|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
পড়ুয়া কেন ‘ফেল’ করল, তার কারণ
খোঁজার তাগিদটা কিন্তু চোখে পড়ে না |
শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন দরকার, কিন্তু তার পদ্ধতিটি ভাবার
সময় এসেছে। প্রতিযোগিতার লক্ষ্য পূরণের দায়ে
শিক্ষার উদ্দেশ্য যেন ব্যাহত না হয়। প্রশ্ন তুলেছেন
মানবী মজুমদার |
প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কিছু কিছু গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এ রাজ্যে বেশ কিছু ছাত্র তিন-চার বছর স্কুলে পড়াশোনা করার পরও বিশেষ কিছু শিখছে না, লিখতে বা পড়তে পারছে না। প্রাথমিক স্তরে পাশ-ফেল প্রথা তুলে দেওয়াই এর প্রধান কারণ বলে অনেকে মনে করছেন। এটা ভাববার কথা। অন্য দিকে, পাশ-ফেল ও পরীক্ষা ব্যবস্থা যেখানে জোরদার ভাবে চালু, সেখানেও নানা ধরনের বিপত্তি ও বিকৃতি। যেমন, এক বন্ধু সখেদে বললেন, তাঁর ভাইপো মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে বটে, কিন্তু নম্বর যা পেয়েছে, তা ‘ফেল’ করারই নামান্তর। ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হল, যখন শুনলাম গত বছর দিল্লির কিছু নামী-দামি কলেজে ভর্তির ফর্ম পেতে হলে এক-একটি বিষয়ে দরকার একশোয় একশো! মানে, তার নীচে সবাই ‘ফেল’। এটাই বা কী প্রথা, যা শতকরা আশি-পঁচাশি জন ছাত্রকে অসফল ঘোষণা করছে? সামর্থ্য ও যোগ্যতার তুলনামূলক মূল্যায়নের এটি কি ঠিক উপায়?
সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষায় পাশ-ফেল প্রথা নিয়ে যে আলোচনা, তার আড়ালে হারিয়ে গেছে কিছু জরুরি প্রশ্ন, যেমন, শিক্ষণ পদ্ধতি ও পরীক্ষা পদ্ধতির কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন, যাতে একটি ফলপ্রসূ ও ন্যায্য মূল্যায়ন ব্যবস্থা গড়া যায়, যাতে থাকবে পরিমিতির সম্ভাবনা, বিকৃতির নয়।
প্রশ্ন হল, তথাকথিত পাশ-ফেল প্রথা ছাত্রদের কাম্য সামর্থ্য ও যোগ্যতা অর্জনে তাদের নিজেদের এবং শিক্ষকদের কতটা সাহায্য করে? সাধারণত এর ব্যবহার সীমিত থেকেছে কোন ছাত্র ‘অসফল’ সেই রায় ঘোষণায়। কেন সে ফেল করল, কী ভাবে তার শেখার ঘাটতি কমানো যায়, তার দিশা খোঁজার প্রবণতা কিন্তু সে ভাবে চোখে পড়েনি। বলতে পারেন, ছাত্র ফাঁকি দিয়েছে, তার যোগ্যতার অভাব, বুদ্ধির ঘাটতি ইত্যাদি, তাই সে অসফল এ আর বেশি কথা কী? কিন্তু এই ‘আপাত কারণের’ পিছনের কারণগুলি আমরা যত্ন করে খুঁজেছি কি? |
|
যাঁরা স্কুল ব্যবস্থার, ক্লাসরুমের ও পঠন-পাঠনের দৈনন্দিন চেহারাটা জানেন, তাঁরা এ-ও জানেন যে, শ্রেণিকক্ষের মধ্যে একটা অলিখিত পাশ-ফেল প্রথা প্রায়শই কাজ করে। গ্রামের স্কুলে শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনায় কেউ কেউ (সবাই নন) আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন যে, কিছু কিছু ছাত্রদের কাছে আমরা যেন বেশি কিছু প্রত্যাশা না করি, তারা ‘ভদ্র ক্লাসের নয়’, তারা মগজে খাটো। বড়দের কাছ থেকে ছোটরা নিষ্ঠুরতা সহজেই শিখে নেয়; তাই কিছু ছাত্র তাদের কোনও কোনও সহপাঠীর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছে ‘ওদের কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না দিদিমণি, ওরা কিচ্ছু জানে না, ওরা কিচ্ছু পারে না’। যাদের প্রতি এই মন্তব্য, তারা অপ্রতিভ, অসহায় মুখে বসে থেকেছে; তারা জানে শিক্ষক, সহপাঠী, গোটা স্কুলব্যবস্থা তাদের অসফল বলে ছাপ দিয়েছে। এর ফলে তাদের প্রতি বেশি নজর দেওয়ার তাগিদ অবশ্যম্ভাবী ভাবে বেড়েছে কি? না। বরং তারা হয়ে থেকেছে চিরস্থায়ী অবহেলার শিকার। বিশেষ করে যখন পরিকাঠামো, ও অন্যান্য জরুরি রসদের অভাবে কিছু ছাত্রকে ‘ফেল’ করাতেই হবে, কারণ পরবর্তী স্তরে সবার জন্য জায়গা নেই। এ হেন অবস্থায় যান্ত্রিক পাশ-ফেল প্রথা যতটা না শিক্ষাগত যোগ্যতা মূল্যায়নের রাস্তা, যতটা ছাঁটাই করার কল, ছাত্র-নিকাশি ছাঁকনি।
|
ন্যায্য মূল্যায়ন পদ্ধতিটি কী? |
এ প্রশ্নের একটাই ম্যাজিক উত্তর আছে ভাবলে ভুল হবে। প্রশ্ন হল, তুলনামূলক ভাবে কোন মূল্যায়ন প্রথা ছাত্রের শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়াতে বেশি কার্যকর হবে? সেই পদ্ধতির খোঁজ কখনই চূড়ান্ত বা সমাপ্ত বলে ধরে নেওয়া যাবে না; নতুন সমস্যা, নতুন চাহিদা, নতুন প্রেক্ষাপট নতুন মূল্যায়নের প্রয়োজন তৈরি করবে বারে বারে। তবে ইদানীং কালের নম্বর-সর্বস্ব পরীক্ষা ও পাশ-ফেল পদ্ধতি যে কোনও মতেই শিক্ষা-অনুকূল, ছাত্র-বৎসল মূল্যায়ন পদ্ধতি নয়, তা জোরের সঙ্গে বলতে পারি। এই দাবির সমর্থনে অন্তত দু’টি কারণের কথা বলব।
প্রথম আসি নম্বর-দৌড়ের অসুস্থ প্রতিযোগিতার বিকৃতির দিকটিতে। পৃথিবীর নানা দেশে শিক্ষার মান ও পরিমাণ বাড়াবার আপাত তাগিদে, শিক্ষাব্যবস্থাকে দায়বদ্ধ করে তোলার আপাত আগ্রহে শুরু হয়েছে বিরাট পরীক্ষা যজ্ঞ ছাত্রের, শিক্ষকের এবং স্কুলের, যার আর এক নাম ‘অডিট এক্সপ্লোশন’। শিক্ষকের দায়িত্ব অস্বীকার করার অবশ্যই কোনও জায়গা নেই। তবে ‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল’-এর চাপে শিক্ষককে বলা হয়েছে, অতি সত্বর ছাত্রকে স্কুলে এনে তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে কাম্য সামর্থ্যের জায়গায় পৌঁছে দিতে, যাতে সর্বশিক্ষা অভিযান সফল হয় নির্ধারিত সময়ে। ‘টার্গেট’ পূরণের এই প্রবল চাপে কিছু শিক্ষক, কিছু স্কুল এমন কিছু বন্দোবস্ত নিচ্ছে, যাতে বিকৃত হচ্ছে মূল্যায়নের উদ্দেশ্য ও আদর্শ। যেমন, প্রাথমিক স্তরে বহির্মূল্যায়নে নিজের স্কুলের ছাত্রদের ফল যাতে আশানুরূপ হয়, তার জন্য শিক্ষক প্রশ্নের উত্তর লিখে দিচ্ছেন বোর্ডে, যাতে ছাত্ররা তা খাতায় লিখে নিতে পারে, অন্য স্কুলের শিক্ষক-পরীক্ষকের উপস্থিতিতে ও সমর্থনে চলছে এই প্রথা শিক্ষকরা নিজেরাই যার নামকরণ করেছেন ‘বোর্ড এক্সাম’।
একই ধরনের বিকৃতি নজরে এল সম্প্রতি ইংল্যান্ডের স্কুলগুলিতে পরীক্ষা-সংক্রান্ত একটি দুর্নীতির ঘটনায়। সেখানেও তথাকথিত ‘লিগ টেবল’-এর দৌলতে স্কুলগুলি প্রতিযোগিতায় কে কোথায় দাঁড়িয়ে, তার তুল্যমূল্য বিচার চলছে। অকৃতকার্য স্কুলগুলি হারাবে সরকারি দাক্ষিণ্য। সে দেশের স্কুল পরীক্ষা নিয়ামকের কিছু সদস্য শিক্ষকদের কাছে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দিয়েছেন, এই অভিযোগে বিচার চলেছে। এত কথার সারাংশ দাঁড়াল এই যে, পরীক্ষাপদ্ধতি, পাশ-ফেল প্রথা স্বয়ংসিদ্ধ ভাবে উপকারী নয়; ছাত্রের চিন্তাশক্তি ও যোগ্যতা বিকাশের কাজে তাকে ফলপ্রসূ করে তোলা সজাগ ও সতর্ক প্রয়াসের অপেক্ষা রাখে।
আগেই বলেছি, ছাত্র ‘ফেল’ করলে আপাত-কারণের পিছনের কারণ খুঁজতে হবে। যেমন, পাঠক্রম, শিখন পদ্ধতি, পাঠ্যবই, প্রশ্নপত্র এগুলির মধ্যেও কি লুকিয়ে থাকে না ছাত্রের অকৃতকার্যতার কিছু কারণ? পাশ-ফেল প্রথার প্রবক্তারা কিন্তু কচিৎ এই প্রশ্ন তোলেন। দু’বছর আগের মাধ্যমিক পরীক্ষার অঙ্কের প্রশ্নপত্র থেকে একটা উদাহরণ দিই। আমার পরিচিত দু-তিনটি হিন্দিভাষী দলিত ছেলেমেয়ে সেই পরীক্ষায় অঙ্কে পাশ করতে পারেনি। অবশ্যই তাদের অঙ্ক শেখার ও বোঝার ঘাটতি ছিল। কিন্তু কেন, সেই কারণ খুঁজতে গিয়ে ও তাদের একটু সাহায্য করতে গিয়ে বুঝলাম প্রশ্নপত্রের ভাষাও কতটা দুর্বোধ্য হতে পারে। হিন্দিতে প্রশ্নপত্রটি ইংরেজি প্রশ্নপত্রের সঙ্গেই আসে এবং তারই অনুবাদ। ইংরেজি নির্দেশিকা বলছে, ‘If necessary you may take the value of pi to be...etc etc’ হিন্দিতে অনুবাদ করা হয়েছে ‘আবশ্যকতানুসার আপ’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ইংরেজিতে প্রশ্ন করা হয়েছে, ‘If the mother and the daughter...etc. etc’ হিন্দিতে অনুবাদ করা হয়েছে ‘অগর মাতা পুত্রী’ ইত্যাদি ইত্যাদি। মনে রাখবেন, এই দলিত ছাত্রছাত্রীদের সংস্কৃত শেখানো হয়নি। তারা যে হিন্দি ভাষায় কথা বলে, তা এই সন্ধি-জর্জরিত হিন্দি থেকে যোজন দূরে। তারা পরীক্ষায় বসে শুধু অঙ্কের ভাষা বোঝার চেষ্টা চালিয়েছে তাই নয়, দুরূহ হিন্দি ভাষা বোঝার অসফল প্রয়াসও নিয়েছে। আরও একটু সহজ হিন্দিতে তাদের শেখালে এবং মূল্যায়ন করলে পাশ-ফেলের গল্পটা উল্টে যেতে পারে না কি? এখানে কারা অসফল ছাত্ররা, না স্কুলব্যবস্থা? (সহজ হিন্দিতে প্রশ্নপত্র অনুবাদ করে বোর্ডের দ্বারস্থ হব মনস্থ করেছি, কারণ বিকল্প খসড়া নিছক সমালোচনার থেকে ভাল)।
শিক্ষার একটা উদ্দেশ্য জীবনকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করার দক্ষতা অর্জন করা। সক্রেটিস যাকে বলেছেন ‘এগজামিনড লাইফ’। পাশ-ফেল প্রথার মাত্রাছাড়া জয়গানের ফলে সেটা যদি হয়ে দাঁড়ায় পরীক্ষা-ক্লিষ্ট জীবন, তা কিন্তু হবে ছাত্রদের প্রতি বিরাট অবিচার।
|
প্রতীচী ইনস্টিটিউট-এর অধিকর্তা। মতামত ব্যক্তিগত |
|
|
|
|
|