প্রবন্ধ ১...
অনেক বিদ্যালয়ের পানীয় জলেও আর্সেনিক
ত ২৪ বছর ধরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ (এসওইএস)-এর সঙ্গে যুক্ত গবেষক ও চিকিৎসকেরা পশ্চিমবঙ্গের নলকূপের পানীয় জলে আর্সেনিকের সমস্যা নিয়ে গবেষণা করছেন। দেখা গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের মোট ১৯টি জেলার মধ্যে ১২টি জেলার ১১৩টি ব্লকের নলকূপের পানীয় জলে আর্সেনিক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবলিউ এইচ ও বা হু) নির্ধারিত মাত্রার (নির্ধারিত মাত্রা ০.০১ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারে) উপরে।
ভারতে গড়ে এক হাজার প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন প্রায় চার লিটার জল পান করেন। পানীয় জল ছাড়াও আরও প্রায় দু লিটার জল খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহণ করেন। শুধু তাই নয়, আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকাগুলি প্রধানত নিম্ন আর্থ-সামাজিক অঞ্চল। সেখানকার মানুষ পুষ্টিকর খাদ্য পান না। তাই বিজ্ঞানীরা মনে করছেন বাস্তবে আর্সেনিক দূষণ থেকে আরও অনেক মানুষই ক্যান্সার আক্রান্ত।
পশ্চিমবঙ্গে আর্সেনিকের সমস্যা প্রথম জানা যায় ১৯৮২ সালে। এই সমস্যাকে প্রথম দু’দশক বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়নি। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই সমস্যাকে কাগজে-কলমে খুব গুরুত্ব দিচ্ছে। রাজ্যের জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর ২০০৬ সালে তাদের একটি রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গে মোট জনসংখ্যার ৩৫.৬ শতাংশের আর্সেনিক বিপদের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে জানায়। বিপদ যে এতটা বেশি তা কিন্তু এসওইএস মনে করছে না।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার আর্সেনিক কবলিত অঞ্চলে হাজার হাজার গভীর নলকূপ বসিয়েছে নিরাপদ পানীয় জলের জন্য। কিন্তু ওই নলকূপগুলির প্রায় ৩০ শতাংশ আর্সেনিক কবলিত এলাকায়। সেগুলি দিয়ে বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিকযুক্ত জল বেরোচ্ছে। এমনকি, বহু প্রাথমিক স্কুলের পড়ুয়ারাও আর্সেনিক-যুক্ত জল পান করছে। একটি সমীক্ষা থেকে আমরা জেনেছি, উত্তর ২৪ পরগনা জেলার দেগঙ্গা ব্লকের পরীক্ষিত ২০৫টি প্রাথমিক ও উচ্চ-প্রাথমিক স্কুলের নলকূপের ৬১টি নলকূপের জলে বিপজ্জনক মাত্রার ১১ গুণ বেশি আর্সেনিক। এই অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছে, যে রাজ্যের সমস্ত জেলায় (দার্জিলিং বাদে) সব সরকারি প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানের উপযুক্ত জল সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে।
৩০ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানীয় জলে আর্সেনিকের উপস্থিতি জানা গিয়েছিল। কিন্তু বেশ কিছু বছর আগে পর্যন্ত গ্রামের মানুষের বড় অংশই জানতেন না যে, তাঁদের নলকূপের জলে আর্সেনিকের সমস্যার জন্যই চামড়ায় বিভিন্ন লক্ষণ ফুটে উঠেছে। কেউ বলতেন গত জন্মের পাপের ফল। কেউ বলতেন শয়তানের নজর লেগেছে। সাপ তার বিষ উগরে দেওয়াতেই এই বিষক্রিয়া। পাঁচ-সাত বছর ধরে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু, আজও গ্রামবাসীরা মনে করেন, আর্সেনিক ছোঁয়াচে রোগ। এই রোগ থেকে মুক্তি পেতে মানুষ মাদুলি নেন, ঝাড়-ফুঁক করান।
বিষকুম্ভ। আর্সেনিক আক্রান্ত গ্রামের শিশুরা।
সৌজন্য: স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
“ডাক্তারবাবু আমার দেহের সব রক্তটুকু নিয়ে আমার বোনকে দিয়ে ওর ওই চামড়ার দাগগুলো দূর করে দিন। রক্তের দোষের জন্য ওর ওই দাগ। ওই দাগের জন্য ওকে বিয়ে দিতে পারছি না”-- নদিয়ার তেহট্ট ব্লকের এক যুবক এই কয়েকটি কথা বলে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। মালদহের ইংলিশবাজারের একটি মেয়ের বাবা অনেক টাকা পণ দিয়ে তার বিয়ে দেন। কিন্তু, শ্বশুরবাড়ির লোকেরা সেই মেয়েটির হাতের রান্না খেতেন না। ওর বাসন আলাদা করে দেওয়া হয়েছিল। সন্তানসহ এক সময় তাঁকে বাপের বাড়ি ফিরিয়ে দিলেন স্বামী।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার রামনগরের এক কলেজপড়ুয়া। ওঁর বাড়িতে সবাই আর্সেনিকে আক্রান্ত। ছেলেটি আমাকে ওঁদের সামাজিক সমস্যাগুলি জানিয়েছিলেন। আমি ওঁর একটা টিভি অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে দিই যাতে তিনি মানুষকে জানাতে পারেন যে, আর্সেনিক ছোঁয়াচে রোগ নয়। তিনি রাজিও হয়েছিলেন, কিন্তু পরে চিঠি দিয়ে জানান ওই অনুষ্ঠানে আসতে পারবেন না। আসলে সবাই তাঁর রোগ জানতে পেরে যাবে, তাঁকে একঘরে করে দেবে, সামাজিক সমস্যা হবে।

১৭ বছর বয়সে শামিম বিবির বিয়ে হয়েছিল উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গা ব্লকের কালীঘানি গ্রামের সেলিমের সঙ্গে। সেলিম বাড়িতে বসে সেলাইয়ের কাজ করত। শামিমের বাবা আরও সামর্থ্যমতো মেয়ের বিয়ে দিলেন। জমি বন্ধক রেখে ১৪ হাজার টাকা পণ দিলেন। ফুলসজ্জার রাতেই শামিম প্রথম তাঁর স্বামীকে দেখলেন। শামিমের কথায়, ‘সাপের খোলসের মতো’ সেলিমের দেহ। শুধু মুখে কোনও বিকার নেই। সেলিম বলেছিলেন, ওই সব চিহ্ন বংশগত এবং ওঁর পরিবারের সবারই শরীরে কমবেশি রয়েছে। শামিমের বিবাহিত জীবন সংক্ষিপ্ত এবং মর্মান্তিক। এর মধ্যে শামিমের একটি সন্তান হয়। বিয়ের পর চার বছর সেলিম বাড়িতে বসে সামান্য কাজকর্ম করতে পেরেছিলেন। তার পর কর্মক্ষমতা হারান। শামিমকে ধরতে হয় সংসারের হাল। লোকের বাড়িতে বাসন মাজার কাজ আর অল্প-অল্প সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালাতেন। এর পর সেলিম হাসপাতালে ভর্তি হলেন। শামিমের বাবা বন্ধক জমি বিক্রি করে জামাইয়ের চিকিৎসার টাকা দিলেন। ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে ২৫ বছরের সেলিমের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর কারণ হিসেবে ‘ডেথ সার্টিফিকেট’-এ দায়ী করা হয়, আর্সেনিক এবং লিভার সিরোসিসকে।
এই সূত্রে নদিয়া জেলার চাকদহ ব্লকের ঘেটুগাছি গ্রামের কথা মনে পড়ে। ‘বিধবার গ্রাম’ বলে পরিচিত ওই গ্রামে মেয়ের বিয়ে দিতে চান না কেউ-ই। ওই গ্রামের ভূগর্ভস্থ পানীয় জলে প্রচণ্ড আর্সেনিক। সেখানকার পুরুষদের জীবনকাল কম। ঘেটুগাছি গ্রামের অভিভাবকরা দূরের কোনও এলাকা থেকে পুত্রবধূ নিয়ে আসেন। ফলে, সেই গ্রামে মেয়েরা বেশি দিন বাঁচেন, কিন্তু, অনেকেরই স্বামীর মৃত্যু হয়। আর্সেনিক আক্রান্ত নানা জেলায় এমন বহু গ্রাম রয়েছে।
আর্সেনিকের প্রভাবে শরীর দুর্বল হয়ে যায়। যুবকরাও মাঠে-ঘাটে কাজ করার ক্ষমতা হারান। রোদ সহ্য করতে পারেন না। ঘরের বাইরে কাজ করতে না-যেতে পারায় কটু কথা শুনতে হয়। অনেকে আত্মহত্যাও করেন। চাষ করতে না-পারলে আর্থিক অনটনের সন্মুখীন হয় কৃষক পরিবারগুলি। এমন পরিস্থিতিতে সংসার চালাতে মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিতে বাধ্য হন অনেকেই। আসল মেটানো দূরের কথা, সুদের টাকা দিতেই বাধ্য হয়ে বাড়ির বাসনকোসন, টুকিটাকি গয়না এবং শেষে জমি বেঁচে দিতে হয় তাঁদের।

আর্সেনিক কবলিত জল পান করার ফলে মাতৃগর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল এত দিন। সেই আশঙ্কা এখন বাস্তব। “ডাক্তারবাবু, আমার শাশুড়ি আমার স্বামীর ফের বিয়ে দিতে ছাইছেন। আমার পরপর তিনটি গর্ভপাত হয়েছে। তাতেই শাশুড়ির ধারণা, আমাকে দিয়ে বংশ রক্ষা হবে না,”এক মহিলার জবানবন্দি। তিনি যে নলকূপের জল পান করতেন, তাতে আর্সেনিকের পরিমাণ ছিল পানীয় জলে স্বাভাবিক আর্সেনিকের মাত্রার চেয়ে ১৪০ গুণ বেশি। ওই মহিলার মূত্রেও আর্সেনিকের পরিমাণ ছিল স্বাভাবিকের তুলনায় ৫০ গুণ বেশি।
১৯৯২ সালের জানুয়ারি মাসে মুর্শিদাবাদ জেলার ভগবানগোলা ব্লকের আঘরিগঞ্জ গ্রামপঞ্চায়েতের মদনপুর গ্রামে বহু শিশুর শরীরে আর্সেনিকের চিহ্ন খুঁজে পান চিকিৎসকেরা। ছোট্ট ওই গ্রামে যাতায়াতের পাকা রাস্তা নেই। গ্রামে ৩০-৩৫টি পরিবারের বাস। ফি-বছর বর্ষাকালে জলে ডুবে যায় ওই গ্রামের অনেকটাই। গ্রামে ঢুকবার সঙ্গে সঙ্গেই ২০-২৫ জন বছর আট-দশের বাচ্চা ঘিরে ধরল। সকলেই অপুষ্টির শিকার। তাদের মধ্যে অনেকেরই গায়ে আর্সেনিক-আক্রমণের চিহ্ন। এত অল্পবয়সি কোনও শিশুর দেহে আর্সেনিকের চিহ্ন তখনই ফুটে ওঠে, যখন পানীয় জলে খুব বেশি পরিমাণে ওই ‘বিষ’ মিশে থাকে এবং একই সঙ্গে কেউ অপুষ্টিতে ভোগে। পেটভর্তি ভাতই মেলে না অনেকের। ১০ বছর বাদে, ২০০২ সালে ওই গ্রামে ফিরে একই দৃশ্য দেখে মনে হল, আর্সেনিকের কবল থেকে বাঁচার উপায় নেই মদনপুরের শিশুদের।

কলকাতার যাদবপুরের নারকেলবাগানে থাকতেন অসীম রায়। আর্সেনিক আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। ক্যানসারের জন্য তাঁর একটি আঙুল কাটতে হয়েছিল। অসীমবাবুর ইলেকট্রনিক্স-এ ডিপ্লোমা ছিল। শরীর খারাপের জন্য চাকরি ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে। ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। স্বাস্থ্যজনিত কারণে ব্যবসাও চালাতে পারছিলেন না ঠিকঠাক। ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ শোধ করার জন্য চাপ বাড়তে থাকে। এক দিকে স্বাস্থ্যের সমস্যা, অন্য দিকে ব্যাঙ্কের চাপ দুইয়ের মধ্যে পড়ে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন অসীমবাবু। শোনা যায়, এ সবের জেরে আত্মহত্যা করেছিলেন তিনি।
কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে কাজ করতেন অভিজিৎ বসু। আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৯ সালে চিকিৎসার জন্য তাঁকে ভর্তি করা হয় এসএসকেএম হাসপাতালে। যদিও সরকারি ভাবে সে সময় স্বীকার করা হয়নি, কলকাতা শহরও আর্সেনিক কবলিত। ৩৬ বছর বয়সে লিভার সিরোসিস-এ মৃত্যু হয় অভিজিৎবাবুর। স্ত্রী এবং বছর ছ’য়েকের মেয়েকে রেখে।

২০১০ সালের ৩০ অক্টোবর, যাদবপুরের ‘এসওইএস’ উত্তর ২৪ পরগনার ৬টি ব্লকের (বসিরহাট, বাদুড়িয়া, হাবড়া, হাসনাবাদ, দেগঙ্গা, স্বরূপনগর) ১৩টি গ্রাম থেকে প্রায় ৩০০ জন আর্সেনিক আক্রান্ত রুগীকে বাদুড়িয়া ব্লকের চকখোড়গাছি গ্রামে একত্রিত করে। তার মধ্যে ৭০ জন ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আর্সেনিক টাস্ক ফোর্স, জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর, স্বাস্থ্য কর্তাদের বাস্তব পরিস্থিতি দেখাতেই আর্সেনিক-আক্রান্ত রুগীদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। সরকারের ওই সব দফতরের কর্তারা সে সব দেখে জানিয়েছিলেন, এ রাজ্যে আর্সেনিকের প্রভাব যে এতটা মারাত্মক তা বোঝা যায়নি।
সাম্প্রতিক সমীক্ষায় বসিরহাটের সংগ্রামপুর শিহাটি পঞ্চায়েত এলাকার পশ্চিম মেরুদণ্ডি গ্রামের ৫৫টি পরিবারের মধ্যে ২১ জন আর্সেনিক-আক্রান্ত রুগীর সন্ধান মিলেছে। তাঁদের দেহে ক্যানসারও আছে। এর মধ্যে একটি পরিবারেরই পাঁচজন ক্যানসারে মারা গিয়েছেন।

লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ-এর রিসার্চ ডিরেক্টর


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.