শতবর্ষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই স্নাতক হবেন বীণা
শি বছর আগের একটা দিন। আশি বছরের পুরনো স্নাতক ডিগ্রি।
১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান। দেশ জুড়ে চলছে আইন অমান্য আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়। চলছে সশস্ত্র বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ডও। মাস দেড়েক আগেই কুমিল্লায় ম্যাজিস্ট্রেটকে গুলি করে মেরেছে দুই তরুণী, শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী।
সমাবর্তন হল-এর ভিতরে অবশ্য আপাত ভাবে এ সবের আঁচ নেই। ছাত্রছাত্রীদের শংসাপত্র দিতে যথারীতি হাজির হয়েছেন গভর্নর তথা আচার্য স্ট্যানলি জ্যাকসন। সময়ের নিক্তি মেপে এগোচ্ছে অনুষ্ঠান। হঠাৎ জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে ধেয়ে এল গুলি। হতভম্ব চোখে সকলে দেখলেন, ২০-২১ বছরের এক তরুণী বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে। মঞ্চ থেকে লাফিয়ে নেমে উপাচার্য হাসান সুরাবর্দি ধরে ফেললেন তরুণীকে। তখনও গুলি চালিয়ে যাচ্ছে সে।
সেদিনের সেই তরুণী, বীণা দাস। গত বছর পূর্ণ হয়েছে তাঁর জন্মশতবর্ষ।
অঙ্কন: সুমন চৌধুরী
১৯৩২-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে ডিগ্রি পাওয়ার কথা ছিল বীণারও। ইতিহাসের একটি সূত্র বলে, খোঁপায় রিভলভার লুকিয়ে সমাবর্তন কক্ষে ঢুকেছিলেন ২১ বছরের বীণা। স্ট্যানলি জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে পরপর পাঁচটি গুলি চালিয়েছিলেন। যদিও সব ক’টিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন কক্ষ থেকেই গ্রেফতার হয়েছিলেন বীণা। স্নাতকের শংসাপত্র পাওয়া হয়নি আর কোনও দিনই। শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে এ বার বীণার সেই শংসাপত্র দিতে উদ্যোগী হয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। গত বছর অগস্টেই ‘চট্টগ্রাম পরিষদ’ সংস্থার তরফে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাসকে অনুরোধ জানানো হয় বীণাদেবীর ওই ডিগ্রি দেওয়ার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই আবেদনে সাড়া দিয়েছেন।
‘চট্টগ্রাম পরিষদে’র তরফে সরোজরঞ্জন চৌধুরী বলেন, “গত বছর ২৪ অগস্ট বীণাদেবীর জন্ম শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে। ডিগ্রির অভাবে কর্মজীবনে কখনই যোগ্যতা অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাননি তিনি। অবসর গ্রহণের পরে পেনশনও পাননি। অন্তত ওঁর শতবার্ষিকীতে যাতে ওই ডিগ্রি পাওয়া যায়, আমরা সেই চেষ্টা করছি।” কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস জানান, বীণাদেবীকে ডিগ্রি দেওয়ার ব্যাপারে সিন্ডিকেটে আলোচনা হবে। তিনি বলেন, “নতুন সিন্ডিকেট তৈরি হওয়ার পরে তার প্রথম বৈঠকেই আমি নিজে বীণাদেবীকে মরণোত্তর ডিগ্রি দেওয়ার ব্যাপারে প্রস্তাব দেব। আশা করি সিন্ডিকেট তা গ্রহণ করবে।” বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ামক ওঙ্কারসাধন অধিকারীও বলেন, “চট্টগ্রাম পরিষদের চিঠি পেয়েছি। বীণাদেবীর শংসাপত্রের খোঁজও মিলেছে।”
খুব অল্প বয়স থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন বীণা। বাবা বেণীমাধব দাস ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুর শিক্ষক। দিদি কল্যাণী দাস বেথুন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। তিনিই সেখানে ছাত্রীসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা করেন। বীণাকে রিভলভারটি এনে দিয়েছিলেন আর এক বিপ্লবী তরুণী কমলা দাশগুপ্ত। যুগান্তর দলের সদস্য কমলা চোরা বাজারে কেনা ওই আগ্নেয়াস্ত্র শাড়ির ভাঁজে লুকিয়ে বীণাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন। কিন্তু ঠিক কী ভাবে গুলি ছুড়তে হয়, সেটা শিখিয়ে দেওয়ার সুযোগ পাননি। সে কারণেই বীণার অপটু হাত লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল। পরে আদালতে বীণা স্বীকার করেছিলেন, হিংসার পথ তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। কিন্তু চট্টগ্রাম ও হিজলিতে পুলিশি নির্যাতনের ঘটনা তাঁকে বিহ্বল করে দিয়েছিল।
ন’বছর কারাদণ্ডের পরে মুক্ত হয়ে সশস্ত্র আন্দোলনে আর থাকেননি বীণা। যোগ দিয়েছিলেন ১৯৪২-এর আন্দোলনে। তখন ফের তিন বছর জেল হয় তাঁর। ১৯৪৫ সালে মুক্তি পান। স্বাধীনতার পরে কংগ্রেসের টিকিটে প্রাদেশিক সভার নিম্নকক্ষে জিতেছিলেন। তার পরে আর সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেননি কখনও। কিন্তু উদ্বাস্তু আন্দোলন, ষাটের দশকের কলকাতায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা ছিল তাঁর। ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন মরিচঝাঁপিতেও। লিখে গিয়েছেন একটি স্মৃতিকথা। সরোজরঞ্জনবাবু বলেন, “দক্ষিণ কলকাতার দু’টি স্কুলে বীণাদেবী ইংরেজি পড়াতেন দীর্ঘ দিন। কিন্তু ডিগ্রির অভাবে যোগ্যতা অনুযায়ী পারিশ্রমিক মেলেনি তাঁর। এমনকী উঁচু ক্লাসে পড়াতে দেওয়া হলেও অনেক সময় সহকর্মীরা আপত্তি জানিয়েছেন, কেবল ওই ডিগ্রির অভাবে।”
বীণা দাসের শতবর্ষ উপলক্ষে সেই ডিগ্রিই এ বার দিতে চলেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৩২-এর সমাবর্তনে বীণার সঙ্গেই ডিগ্রি পাওয়ার কথা ছিল আরও এক তরুণীর। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। তার আগেই চট্টগ্রাম আন্দোলনে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। প্রীতিলতাকেও ডিগ্রি দেওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছে চট্টগ্রাম পরিষদ। প্রীতিলতা যেখানে পড়তেন, সেই বেথুন কলেজ থেকেও আবেদন জানানো হয়েছে। উপাচার্য জানান, সেটাও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেচনার মধ্যে রয়েছে।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.