জলই জীবন। অথচ সেই জলেই বিষের ছোবল! অজান্তেই আর্সেনিক ছড়িয়ে পড়ছে কোষে-কোষে। সরকারি ব্যবস্থা অপ্রতুল। এই ব্যাধির আরোগ্য কোন পথে? খোঁজ নিচ্ছে আনন্দবাজার। আজ শেষ কিস্তি।
পূর্বস্থলীর দু’টি ব্লকের প্রত্যেকটিতে রয়েছে একটি করে স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এ ছাড়াও রয়েছে প্রায় আটটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এলাকায় আর্সেনিকোসিস রোগের প্রকোপ থাকলেও এই সব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তার চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থা নেই, অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। শুধু পূর্বস্থলী এলাকায় নয়, কালনা মহকুমা হাসপাতাল বা জেলা হাসপাতালেও এই রোগের উপযুক্ত চিকিৎসা মেলে না বলে অভিযোগ।
আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত নিরুপমা ভৌমিক, রাকেশ সরকারদের দাবি, চিকিৎসার জন্য তাঁদের ছুটতে হয় কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালে। তাঁদের দাবি, আক্রান্তেরা বেশির ভাগই গরিব। মোটা টাকা খরচ করে চিকিৎসা করাতে অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়েছেন। অনেকে আবার চিকিৎসার অভাবে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গিয়েছেন।
বাসিন্দাদের আরও অভিযোগ, চিকিৎসা তো দূর, সারা মহকুমা জুড়ে কোথাও আর্সেনিকোসিস রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থাও নেই। ফলে প্রাথমিক ভাবে শরীরে ফুটে ওঠা চিহ্ন দেখে পূর্বস্থলীর বাসিন্দারা অনুমান করতে পারেন না সেটি দাদ বা হাজার মতো কোনও চর্মরোগ, না কি আর্সেনিকোসিস। অভিযোগ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগীরা চিকিৎসা করাতে গিয়ে বিভ্রান্ত হন। অসাবধানতা থেকে বেড়ে যায় আর্সেনিকোসিস।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বছর পাঁচেক আগে আর্সেনিকোসিস আক্রান্তদের চিকিৎসা চেয়ে আন্দোলন শুরু হলে পূর্বস্থলী ১ ব্লকে শ্রীরামপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একটি ক্লিনিক খোলা হয়। ঠিক হয়, সপ্তাহে এক দিন করে সেখানে পরিষেবা মিলবে। কিন্তু কয়েক মাস পরেই ক্লিনিকটি বন্ধ হয়ে যায়। কালনার সহকারী মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক (এসিএমওএই) সুভাষচন্দ্র মণ্ডল বলেন, “সেই সময়ে ব্লক হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত কয়েক জন চিকিৎসককে আর্সেনিকোসিসের ব্যাপারে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। ওই চিকিৎসকেরা বদলি হয়ে যাওয়ার পরে নতুন করে প্রশিক্ষণের কাজ আর হয়নি।” কালনা মহকুমা হাসপাতালে আন্ত্রিক, যক্ষ্মা-সহ নানা রোগের চিকিৎসার জন্য রয়েছে পৃথক বিভাগ। অথচ পূর্বস্থলীর দু’টি ব্লক জুড়ে বহু আর্সেনিকোসিস আক্রান্ত থাকা সত্ত্বেও মহকুমা হাসপাতালে তাঁদের চিকিৎসার জন্য আলাদা কোনও বিভাগ নেই। এসিএমওএই সুভাষবাবুর আশ্বাস, “কয়েক জন চিকিৎসককে আর্সেনিকোসিসের ব্যাপারে আলাদা ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া ও মহকুমা হাসপাতালে আক্রান্তদের জন্য ইউনিট খোলার জন্য জেলা প্রশাসনকে জানাব।”
আর্সেনিকোসিসের লক্ষণ কী, এই রোগে কী ধরণের খাবার খাওয়া উচিত বা আর্সেনিকোসিস এড়ানোর জন্য কী করা উচিত, এ সব নিয়ে কোনও সরকারি প্রচারও নেই বলে অভিযোগ পূর্বস্থলীর বাসিন্দাদের। এসিএমওএইচ সুভাষবাবুর সাফাই, “পূর্বস্থলীর মানুষ বিষয়টি নিয়ে সচেতন। তাই আলাদা করে আর প্রচার প্রয়োজন হয় না।” যদিও বাসিন্দারা অন্য কথা বলেন। পূর্বস্থলী ২ ব্লকের কল্যাণপুরের বাসিন্দা মাসুদ শেখের কথায়, “আর্সেনিকোসিস আক্রান্তদের নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। অনেকেই ছোঁয়াচে ভেবে এই রোগে আক্রান্তদের আশপাশে আসতে চান না। এমনকী, পরিবারে কারও আর্সেনিকোসিস থাকলে অনেক সময়ে ছেলে-মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধও ভেস্তে যায়। এই রোগ সম্বন্ধে এমন ভ্রান্ত ধারণা কাটাতে প্রশাসনের এগিয়ে আসা উচিত।”
বছরের পর বছর ধরে বেড়েছে আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা। তবুও পূর্বস্থলীতে কোথাও গড়ে ওঠেনি জল পরীক্ষাগার। জেলা পরিষদের উদ্যোগে কয়েক বছর আগে একটি জল পরীক্ষাগার তৈরি হয় মন্তেশ্বরের কুসুমগ্রামে। তাঁদের এলাকা থেকে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার দূরে এই জল পরীক্ষাগার নিয়ে অবশ্য কোনও উৎসাহ দেখাননি পূর্বস্থলীর মানুষজন। তবে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে সরকারি টিউবওয়েলগুলির জল পরীক্ষা করা হয় ওই পরীক্ষাগারটিতে। কিন্তু ব্যক্তিগত মালিকানাধীন টিউবওয়েলগুলির ক্ষেত্রে তা হয় না। পূর্বস্থলী ১ ব্লকের শ্রীরামপুর পঞ্চায়েতের প্রধান মনোজ মণ্ডল বলেন, “সরকারি টিউবওয়েলে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের সন্ধান পেলে আমরা সেটি ‘সিল’ করে দিই। তবে বেসরকারি কোনও টিউবওয়েলের জল পরীক্ষা করাতে হলে যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি এই কাজ করে, তাদের ডেকে পাঠাতে হয়। জলের নমুনা নিয়ে যাওয়ার সময়ে প্রতি বার একশো টাকা করে দিতে হয়।”
গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে পূর্বস্থলার আর্সেনিকোসিস আক্রান্তেরা নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে মহকুমাশাসকের কার্যালয়ে ধর্ণায় বসেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে একপ্রস্থ আলোচনাও করেন মহকুমাশাসক সুমিতা বাগচি। তিনি বলেন, “পূর্বস্থলী দক্ষিণ কেন্দ্রের বিধায়ক এবং জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরকে এ ব্যাপারে রিপোর্ট দিতে বলেছি।” সেই রিপোর্ট জমা পড়বে কবে, তার প্রেক্ষিতে কী-ই বা ব্যবস্থা হবে, এ সব প্রশ্নের অবশ্য কোনও সদুত্তর নেই। |