এক দিকে, জিটিএ চুক্তি নিয়ে কেন্দ্রের ছাড়পত্র না-মেলায় পাহাড়ের ক্ষোভ-হতাশা এবং গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার আন্দোলনের হুমকি। অন্য দিকে, তিনটি সরকারি উৎসবে শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানানোর ক্ষেত্রে দলতন্ত্রের অভিযোগে উত্তরবঙ্গের ছয় জেলায় সংশ্লিষ্ট মহলে ঝড়। এমনই নানাবিধ ক্ষোভ ও সমালোচনার প্রেক্ষাপটে আজ, শুক্রবার দু’দিনের সফরে শিলিগুড়ি পৌঁছচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা জিটিএ গঠন নিয়ে ত্রিপাক্ষিক চুক্তিটি সম্পাদিত হয়েছিল তৃণমূল জোট সরকার গঠনের দু’মাসের মধ্যে। পাহাড়-সমতলে শান্তি ফেরায় মুখ্যমন্ত্রীকে ঘিরে প্রত্যাশার পারদ চড়ে দার্জিলিং থেকে ডুয়ার্স, সর্বত্র। তবে চুক্তি সইয়ের পরে প্রায় সাত মাস হতে চললেও কেন্দ্রের তরফে জিটিএ গঠন নিয়ে ছাড়পত্র মেলেনি। ফলে পাহাড়ে ক্ষোভ-হতাশা বেড়েছে। আর তা আঁচ করে মুখ্যমন্ত্রীর সফরের প্রাক্কালে কেন্দ্র ও রাজ্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। বৃহস্পতিবার অবশ্য মুখ্যসচিব সমর ঘোষ মহাকরণে জানিয়েছেন, চুক্তিটি নিয়ে কিছু কিছু বিষয়ে রাজ্য সরকারের ব্যাখ্যা চেয়ে পাঠিয়েছে কেন্দ্র।
মুখ্যমন্ত্রীর সফরের মুখে প্রত্যাশার সঙ্গে এমন সব বিতর্ক আর সমালোচনায় কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে পড়েছেন উত্তরবঙ্গের নেতা-কর্তা-মন্ত্রীদের অনেকেই। |
সরকারি সূত্রের খবর, প্রথমে শিলিগুড়ির দীনবন্ধু মঞ্চে অন্তত ১৬ জন মন্ত্রীর উপস্থিতিতে উত্তরবঙ্গের ছয় জেলার প্রায় ৪০০ জন অফিসারের সঙ্গে বৈঠক করবেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পরে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে উত্তরবঙ্গ উৎসবের উদ্বোধন করবেন তিনি। সেই সঙ্গে পাহাড়-সমতলের ক্ষোভ-অভিযোগ প্রশমিত করতে একগুচ্ছ উন্নয়ন প্রকল্পের কথা মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করবেন। বর্তমান গোর্খা পার্বত্য পরিষদের জন্য আরও অর্থ বরাদ্দ হতে পারে। মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে থাকবেন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী। রেল সূত্রের খবর, সফরের দ্বিতীয় দিনে বাগডোগরায় মুখ্যমন্ত্রীর হাত ধরে চালু হবে নতুন একাধিক ট্রেন। আইটি হাব-ও চালু হওয়ার কথা। পাশাপাশি, জিটিএ গঠনের প্রক্রিয়া যাতে দ্রুত কেন্দ্রের ছাড়পত্র পায়, সে জন্য রাজ্যের পক্ষ থেকে দিল্লিতে চাপ বাড়ানোর বিষয়েও বার্তা দিতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী।
দক্ষিণবঙ্গে জঙ্গলমহলের মতোই উত্তরবঙ্গের পাহাড়-সমতলের উন্নয়নের ব্যাপারে তাঁরা আন্তরিক বলে ক্ষমতা দখলের পর থেকেই আশ্বাস দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। রেলের কিছু প্রকল্পের কাজ হচ্ছে। কিন্তু তৃণমূল জোট সরকার উত্তরবঙ্গে ছোট-বড় বা মাঝারি শিল্প গড়ার কাজ শুরু করাতে পারেনি। কোচবিহারে উড়ান চালু হয়েও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। উত্তরের ছয় জেলার হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজের হাল ফেরানোর কাজও ঢিমেতালে এগোচ্ছে বলে অভিযোগ। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতি মামলায় চার্জশিটের অনুমতি দেওয়া নিয়ে ‘টালবাহানার বর্ষপূর্তি’ হতে চলেছে।
এ সব সত্ত্বেও নানা দুর্যোগ, দুর্ঘটনার খবর পেলেই পাহাড়-সমতলে ছুটে গিয়ে দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। আর্থিক সাহায্যের আশ্বাসও দিয়েছেন। ওই ‘সহমর্মিতা’ দেখে এলাকাবাসী ‘মুগ্ধ’ হয়েছেন ঠিকই, তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়-সমতলের ছবি কিছুটা যেন অন্য রকম ঠেকছে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের অনেকের কাছে। |
যেমন, বিজনবাড়ির সেতু দুর্ঘটনা কিংবা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তরা আজও সকলে ঘোষিত সরকারি ক্ষতিপূরণ পাননি বলে অভিযোগ। এই নিয়ে দার্জিলিং-শিলিগুড়িতে ক্ষোভ রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে প্রায় সওয়া ২ কোটি টাকা খরচ করে যেখানে শিলিগুড়ি শহর ও লাগোয়া এলাকা সাজতে ভিন্ন ধরনের বাতিস্তম্ভ ও আলো লাগানো হয়েছে, প্রায় ২ কোটি টাকা বাজেটের উত্তরবঙ্গ উৎসব সফল করতে শিলিগুড়ি পুরসভার প্রায় সব তৃণমূল কাউন্সিলর দিনরাত এক করে খাটছেন, সেখানে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত পুরবাসীদের জন্য আসা টাকা বিলি করার ক্ষেত্রে তাঁরা তৎপরতা দেখাতে পারেননি কেন? এই নিয়ে দুর্গতদের ক্ষোভ তুঙ্গে।
উত্তরবঙ্গ উৎসব, ভাওয়াইয়া উৎসব এবং চা-বাগিচা উৎসব ঘিরেও রাজ্যের শাসক জোটের অন্দরে-বাইরে বিস্তর ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। কংগ্রেসের বিধায়ক-মন্ত্রীরা অভিযোগ করেছেন, তাঁদের এড়িয়ে সব উৎসব করা হচ্ছে। মালদহের গম্ভীরা, বালুরঘাটের নাটকের দল, রায়গঞ্জের যাত্রা দল ও উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া-সহ নানা ক্ষেত্রের কলাকুশলীদের একটি বড় অংশের অভিযোগ, উৎসবে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে। এমনকী, তৃণমূলের অন্দরেও মণ্ডপ, গাড়ি ভাড়া, খাওয়া-দাওয়ার বরাত পাওয়া নিয়ে গোষ্ঠী কোন্দল প্রকাশ্যে এসেছে।
ঘটনা হল, এই সব খবর ‘নিজস্ব নেটওয়ার্কের’ মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অনেকটাই পৌঁছেছে। ইতিমধ্যেই উৎসবের উদ্যোক্তাদের তৃণমূলের প্রদেশ দফতর থেকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, উত্তরবঙ্গের পাহাড়-সমতলের উন্নয়নের ব্যাপারে তিনি যে ঢিলেমি করতে চান না, তা ফের স্পষ্ট করে দিতে দু’দিনের সফরে অন্তত ১১টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করার কথা মুখ্যমন্ত্রীর।
পাহাড়ের সমস্যা মেটাতেও মুখ্যমন্ত্রী যে গোড়া থেকেই যথেষ্ট আন্তরিক, সেই প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন তৃণমূলের উত্তরবঙ্গের কোর কমিটির এক নেতা। তিনি জানান, কেন্দ্রের পক্ষ থেকে পাহাড় নিয়ে ত্রিপাক্ষিক চুক্তির ব্যাপারে আরও সময় চাওয়া হয়েছিল। শেষে মুখ্যমন্ত্রীর চাপে চুক্তিটি গতি পায়। তরাই-ডুয়ার্সের অংশ জিটিএ-র আওতায় দেওয়ার দাবি খতিয়ে দেখতে যখন কমিটি গড়া হয়, তখন আদিবাসী বিকাশ পরিষদ-সহ সমতলের ২২টি সংগঠন আন্দোলনে নেমেছিল। তাদেরও আশ্বস্ত করেন মুখ্যমন্ত্রী।
বর্তমানে পাহাড়ের যা পরিস্থিতি, তাতে দ্রুত জিটিএ গঠনের ছাড়পত্র না-মিললে পরিস্থিতি ফের অশান্ত হওয়ার আশঙ্কা। সেটা তৃণমূল নেতারা তো বটেই, সরকারি কর্তারা অনেকেই মানছেন। তাঁদের একাংশের বক্তব্য, “সুবাস ঘিসিংয়ের সঙ্গে ষষ্ঠ তফসিল চুক্তি সইয়ের পরে কেন্দ্র তাতে সিলমোহর দেওয়া নিয়ে টালবাহানা করায় পাহাড়ের পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়। আঁচ পড়ে সমতলেও। জিটিএ গঠনে ছাড়পত্র পেতে দেরি হলে ফের পাহাড়-সমতলে অশান্তির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মুখ্যমন্ত্রী তা হতে দেবেন না।”
পাহাড়-সমতলের এ হেন ক্ষোভ-বিক্ষোভ, হতাশা-অনুযোগ নিয়ে আজ, উৎসবের মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী কী বার্তা দেন, তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে উত্তরবঙ্গ। |