ঘড়ি ধরে কি কারও অসুখ করে? এ প্রশ্ন বারিকুলের বাসিন্দাদের। কারণ, দুপুর গড়ালে এখানকার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ করে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি ফিরে যান। দুপুরের পরে সামান্য পেট খারাপ হলেও সেখানে ওষুধ দেওয়ার জন্য কারওকে পাওয়া যায় না। বাসিন্দাদের এই অভিযোগ কার্যত মেনে নিয়েছে জেলা স্বাস্থ্য দফতরও।
বাসিন্দাদের ক্ষোভ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জঙ্গলমহলের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল ফেরানোর নির্দেশ দিলেও কার্যক্ষেত্রে বারিকুল প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের রোজকার এই ছবি বদলায়নি। ১৯৯২ সালে এই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি তৈরি করা হয়। রানিবাঁধ ব্লকের বারিকুল, পূর্ণাপানি, জাটাডুমুর, বীরকাঁড়, কৃষ্ণপুরের মতো প্রায় ৪০টি গ্রামের ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ এই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপরে নির্ভরশীল। এই এলাকা থেকে রানিবাঁধ ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রায় ১৬ কিলোমিটার এবং খাতড়া মহকুমা হাসপাতাল প্রায় ৩২ কিলোমিটার দূরে। ফলে এই প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দাদের কাছে বারিকুল প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির গুরুত্ব অপরিসীম। |
বারিকুল স্বাস্থ্যকেন্দ্র। |
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বারিকুল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রতিদিন গড়ে শ’খানেক রোগী চিকিৎসা করাতে আসেন। এক জন চিকিৎসক, এক জন ফার্মাসিস্ট, দু’জন নার্স ও এক জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী রয়েছেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বরে কর্মীদের জন্য সাতটি কোয়ার্টার রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, কোয়ার্টারে কেউ থাকেন না। বছরের পর বছর কোয়ার্টারগুলিতে কেউ না থাকায় কয়েকটি দরজা ও জানালা চুরি হয়ে গিয়েছে। দিনের বেলাতেও সুনসান স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বর দেখতে লাগে ভূতুড়ে বাড়ির মতো। বারিকুলের বাসিন্দা রঞ্জিত টুডু, ধনেশ্বর টুডু, পূর্ণাপানির দুর্গাচরণ মুর্মুদের ক্ষোভ, “নামেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র। বহির্বিভাগ খোলা থাকে দুপুর ২টা পর্যন্ত। তার পরেই ডাক্তারবাবু, নার্স-সহ স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি চলে যান। দিনের বেশির ভাগ সময়েই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তালা ঝোলে। রাত-বিরেতে সামান্য সর্দি-কাশি বা জ্বর হলেও বিপদে পড়তে হয়। পরিষেবা মেলে না।” সম্প্রতি ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, বহির্বিভাগে জনা বিশেক রোগী ভিড় করেছেন। জ্বর-সর্দি-কাশির জন্য ওষুধ নিতে আসা বারিকুল গ্রামের সাবিত্রী টুডু, পূর্ণাপানি গ্রামের খেলারাম সোরেনদের আক্ষেপ, “সাপে কাটা, কুকুরে কামড়ানোর ওষুধ তো দূরের কথা, সাধারণ রোগের অনেক ওষুধই এখান থেকে পাওয়া যায় না। খালি হাতেই ফিরে যেতে হয়।” চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা রাতে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে না থাকায় রাতবিরেতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে বাসিন্দারা সঙ্কটে পড়ে যান। বুচিবুড়ি গ্রামের বাসিন্দা নীলরতন মাহাতো, ছেন্দাপাথর গ্রামের ত্রিপুরা মাহাতোদের অভিযোগ, “যোগাযোগ ব্যবস্থার অসুবিধার জন্য গুরুতর অসুস্থ মানুষকে রাতে দূরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া কষ্টকর। সময় মতো সেখানে নিয়ে যেতে না পারায় কয়েক জন রোগীর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।” গ্রামবাসীর অভিযোগ সমর্থন করে বারিকুল গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান, ঝাড়খণ্ড অনুশীলন পার্টির শ্যামলী হাঁসদা বলেন, “দুপুরের পরে স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বরে চিকিৎসক-সহ স্বাস্থ্যকর্মীরা না থাকায় এলাকার মানুষ পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করার জন্য স্বাস্থ্য দফতরে বারবার জানিয়েও লাভ হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।” তৃণমূলের তফশিলি জাতি-উপজাতি, ওবিসি সেলের বাঁকুড়া জেলা সভাপতি গৌর টুডু বলেন, “এতগুলি গ্রামের মানুষ ওই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল। সেখানে চিকিৎসা না মিললে ওঁরা যাবেন কোথায়?” |
অন্য দিকে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মীরা জানান, আবাসনের ভগ্নদশা এবং মাওবাদী আতঙ্কের জন্যই তাঁরা রাতে সেখানে থাকতে অনিচ্ছুক। একমাত্র চিকিৎসক বিদ্যুৎবিকাশ মণ্ডল বলেন, “ভাঙাচোরা কোয়ার্টার বসবাসের অনুপযুক্ত। রাতের পরিবেশ রীতিমতো আতঙ্কের। পরিস্থিতি বিবেচনা করেই আমরা থাকি না।” তবে তাঁর দাবি, “দিনের বেলায় যতক্ষণ রোগী থাকেন, আমরাও থাকি। সাধ্যমতো রোগীদের চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।” দুই নার্স সুতপা মণ্ডল ও সুলেখা কুণ্ডু স্পষ্টই বললেন, “যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব খারাপ। দিনে রানিবাঁধ থেকে এখানে আসতেই গা ছমছম করে। রাতে অঘটনের আশঙ্কা রয়েছে। তাই না থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক জগন্নাথ দিন্দা বলেন, “মাওবাদী আতঙ্কে স্বাস্থ্যকর্মীরা ওখানে থাকতে অনিচ্ছুক বলে জেনেছি। তবে বহির্বিভাগ নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খোলা থাকে। ভাঙাচোরা কোয়ার্টারগুলি মেরামত করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।”
|