পরমাণু চুক্তিকে ঘিরে ইউপিএ-১ থেকে সমর্থন প্রত্যাহার নিয়ে বাম রাজনীতিতে বিতর্ক ছিলই। এ বার কংগ্রেস-প্রশ্নে নতুন বিতর্কের অবতারণা করল বাম শরিক আরএসপি। দলের আসন্ন জাতীয় সম্মেলনের খসড়া রাজনৈতিক দলিলে তারা বলেছে, কংগ্রেসকে সমর্থন করতে গিয়ে ‘চড়া রাজনৈতিক মূল্য’ দিতে হয়েছে বামেদের। আর বামেদের হাতছাড়া হওয়া রাজনৈতিক পরিসর ‘ছিনিয়ে’ নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ইউপিএ থেকে আরও আগেই সমর্থন তোলার জন্য সিপিএমের উপর আরএসপি-র মতো বাম শরিকের চাপ ছিল। কিন্তু তাদের মতামত তখন উপেক্ষা করেছিল বড় শরিক সিপিএম। পশ্চিমবঙ্গের মতো ৩৪ বছরের ‘দুর্গ’ হাতছাড়া হাওয়ার পর কংগ্রেসকে সমর্থনের রাজনৈতিক মূল্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে সিপিএমকেই আসলে কাঠগড়ায় তুলছে আরএসপি। তাদের মতে, বিগত ক’বছরে বামেদের রাজনৈতিক অবস্থান যে ভাবে ‘লঘু’ করে দেওয়া হয়েছে, তাতেই মানুষের ‘মোহভঙ্গ’ হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে বিপর্যয়ের প্রসঙ্গে বিশ্লেষণ করতে গিয়েই খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আগে ইউপিএ সরকারকে সমর্থন করতে গিয়ে বামেরা নিজেদের অবচেতনেই কংগ্রেসকে বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা জুগিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু তাতে চড়া রাজনৈতিক মূল্য দিতে হয়েছে বামেদেরই। শ্রমজীবী মানুষ এবং কৃষক সমাজ মনে করেছে, কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের কোনও তফাত নেই’। প্রতিবেদনের আরও বক্তব্য, ‘জনগণের মনের কাছাকাছি পৌঁছনোর মতো অনন্য যে রাজনৈতিক পরিসর আমাদের ছিল, আমরাই তা শূন্য করে ফেলেছি। আমাদের বিরোধীরা, বিশেষত তৃণমূল, নিঃশব্দে সেই পরিসর ছিনিয়ে নিয়ে দখল কায়েম করেছে’। আগামী ২০ থেকে ২৩ এপ্রিল আলিপুরদুয়ারে আরএসপি-র ১৯ তম জাতীয় সম্মেলনে (সিপিএম বা সিপিআইয়ের ক্ষেত্রে যা পার্টি কংগ্রেস) ওই প্রতিবেদন পেশ হওয়ার কথা।
আরএসপি-র কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের মতে, “নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে আমরা যে বিচ্যুত হচ্ছি, সে ব্যাপারে আগেই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়নের পথ নিয়ে বিতর্কও সেই বিচ্যুতির জন্য। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ-কে যখন আমরা সমর্থন করেছি, মমতা তখন তাঁর দলের একমাত্র সাংসদ। সেই সময়ে তিনি প্রথমে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে নিয়েছেন। তার পরে সাংসদ-সংখ্যা বাড়িয়েছেন কংগ্রেসের
সঙ্গে জোট বেঁধে। শেষ পর্যন্ত রাজ্যের ক্ষমতায় পৌঁছেছেন। আর ওই সময়ের মধ্যে আমরা ক্রমশ প্রান্তিক হয়ে গিয়েছি।” আরএসপি-র বক্তব্য, বামেদের কাছ থেকে মানুষের প্রত্যাশা ছিল অন্য রকম। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাম রাজনীতির ‘সূচক’ যে সব নীতি, তা তুলে ধরার ক্ষেত্রে ক্রমাগত ‘অস্পষ্টতা’ দেখা দিয়েছিল। বলা হয়েছে, ‘উন্নয়ন ও সমাজ কল্যাণের কর্মসূচির মধ্যে যে বিচ্যুতিঢুকে পড়েছিল, রাজনৈতিক অবস্থান যে ভাবে লঘু হয়েছিল, তার জেরেই মানুষের মনে গত কয়েক বছরে বামেদের সম্পর্কে হতাশা তৈরি হয়ে মোহভঙ্গ ঘটেছে’।
কংগ্রেসকে ‘চিনতে’ তাদের যে দেরি হয়নি, তা-ও স্পষ্ট করে দিতে চেয়েছে আরএসপি। প্রতিবেদনে তারা বলেছে, ২০০৫ সালে পুদুচেরির জাতীয় সম্মেলনেই প্রস্তাব নেওয়া হয়েছিল ইউপিএ-কে সমর্থনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য। কিন্তু প্রকাশ কারাটেরা তখন বলেন, ইউপিএ-কে আরও সময় দেওয়া প্রয়োজন। তখন সিপিএমের মতের অন্যথা করতে চায়নি সিপিআই। শুধু ফরওয়ার্ড ব্লক ছিল আরএসপি-র পাশে। শেষ পর্যন্ত চার বছর সমর্থন চালিয়ে পরমাণু চুক্তিকে ঘিরে যখন সমর্থন প্রত্যাহার করা হয়, তত দিনে বামেদের ‘রাজনৈতিক ক্ষতি’ হয়ে গিয়েছে। ইউপিএ-কে বাইরে থেকে সমর্থনের বিনিময়ে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের মতো কিছু ‘কল্যাণমূলক আইন’ পাশ করানো গিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু সাধারণ, শ্রমজীবী জনতার মনে এই প্রশ্ন তৈরি হয়ে গিয়েছিল, নব্য উদারনীতির সমর্থক কংগ্রেসের থেকে বামেদের আর দৃশ্যত তফাত কী?
প্রত্যাশিত ভাবেই, আরএসপি-র দলিলে এ রাজ্যে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনা সমালোচিত হয়েছে। ওই দুই ঘটনায় ধাক্কা খেয়ে বামফ্রন্ট সরকার আবার নিজেদের চেনা পথে ফিরতে চাইলেও তা যে আর মানুষের কাছে ‘বিশ্বাসযোগ্য’ হয়নি, বলা হয়েছে সে কথাও। লোকসভা ভোটে ধাক্কা খেয়ে দু’বছর পর বিধানসভা ভোটে কেরলের এলডিএফ রাজ্যে ক্ষমতা হারিয়েছে ইউডিএফের চেয়ে ১%-এরও কম ভোটের ব্যবধানে আর পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের ভোট ওই একই সময়ে আরও ২.৩% কমেছে (লোকসভার চেয়ে) এই তুলনামূলক তথ্য তুলে ধরে এ রাজ্যে বামেদের ‘সাংগঠনিক দুর্বলতা’ই বোঝাতে চাওয়া হয়েছে।
মমতার নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার যে ‘নৈরাজ্য’ কায়েম করেছে, সেই চিত্র তুলে ধরতে ছাড়েনি আরএসপি। কিন্তু মানুষ যে এখনও বামেদের ‘আন্তরিক ভাবে গ্রহণ’ করছেন না মেনে নেওয়া হয়েছে সেই ‘বাস্তব’ও। |