|
|
|
|
চির-অভাবী শান্তিলতার অমূল্য দানে আপ্লুত গ্রাম |
অমিত কর মহাপাত্র • এগরা |
দারিদ্রের কারণে দাদারা তাঁকে মাত্র ন’বছর বয়সে চারশো টাকার বিনিময়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। স্বামীর বয়স ছিল তেতাল্লিশ! আট-আটটি সন্তানের জন্ম হয়েছিল অভাবের সংসারে। অসুস্থ স্বামী ও আট ছেলেমেয়েকে নিয়ে চরম কষ্টে দিন কেটেছে। অক্ষরজ্ঞানহীন শান্তিলতা বন কলকাতায় বহু বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করে ছেলেমেয়েদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
ন’বছরের সেই বালিকা-বধূ আজ সত্তরের সীমানায়। অভাব এখনও নিত্যসঙ্গী। তার মধ্যেই দিনমজুরি, গরু-মুরগি পালন, সব্জি চাষ করে জমানো ৮০ হাজার টাকা বৃদ্ধা দান করলেন গ্রামের হাইস্কুলে। এমন দানে আপ্লুত স্কুল কর্তৃপক্ষ ওই টাকায় শ্রেণিকক্ষ গড়া হবে বলে জানিয়েছেন। এগরার শীপুর গ্রামের শান্তিলতাদেবীর উপলব্ধি, “আমার মতো অবস্থা যেন অন্য কারও না হয়। সব মেয়েই যেন ভাল ভাবে পড়াশোনা করতে পারে। তাই এত দিনে যতটুকু সঞ্চয় করতে পেরেছি স্কুলকেই দিয়ে দিলাম।”
এই দান গ্রহণ উপলক্ষে সোমবার শীপুর কেশবেশ্বর হাইস্কুল কর্তৃপক্ষ শান্তিলতাদেবীর সংবর্ধনারও ব্যবস্থা করে। প্রধান শিক্ষক জগবন্ধু কর বলেন, “উনি যে তার সমস্ত সঞ্চয় স্কুলকে দান করলেন, তা অত্যন্ত বড় মনের পরিচয়।”
শান্তিলতা বন। নিজস্ব চিত্র। |
ওডিশার বালেশ্বরে এক দুঃস্থ পরিবারে জন্ম শান্তিলতাদেবীর। ছোটবেলায় এক সময়ে বাবা-মা’র হাত ধরে পথে নামতে হয়েছিল। ভিক্ষা করে কোনও মতে দিন চলত। আক্ষেপ করে বলেন, “দাদা মাত্র চারশো টাকার বিনিময়ে আমার বিয়ে দিয়েছিলেন। তখন আমার ন’বছর বয়স। স্বামীর তেতাল্লিশ। তার পর আট ছেলেমেয়েকে নিয়ে অভাবের সংসার। স্বামীও অসুস্থ হলেন। কলকাতায় বহু বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করে সংসার চালিয়েছি।” বছর তিরিশ আগে স্বামী কালীচরণ বন-এর মৃত্যুর পর ছেলেমেয়েদের নিয়ে ফিরে আসেন শীপুর গ্রামে স্বামীর ভিটেয়। পরে দিনমজুরি করে, মুড়ি ভেজে, গরু-মুরগি পালন, সব্জি চাষ করে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। নিজেও সই করা শিখেছেন।
এরই মধ্যে চার মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। চার ছেলের মধ্যে কেউ দিনমজুরি করেন, কেউ রিকশা চালান, কেউ ছোট ব্যবসা করেন। অভাবের মধ্যেও মায়ের এই দানে খুশি চার ছেলেও। দিনমজুরি করে, এত কষ্ট সহ্য করেও শান্তিলতাদেবী যে স্কুলকে দান করেছেন তা ভাবতেই পারছেন না এলাকার মানুষ। কেশবেশ্বর হাইস্কুলের পরিচালন সমিতির সম্পাদক ও শিক্ষক প্রভুপদ দাস বলেন, “শান্তিলতাদেবী এক দিন আমাকে ডেকে তাঁর টাকা দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ওঁর মতো মানুষের জন্য আমরা গর্বিত। আশা করি, উনি যে কাজ করলেন তা অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করবে।”
এখনও সারাদিন গরু-মুরগি পালন, সব্জি চাষেই সময় কাটে বৃদ্ধার। সামান্য জমিতে যা চাষ হয় তা দিয়ে সারাবছরের ভাতটুকু জুটে যায়। নিজেই শীপুর গ্রামের হাটে গিয়ে সব্জি, মুরগি, ডিম বিক্রি করেন। শান্তিলতাদেবীর কথায়, “পড়াশোনা জানতাম না। সে ভাবে কাজ করে টাকা জোগাড় করতে পারিনি। অর্থাভাবে স্বামী বিনা চিকিৎসায় মারা যান। তার পরে দিনমজুরি, সব্জি চাষ করে যতটুকু টাকা জমা করতে পেরেছিলাম, স্বামীর স্মৃতিতে তা স্কুলকে দিয়েছি। টাকা তো আবার জমাতে পারব। পারলে ফের কাউকে তা দান করে দেব।” |
|
|
|
|
|