তাঁরা প্রত্যেকেই পদস্থ সরকারি আধিকারিক। এমনকী, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ রাজ্যের ক্ষমতার মূল কেন্দ্র মুখ্যমন্ত্রীর দফতরেই কর্মরত। কিন্তু সমবায় গড়ে নিউ টাউনে আবাসন তৈরি করতে গিয়ে সিন্ডিকেটের জুলুমবাজি থেকে তাঁরাও রেহাই পাননি! সিন্ডিকেটের গা-জোয়ারি’তে দু’-দু’বার তাঁদের বাড়ির কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
এবং সাধারণ মানুষ বিপদে পড়লে যাঁদের কাছে সাহায্যের জন্য আসেন, প্রশাসনের ওই কর্তাব্যক্তিরাও এ হেন জবরদস্তির বিরুদ্ধ মুখ খোলার সাহস পাননি। সিন্ডিকেটের নামে কোথাও কোনও অভিযোগও নথিভুক্ত করেননি। উল্টে শেষ পর্যন্ত সিন্ডিকেটের শর্তেই ‘রফা’য় আসতে বাধ্য হয়েছেন। নিউ টাউন বাসস্ট্যান্ডের বিপরীতে এক শপিং মলের পিছনে গড়ে উঠছে সরকারি আধিকারিকদের সমবায় আবাসনটি। সিন্ডিকেটের জুলুমবাজি ওঁরা সহ্য করলেন কেন?
স্থানীয় ঠিকাদার সংগঠন ‘নিউ টাউন কনট্রাক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর এক সদস্য বৃহস্পতিবার বলেন, “সিন্ডিকেটের সঙ্গে লড়াইয়ে নামা অসম্ভব। তা হলে ওরা অনেক বেশি ক্ষতি করে দেবে।” কী রকম?
ক্ষতির বহরটা বোঝালেন এক ঠিকাদার “মালবোঝাই গাড়ি রাস্তায় আটকে দেবে। পুলিশ ডেকে গাড়ি হয়তো ঢোকালাম, কিন্তু সদ্য ঢালাই করা ছাদ ধরে রাখার খুঁটিগুলোকে কে বাঁচাবে? ওগুলো তো খুলে দেওয়া হবে রাতের বেলা। কয়েকটা খুঁটি খুলে দিলেই গোটা ছাদ হুড়মু্ড়িয়ে ধসে পড়বে। মানে কয়েক লাখ টাকার চোট। কে ঝুঁকি নেবে?” |
অগত্যা সিন্ডিকেটের কাছে মাথা না-নুইয়ে উপায় নেই। আর ক্ষমতাশালীদেরই যখন এই অবস্থা, তখন সাধারণ মানুষ কার কাছে ভরসা পাবেন! তাই বড় বড় নির্মাণ সংস্থা ছাড়াও নিউ টাউনে মধ্যবিত্ত যাঁরা ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট তৈরি করতে নেমেছেন, সিন্ডিকেটের চোখ রাঙানির সামনে বাড়তি টাকা গুনে দিচ্ছেন তাঁরাও। সবাই বুঝে গিয়েছেন, এটাই দস্তুর। প্রশ্ন তুলে লাভ তো নেই-ই, আখেরে নিজেরই ক্ষতি।
এই ক্ষতির ভয়েই সিন্ডিকেটের সঙ্গে একটা ‘বোঝাপড়া’য় আসতে চেয়েছিল ঠিকাদারদের ওই সংগঠনটি। তাঁদের অনুযোগ ছিল, বেশি দাম দিলেও সিন্ডিকেটের জিনিসপত্র এত নিম্নমানের যে, নির্মাণ কাঠামোর ক্ষতি হচ্ছে। উপরন্তু পরিমাণেও কম। ঠিকাদারেরা প্রস্তাব দেন, সিন্ডিকেট বরং কিছুটা বেশি দামই নিক, তবে জিনিসের মান ও পরিমাণ ঠিক রাখুক। পাশাপাশি বড় বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁরা চেয়েছিলেন আধুনিক ও উন্নত পদ্ধতি ব্যবহার করতে। যেমন, ছাদ ঢালাইয়ের সময়ে সিমেন্ট-বালি-পাথরকুচি হাতে না-মিশিয়ে কারখানা থেকে সরাসরি ‘মিক্স’ করা উপাদান কিনে আনতে।
কিন্তু ঠিকাদার সংগঠনের কোনও প্রস্তাবেই সিন্ডিকেট রাজি হয়নি। সংগঠনের একাধিক সদস্যের অভিযোগ, দাম-মান-পরিমাণ, কোনও ক্ষেত্রেই জুলুমবাজির কোনও সুযোগ ছাড়তে সিন্ডিকেট নারাজ। তারা যেমন বেশি দামে নিকৃষ্ট ও কম পরিমাণের মাল কিনতে বাধ্য করছে, তেমন উন্নত প্রযুক্তিও ব্যবহার করতে দিচ্ছে না। ঠিকাদার সংগঠনের এক কর্তার কথায়, “আমরা বলেছিলাম, সিন্ডিকেটকে বাজারদরের ২০% বেশি দেব। কিন্তু মালের মান ও পরিমাণ ঠিক দিতে হবে। ওরা রাজি হল না। তা হলেই বুঝুন, কতটা লাভ করে!” ঠিকাদার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য অভিষেক পাল বলেন, “হিডকো’র বৈঠকে অনেক প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ওরা মানেনি।”
তা হলে কি এ ভাবেই জুলুম মেনে নিতে হবে?
রাজ্য সরকারের তরফে অবশ্য এ দিনও যথারীতি ‘সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা’ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এ দিন রাজ্যের পুর-নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, “কোনও মানুষ কার কাছ থেকে পণ্য কিনবেন, তা তিনিই ঠিক করবেন। আইনের চোখে সিন্ডিকেটের কোনও অস্তিত্ব নেই। কেউ যদি অভিযোগ করেন, তবে পুলিশকে তৃণমূল, সিপিএম, কংগ্রেস নির্বিশেষে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
কিন্তু প্রশাসনের হর্তাকর্তারাই যেখানে অভিযোগ জানানোর ‘সাহস’ পাচ্ছেন না, সেখানে কে সাধ করে ‘হাঁড়িকাঠে’ মাথা গলাতে আসবে? বরং পুলিশেরই কি উচিত নয় মানুষের ভরসা ফেরাতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নেওয়া?
নবগঠিত বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার এ দিন বলেন, “পুলিশে খবর দিলে কাজের কাজ কিছু হবে না এমন ভাবা ভুল। আমরা নির্মাতাদের সঙ্গে বসে তাঁদের বোঝাতে চাই যে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে কড়া হাতে সিন্ডিকেট-রাজের মোকাবিলা করতে বলেছেন। অতএব, তোলাবাজি বা জুলুমের সমস্যা হলে নির্ভয়ে পুলিশে অভিযোগ জানান। নির্মাতাদের বলছি, পুলিশকে একটা সুযোগ দিয়েই দেখুন না!”
আপাতত পুলিশ কী করছে?
কমিশনার জানান, অসাধু সিন্ডিকেট ভাঙতে নির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে তাঁরা এগোতে চাইনে। যার অঙ্গ হিসেবে রাজারহাট-নিউটাউনে কর্মরত বিভিন্ন নির্মাণসংস্থার প্রতিনিধি ও ঠিকাদারদের সঙ্গে বৈঠক হবে। সিন্ডিকেটের নজর এড়িয়ে কী ভাবে নির্মাতারা গোপনে পুলিশকে খবর পাঠাতে পারেন, সেটাও ভাবা হচ্ছে। “নির্মাতাদের নোটিস পাঠানো হচ্ছে। আগামী সপ্তাহে আমরা ওঁদের নিয়ে বৈঠকে বসব।” জানান রাজীব কুমার।
কিন্তু সিন্ডিকেটের জুলুমবাজির মুখে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের সাহায্য মিলবে কী ভাবে?
পুলিশ কমিশনারের আশ্বাস, “নির্মাতাদের হাতে-হাতে একটা হেল্পলাইন নম্বর দিয়ে দেওয়া হবে। তাতে খবর এলে পুলিশ তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেবে।” একই সঙ্গে ‘সিন্ডিকেট-রাজের’ অস্তিত্ব সম্পর্কে তথ্যপ্রমাণ জোগাড়েরও চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন পুলিশকর্তারা। |