ কমেছে। দেশে ফিরেও উপযুক্ত বাংলা মাধ্যম স্কুল না থাকায় অন্য রকম স্কুলে পাঠাতে হয়েছে সন্তানদের। যাঁরা এ বঙ্গে প্রতিষ্ঠিত তাঁরাও সন্তানদের বাংলায় ফেরানোর তেমন কারণ ও ব্যবস্থা খুঁজে পাননি। এই কমবয়সী বাবা-মায়ের দল এখন অনেকেই বাংলায় ব্লগ লেখেন, বাংলা বই ভালবেসে পড়েন, বাংলা সংস্কৃতির নানা পণ্য কেনেন। তাঁরা পড়েন, কিন্তু তাঁদের ছেলেমেয়েরা কেন বাংলা পড়বে, কী ভাবে পড়বে সেই প্রশ্নের সদুত্তর দেওয়া মুশকিল। শুধু আবেগে কাজ হবে না। কাজেই পশ্চিমবঙ্গে বসন্ত এসেছে, ভাষার বসন্ত আসেনি। কী ভাবে আসবে, আদৌ আসবে কি না, বলা মুশকিল।
|
বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক |