যিশু খ্রিস্টকে নিয়ে বিতর্কে সিপিএমের অবস্থান স্পষ্ট করতে এগিয়ে এলেন দলের পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি। যিশু, বুদ্ধের মতো ব্যক্তিত্বদের ভূমিকা তৎকালীন সমাজে যে ‘প্রগতিশীল’ ছিল, তা-ই ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। ধর্মীয় গুরুদের ‘হেয়’ করার কোনও উদ্দেশ্য যে কমিউনিস্টদের নেই, কেরলে বিতর্কের প্রেক্ষিতে তা-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন ইয়েচুরি।
কেরলে দলের রাজ্য সম্মেলন উপলক্ষে সিপিএমের আয়োজিত প্রদর্শনীতে যিশু খ্রিস্টের ছবি ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। পার্টি কংগ্রেসের জন্য সোমবার দিল্লিতে দলের মতাদর্শগত দলিলের খসড়া প্রকাশ অনুষ্ঠানে এই সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে ইয়েচুরি বলেন, “তাঁদের সময়ে সমাজে যে পরিস্থিতি ছিল, তার মধ্যে যিশু এবং বুদ্ধ প্রগতিশীল ভূমিকাই পালন করেছিলেন।” ইয়েচুরির মতে, সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে যিশু বা বুদ্ধের যে ‘প্রগতিশীল’ ভূমিকা, তা স্বীকার করতে কমিউনিস্টদের
কোনও কুণ্ঠা নেই। তাঁদের ‘হেয়’ করার
কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে কোনও কাজও
সিপিএম করেনি। এই বিষয়ে তাঁদের অবস্থান আগেই স্পষ্ট ছিল বলেও রাজ্যসভার সাংসদ ইয়েচুরির ব্যাখ্যা।
তিরুঅনন্তপুরমে ‘মার্ক্স ইজ কারেক্ট’ শীর্ষক একটি প্রদর্শনীতে খ্রিস্টের একটি ছবির সঙ্গে সংক্ষেপে তাঁর জীবনকাহিনি বর্ণনা করে তাঁকে ‘সমাজ সংস্কারক’ হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। তাতে আপত্তি তুলেছে ক্যাথলিক চার্চের একাংশ। গির্জার বক্তব্য, সিপিএম ধর্ম সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্বিবেচনা করতে চাইলে আপত্তি নেই। কিন্তু খ্রিস্টের নাম ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা সমর্থনযোগ্য নয়। সিপিএমের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে খ্রিস্টের নাম ব্যবহারের অভিযোগ আরও গতি পায় তিরুঅনন্তপুরমেই একটি ফ্লেক্স ব্যানারকে কেন্দ্র করে। ‘দ্য লাস্ট সাপার অফ দ্য ক্যাপিটালিজম’ শীর্ষক ওই ব্যানারে দেখানো হয়, বাইবেলে বর্ণিত বিখ্যাত সেই নৈশভোজের আসরে মধ্যমণি হয়ে রয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা! তাঁর সঙ্গে নৈশভোজের টেবিল ভাগ করে নিয়েছেন কংগ্রেসের মনমোহন সিংহ, সনিয়া গাঁধী, রাহুল গাঁধী, উম্মেন চান্ডি (কেরলের মুখ্যমন্ত্রী) এবং বিজেপি-র নরেন্দ্র মোদীরা!
যিশুকে ‘সমাজ সংস্কারক’ এবং ‘মুক্তিদাতা’ বলে যে ব্যাখ্যা সিপিএম নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, এই ব্যানারকে ঘিরে বিতর্কে তা আর বিশেষ ধোপে টেকেনি। কারণ, চার্চ এবং কংগ্রেস এক সুরে দাবি করে, যিশুর জায়গায় ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ’ ওবামাকে বসিয়ে ব্যঙ্গচিত্র তৈরি করে সিপিএম প্রকৃতপক্ষে খ্রিস্টানদের ‘ভাবাবেগে’ আঘাত দিয়েছে। যিশুর প্রতি কমিউনিস্টদের সত্যিই কোনও ‘সম্মান’ থেকে থাকলে এমন কাজ তারা করত না বলেও মন্তব্য করেন চান্ডি-সহ কংগ্রেস নেতারা। দাবি ওঠে ক্ষমা চাওয়ার। শুধু তা-ই নয়, এ দিনও সিপিএমের ওই ব্যানারের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন এলডিএফের শরিক সিপিআইয়ের রাজ্য সম্পাদক সি কে চন্দ্রাপ্পন। তাঁর বক্তব্য, ‘মুক্তিদাতা’ যিশুর বন্দনা ঠিকই ছিল। কিন্তু ওই ব্যানার ব্যবহার ‘রাজনৈতিক ভাবে ঠিক পদক্ষেপ’ হয়নি।
বিতর্কের মুখে সিপিএমের কেরল রাজ্য সম্পাদক পিনারাই বিজয়ন ওই ব্যানার খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি দাবি করেন, সিপিএমের নাম করে কেউ বা কারা ওই ব্যানার লাগিয়েছিল। যদিও ব্যানারটিতে সিটু অনুমোদিত নির্মাণকর্মী ইউনিয়নের নাম দেওয়া ছিল। এই বিতর্কের প্রেক্ষিতেই ইয়েচুরি এ দিন বিজয়নদের ‘অস্বস্তি’ সামাল দিতে এগিয়ে এসেছেন। প্রসঙ্গত, আজ, মঙ্গলবার থেকে তিরুঅনন্তপুরমে কেরল সিপিএমের যে ২০ তম রাজ্য সম্মেলন শুরু হচ্ছে, সেখানে দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের সঙ্গে ইয়েচুরিরও থাকার কথা।
বস্তুত, নয়ের দশকে বাবরি ধ্বংসের পরে সিপিএমের তাত্ত্বিক মুখপত্রে ‘সাম্প্রদায়িকতা, ধর্ম ও কমিউনিজম’ একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন ইয়েচুরিই। সেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন, যিশু, বুদ্ধ বা মহম্মদ, এঁদের সকলেরই সমাজ সংস্কারে তাঁদের নিজস্ব সময়ে নিজস্ব কায়দায় কিছু
ভূমিকা ছিল। যিশু যেমন অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য স্মরণীয়, তেমনই মহম্মদ বাণিজ্যের পথ নতুন করে খুলতে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁদের ওই ভূমিকার সঙ্গে ‘নাস্তিক’ কমিউনিস্টদের কোনও বিরোধ নেই। কারণ, তারাও ‘বৈষম্যে ও পীড়নে’র বিরুদ্ধে লড়াই করে। এত দিন পরে দক্ষিণী রাজ্যে বিতর্কের জেরে পুরনো সেই ব্যাখ্যা ফের ধুলো ঝেড়ে সামনে আনতে হয়েছে ইয়েচুরিকে! |