প্রবন্ধ ২...
আত্মহনন নিয়ে তরজা
বরং, কৃষকের কথা ভাবুন
র্ধমান জেলা পশ্চিমবঙ্গের শস্যগোলা। সব রকমের চাষের সুবিধায় বর্ধমানের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলার কোনও তুলনাই হয় না। সেই বর্ধমানে ঋণভারে কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা শুধু আশ্চর্যই করে না, শঙ্কিতও করে। পূর্বস্থলীর ১নং ব্লকের চণ্ডীপুর গ্রামের তাপস মাঝি ১৫ জানুয়ারি আত্মহত্যা করেছেন। পঁয়ত্রিশ বছরের জোয়ান ছেলে। ঘরে স্ত্রী। দু’টি কিশোরী কন্যা স্কুলে পড়ে। কিছু দিন আগে বড় মেয়েকে সাইকেল কিনে দিয়েছেন। তাদের বইপত্র, টিউশন, কোনও কিছুরই অভাব রাখতে চাননি। সাকুল্যে পঁচিশ কাঠা জমির ফসল ছাড়া অন্যের জমিতে যেখানে পেতেন কাজ করতেন। চার জনের সংসারের অভাব তাতে মিটত না। স্ত্রী পূর্ণিমা মেয়েদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য। ধার করে গাই কিনেছেন। এখনও দুধ দেওয়ার সময় হয়নি। কিন্তু ধারের টাকা মাসান্তে শোধ করতে হত তাপসকেই। তাপসের দাদা গদাধর বলেন, ‘সেই লোন দুশো টাকা, মেয়েদের প্রাইভেট টিউটরের তিনশো টাকা। এই পাঁচশো টাকা মাসের প্রথমে তাপসকে জোগাড় রাখতেই হত। এ ছাড়া সংসার, অসুখ-বিসুখ, লৌকিকতা, পঁচিশ কাঠায় অত হয় না।’
কিন্তু এত দিন তো হয়েছে? এ প্রশ্নের জবাবে শুনতে হয়, কেবল চাষের খরচ বেড়েছে, তা নয়, সব খরচই বেড়েছে। তাই নানা কারণে কৃষককে ঋণ করতে হয়। সেই ঋণের সুদ কোনও কোনও জায়গায় মাসে ১০ শতাংশ পর্যন্ত। ফসল যে বার ভাল হয়, সে বার ঋণ শোধ হয়, আর যে বার হয় না, ঘরের জিনিস বিক্রি করতে হয়। এই চক্রেই ঘুরছে দৈনন্দিন বাঁচা। টাকা ধার আর তা শোধ করার নানা ধরনের কথা বলেন ওঁরা। ধান কাটার সময় হয়তো তিন হাজার টাকা ধার নেওয়া হল। ধান উঠলে টাকাটা শোধ করতে হবে। সঙ্গে এক বস্তা ধান (যার দাম কম করে পাঁচশো টাকা) সুদ হিসেবে। এই রকম শর্তে ধার নেন কেন? কৃষক উত্তর দেন, ‘না নিয়ে উপায় নেই। হাতে কাঁচা টাকা না থাকলে ধান কাটাব কী করে?’
তাপসের আত্মহত্যার পর, পুলিশ, সরকারি অফিসার, সাংবাদিক সবাই এসে জিজ্ঞেস করেছেন, কার কাছ থেকে তাপস ধার করেছিলেন? ওঁরা সকলকে বলেছেন, জানি না। কেন বলেছেন? যুক্তিটি অকাট্য। ‘প্রয়োজন হলে তো সেই মহাজনের কাছেই হাত পাততে হবে। বিপদের সময় যে টাকা দিল, তাকে পুলিশে দেব?’ মহাজন ছাড়া কৃষক এখনও অচল। সরকারের সেখানে কোনও ভূমিকা নেই। যেখানেই ঋণের কাহিনি শুরু হয়েছে, সেখানেই সকলেই প্রায় বলেছেন, গত বছর খরা আর অকাল বৃষ্টিতে চাষ মার খেয়েছে। তার পর আবার ধার করেই চাষ করতে হয়েছে। এ বার আবার অধিক ফলনে বাজারে দাম নেই। এই দুটো ধাক্কা ক্ষুদ্র কৃষকের অনেকেই সহ্য করতে পারেননি।
নিজেদের অসহায়তার কাহিনি বলতে বলতে সকলেই একাধিক বার চালকলের অসহযোগী ব্যবহারের কথা বলেন। সরকার যে দামই বেঁধে দিক না কেন, কোনও দিনই কৃষকের হাতে তা পৌঁছয় না। পোস্ট ডেটেড চেক প্রসঙ্গে তাঁদের দারুণ অসন্তোষ। ‘ফড়ে’রা যে ভাবে বাড়ি থেকে ধানের বস্তা নিয়ে যায়, সে ভাবে না নিলে অন্য কোনও ব্যবস্থায় কৃষকের সুবিধা নেই, এ কথাও তাঁরা বার বার বলেছেন। বলেছেন, নগদ দাম দেয় বলেই বস্তা প্রতি সরকারি দামের চেয়ে একশো টাকা বা তার বেশি লোকসানে তাঁরা ধান বেচেন।

প্রায় কোথাওই পঞ্চায়েত একশো দিনের প্রকল্পে কাজ করিয়ে নগদ অর্থ সঙ্গে সঙ্গে দেয় না। চণ্ডীপুরে আঠারো মাস আগে একটা পুকুর খোঁড়া হয়েছিল, তার পর আবার সম্প্রতি কাজ এসেছে। কাজেই ‘জব কার্ড’ থাকা না-থাকার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। কৃষি-নির্ভর আমাদের দেশের কৃষকের বংশপরম্পরায় ‘কৃষি’ বিষয়ে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান অসীম। কিন্তু বার বার মনে হয়েছে, প্রায় প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তনশীল ‘বাজার’ বিষয়ে তাঁদের কোনও ধারণাই নেই। সেখানে সরকারের সক্রিয় ভূমিকা বিশেষ প্রয়োজন।
কাগজে রাজনৈতিক দলগুলির রুচিহীন তরজা প্রতিদিন। যাঁরা আত্মহত্যা করেছেন, তাঁদের কৃষক বলা যায় কি না, বা আত্মহত্যা মানসিক ব্যাধি কি না! অবান্তর সব প্রশ্ন। সর্বত্রই কৃষি আর কৃষকের জয়গান, অথচ ঠিকঠাক একটি কৃষিনীতি আজ পর্যন্ত হল না। দরকার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ, যাতে বাজারের চাহিদা আর জোগানে কৃষকের নির্দিষ্ট কিছু ভূমিকা থাকে। সরকারি ঋণ ব্যবস্থাকেও কৃষকের দরজায় পৌঁছতে হবে। এখনও ফসল বিপণনে সরকারের ভূমিকা গৌণ। সেই ভূমিকা প্রধান হয়ে না উঠলে অন্য কোনও পথ নেই বাঁচার। সমবায় গঠন করে ফসল বিক্রির ব্যবস্থা, বা সমবায়ের মাধ্যমে ঋণ ব্যবস্থার কথাই যে শুধু বহুবার উঠেছে, তা নয়। অনেক জায়গায় কিছু কিছু চেষ্টাও হয়েছে। সেই চেষ্টা কার্যকর হয়নি নানা কারণে। সরকার যদি সত্যিই কৃষিকে বাঁচাতে চান, তা হলে সেই ব্যবস্থা কার্যকর করার চেষ্টা সরকারকেই করতে হবে। কারণ, তার ওপরই নির্ভর করছে আমাদের দেশের কৃষির ভবিষ্যৎ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.