গ্রামের লোকে বলছে, ‘এ তো পুরো বাণ মারার কেস’। সে কথা মানতে রাজি নন গৃহকর্তা। গ্রামের লোকের কথা মিথ্যে প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন তিনি। এক জোড়া মরা শালিক নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন ফরেন্সিক ল্যাবরেটরি থেকে শুরু করে প্রাণিসম্পদ দফতর এমনকী থানার দরজায়। শালিকের দেহের ময়না-তদন্ত চান তিনি।
শৈলেন্দ্রনাথ পাল থাকেন হাবরার গোয়ালবাটি দক্ষিণপাড়ায়। তাঁর স্ত্রী আরতিরানি সোমবার রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। মুখ দিয়ে রক্ত উঠছিল। স্থানীয় ভাবে চিকিৎসা করিয়ে বাড়ি ফেরেন পাল দম্পতি। কিন্তু মঙ্গলবার ভোরে আর এক বিপত্তি। বাড়ির উঠোনে পড়ে দু’টি মরা শালিক। গ্রামের মাতব্বরেরা এসে জানিয়ে দেন, ‘ভয়ঙ্কর অলুক্ষুণে ঘটনা’। কেউ কেউ আবার বলেন, “মনে হচ্ছে বাণ মারা কেসই হবে।” গ্রামের ‘পাঁচ-মাথা’ নিদান দেয়, ওঝার কাছে যেতে হবে। এর একটা জুতসই বিহিত চাই।
চাপে পড়ে শৈলেন্দ্রনাথ গিয়েও ছিলেন এক ওঝার কাছে। তিনিও জানিয়ে দেন, স্ত্রীকে নির্ঘাত বাণ মেরেছে কেউ। মুখ দিয়ে রক্ত ওঠা, উঠোনে মরা শালিক এ সব না হলে আর কীসের লক্ষণ? এক সময়ে পাড়ায় হাতুড়ে ডাক্তারি করতেন শৈলেন্দ্র। ইদানীং বিমানবন্দর এলাকায় নিরাপত্তারক্ষীর কাজ নিয়েছেন। তাঁর ‘যুক্তিবাদী’ মন এ সব কুসংস্কারের কথা মানতে চায়নি। |
শৈলেন্দ্র ঠিক করে ফেলেন, শালিকের মৃত্যু-রহস্য তাঁকে উদ্ঘাটন করতেই হবে। শৈলেন্দ্র পৌঁছে যান হাবরায় প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরে। সেখানকার চিকিৎসক প্রভাতকুমার মণ্ডল বলেন, “উনি দু’টি শালিক নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সেগুলি কী ভাবে মারা গেল, তা বোঝার মতো পরিকাঠামো এখানে নেই। ওঁকে বলেছি, বেলগাছিয়ায় ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে মরা শালিক নিয়ে যেতে।”
প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ উপেক্ষা করেননি শৈলেন্দ্রবাবু। তাঁর সাফ কথা, “গ্রামের লোকের এ সব কুসংস্কার আমি মানতে পারছি না। শালিকের মৃত্যু যে অসুস্থ হয়েই হয়েছে, তা আমাকে বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণ করতেই হবে।” মরা শালিক নিয়ে বেলগাছিয়ায় এ দিনই হাজির হন তিনি। কিন্তু তত ক্ষণে ঘড়ির কাঁটা পেরিয়েছে সাড়ে ৫টা। দফতর বন্ধ। বাড়ি ফিরে এসেছেন শৈলেন্দ্রবাবু। আজ, বুধবার সকালে ফের সেখানে যাবেন বলে জানালেন।
এ দিকে, বেলগাছিয়ায় যাওয়ার আগে আর এক কাণ্ড করে বসেছেন তিনি। মরা শালিক হাতে ঝুলিয়ে সটান হাজির হন হাবরা থানায়। বলেন, ডায়েরি করতে চান। পুলিশের চক্ষু চড়কগাছ। শালিকের অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করা যাবে কি না, গেলেও তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, ময়না-তদন্তের জন্য কোথায় পাঠানো হবে মরা পাখির দেহ এ সব সাতপাঁচ ভেবে কর্তব্যরত পুলিশকর্মীদের কপালে ঘাম বেরোনোর জোগাড়। অনেক শলা-পরামর্শ করে শেষমেশ শৈলেন্দ্রবাবুর কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ নেওয়া হয়েছে। পুলিশের এক কর্তা এ দিন বলেন, “শালিকের ময়না-তদন্ত সত্যি করানো যাবে কি না, জানি না। কিন্তু উনি বিজ্ঞানের জন্য যে লড়াই শুরু করেছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়।”
পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞানমঞ্চের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক সৌরভ চক্রবর্তী বলেন, “গ্রামের মানুষের চাপের মুখে দাঁড়িয়ে ওই ব্যক্তি যুক্তির উপরে নির্ভর করে যে দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন, তা সত্যিই অসাধারণ।” শৈলেন্দ্র বলেন, “পশুপাখি ভালবাসি। এ ভাবে দু’টো শালিকের মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না। তার উপরে দু’টি নিরীহ পাখির মৃত্যুতে লোকে বাণমারার যে গল্প ফাঁদছে ও সবে মোটে বিশ্বাস নেই। কিন্তু সকলকে মুখের মতো জবাব দিতে হলে বৈজ্ঞানিক ভাবে শালিকের মৃত্যুর কারণ আমাকে বের করতেই হবে।” |