সুনির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে রাজ্যের আর্থিক দাবি আদায় করতে চাইলে ‘সহযোগিতা’ করতে তারা রাজি বলে ফের জানাল রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সিপিএম। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্রের কাছে সংবিধান-সম্মত দাবি জানাতে রাজ্যের শাসক ও বিরোধী পক্ষ একসঙ্গে যেতেই পারে। কিন্তু রাজ্য সরকার এমন সব দাবি করছে, যা থেকে কোনও নীতি স্পষ্ট হচ্ছে না। যার ফলে কেন্দ্রের কাছে সব রাজ্য মিলে একসঙ্গে বা এ রাজ্যের শাসক-বিরোধী পক্ষের যৌথ দরবার, কোনওটাই সম্ভব হচ্ছে না।
রাজ্যের জন্য আর্থিক সাহায্যের প্রশ্নে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় মুখপাত্র অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি এবং রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের মধ্যে যে বিবৃতি-যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তার প্রেক্ষিতে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বৃহস্পতিবার বলেছেন, “রাজ্যের দাবি আদায়ে আমরা সবাই একসঙ্গে যেতে পারি, কলকাতায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবিপত্র জমা দেওয়ার সময়েই সেই কথা রাজ্য সরকারকে জানিয়েছিলাম। যেমন, সংবিধান-প্রদত্ত অধিকার হিসাবে কয়লার সেস এবং রয়্যালটি বাবদ রাজ্যের প্রাপ্যের জন্য অর্থমন্ত্রী দাবি করতেই পারেন। আমরা তাঁকে সমর্থন করব। কোনও নীতির ভিত্তিতে দাবিকরলে আমরা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। একসঙ্গে যেতে পারি। কিন্তু যে দাবিগুলো করা হচ্ছে, সেগুলো সুনির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে নয়।” প্রাক্তন মন্ত্রী সূর্যবাবুর বক্তব্য, একে তো রাজ্য সরকার একটা গোটা আর্থিক বছর বাজেট ছাড়াই চালিয়ে দিল! উপরন্তু, নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই যত্রতত্র ব্যয় করে রাজ্য সরকার নিজেদের আর্থিক নীতিই স্পষ্ট করতে পারছে না। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সূর্যবাবু স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, আয়লা-বিপর্যয়ের পরে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার যাতে কেন্দ্রের কাছে ত্রাণের প্যাকেজ না-পায়, তার জন্য তৃণমূল ‘সক্রিয়’ হয়েছিল। কিন্তু এখন তৃণমূলের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের আর্থিক সঙ্কটের সময় তাঁরা অহেতুক বিরোধিতা করতে চান না বলে বিরোধী দলনেতার বক্তব্য। সূর্যবাবুর কথায়, “তৃণমূল এত দিনে কিছুটা হলেও উপলব্ধি করেছে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্ক জিনিসটা কী! রাজ্য চালাতে গেলে কী প্রয়োজন, তারা বুঝছে। কিন্তু ওই রাজ্য এটা পেয়েছে, সেই রাজ্য সেটা পেয়েছে, এ ভাবে বলতে থাকলে রাজ্যগুলিকে নিয়ে মিলিত ভাবে কেন্দ্রের কাছে দাবি জানানো যাবে না।” সিপিএম নেতৃত্ব উদাহরণ দিচ্ছেন, ভ্যাট নিয়ে ‘ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি’র চেয়ারম্যান হিসাবে বাম জমানার অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের নেতৃত্বে রাজ্যগুলি যে ভাবে কেন্দ্রের কাছে দাবি জানিয়েছিল সংগৃহীত মোট রাজস্বের ৫০% রাজ্যগুলিকেই ফেরত দিতে হবে, অমিতবাবুদের নীতির অস্পষ্টতার জন্যই তা আর হচ্ছে না।
বস্তুত, আর্থিক সাহায্য নিয়ে কেন্দ্রের কংগ্রেস নেতৃত্ব এবং রাজ্য সরকার তথা তৃণমূল সরকারের মধ্যে বিবৃতির লড়াই চরমে উঠছে! অমিতবাবু এ দিনই মহাকরণে সিঙ্ঘভির দাবি নস্যাৎ করেন। ১০ মিনিটের মধ্যেই দিল্লির এআইসিসি দফতর থেকে সিঙ্ঘভি পাল্টা কটাক্ষ করেন, অমিতবাবু ‘গোলপোস্ট’ সরানোর চেষ্টা করছেন! এক বার বলছেন, কেন্দ্র অর্থ অনুমোদন করেছে, টাকা হাতে আসেনি। আর এক বার বলছেন, যা হাতে এসেছে, তা রাজ্যের অধিকার। সিঙ্ঘভির বক্তব্য, “আসল প্রশ্ন হল, রাজ্য অর্থ পেয়েছে কি না! পশ্চিমবঙ্গ যে অর্থ পেয়েছে, তা তথ্যেই স্পষ্ট।” বিবৃতি-যুদ্ধের সূত্রে সূর্যবাবু বলেন, “পারিবারিক কলহ আর রাজ্যে সীমাবদ্ধ নেই! দিল্লি থেকে বিবৃতি হচ্ছে, মহাকরণ থেকে পাল্টা বিবৃতি চলছে। এই রকম রোজ চললে শান্তিতে বাস করাই মুশকিল!” অমিতবাবুর দাবি, ঋণের বোঝা সামলাতে রাজ্যের জন্য তিন বছর আসল ও সুদ পরিশোধ মকুব করা হোক। সূর্যবাবুর মতে, “এই রকম কোনও নজির এখানে নেই। ঋণ পুনর্গঠনের দাবি অবশ্যই জানানো যেতে পারে।” বিরোধী দলনেতার বক্তব্য, রাজ্য ইতিমধ্যেই চলতি বছরে ২০ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা ঋণ করেছে। যা বাম জমানা তো বটেই, অন্যান্য রাজ্যকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর ‘মুখের কথা’য় আর্থিক বরাদ্দ হচ্ছে। সূর্যবাবুর মন্তব্য, “অথচ পরিবহণ কর্মীদের পেনশন-বেতন, বন্ধ কারখানা বা চা-বাগানের শ্রমিকদের ভাতা আটকে যাচ্ছে। চেক বাউন্স করছে। চেক বাউন্স করতে থাকলে কেউ আর ধারও দেবে না!” |