কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা প্রথম মহিলা ডাক্তার কে, তা নিয়ে মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিরোধ বেধেছে হাসপাতালেরই প্রাক্তনীদের, যাঁদের বেশির ভাগই সরকারি ডাক্তার। ভারতের অন্যতম প্রথম মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মের সার্ধশতবার্ষিকী পালন করতে গিয়েই এই বিরোধের সূত্রপাত।
মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ উৎপল দত্ত জানিয়ে দিয়েছেন, প্রাক্তনীরা ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা করছেন। কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় প্রথম মহিলা হিসেবে মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছিলেন বটে, কিন্তু পাশ করেননি। তা করেছিলেন বিধুমুখী বসু। তিনি ‘ব্যাচেলার অফ মেডিসিন’ ডিগ্রি পেয়েছিলেন। অন্য দিকে প্রাক্তনীদের সংগঠনের দাবি, কাদম্বিনীকে তৎকালীন মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষই ১৮৮৬ সালে ‘গ্র্যাজুয়েট অফ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ’ (জিবিএমসি) ডিগ্রি দিয়েছিলেন। সেই ডিগ্রি পেয়ে কাদম্বিনী প্র্যাকটিস শুরু করেন, এমনকী মেডিক্যালেও কাজ করেন। তাঁর ডিগ্রি স্বীকৃত না হলে মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে কাজ করতে দিলেন কেন?
দু’পক্ষের এই বিবাদের জেরে জন্মের সার্ধশতবর্ষে মেডিক্যাল কলেজে কাদম্বিনীর মূর্তি বসানোর পরিকল্পনাও পিছিয়ে গিয়েছে। দিন কয়েক আগে মেডিক্যাল চত্বরে প্রাক্তনীদের আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে কাদম্বিনীকে ‘মেডিক্যাল থেকে স্নাতক হওয়া প্রথম মহিলা ডাক্তার’ বলে উল্লেখ করা হলে প্রতিবাদ জানিয়ে অধ্যক্ষ উৎপল দত্ত মঞ্চ ত্যাগ করেন বলে অভিযোগ।
উৎপলবাবুর কথায়, “প্রাক্তনীরা কাদম্বিনীকে নিয়ে অনুষ্ঠান করছেন। এ বার হাসপাতালের তরফে আমরা বিধুমুখী বসুকে নিয়ে অনুষ্ঠান করব। কারণ, বিধুমুখীই যে মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা প্রথম মহিলা ডাক্তার, এই সত্য চাপা পড়ে যাচ্ছে।” ইডেন হাসপাতালে কাদম্বিনীর মূর্তি বসানোর জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিল মেডিক্যালের প্রাক্তনী সংগঠন। কিন্তু অধ্যক্ষ জানিয়ে দিয়েছেন, মূর্তির তলায় ‘কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, মেডিক্যাল থেকে স্নাতক হওয়া প্রথম মহিলা ডাক্তার’ লেখা চলবে না। তাতে আবার প্রাক্তনীরা বেঁকে বসেছেন। তাঁরা মেডিক্যালে নবনির্মিত নিওনেটাল ওয়ার্ডের নাম কাদম্বিনীর নামে করার অনুরোধও জানিয়েছিলেন। মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ তাতে বলে দিয়েছেন, অনুমতি দেওয়া হতে পারে তবে ওই ওয়ার্ডে যে ফলক লাগানো হবে তাতে যেন কাদম্বিনীকে ‘মেডিক্যাল থেকে পাশ করা প্রথম মহিলা ডাক্তার’ বলে লেখা না থাকে। পাশাপাশি কর্তৃপক্ষ আরও জানান, হাউজস্টাফদের জন্য তৈরি নতুন কোয়ার্টার্সের নামকরণ বিধুমুখী বসুর নামে হবে।
এ দিকে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাক্তনীদের দাবিই সমর্থন করে জানিয়ে দিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন নিয়েই কাদম্বিনীকে ‘গ্র্যাজুয়েট অফ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ’ ডিগ্রি দেওয়া হয়েছিল। এটি মেডিক্যালের স্নাতকের সমমানের। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান গ্রন্থাগারিক সৌমিত্র সরকারের কথায়, “ওই ডিগ্রি নিয়েই কাদম্বিনী ইডেন হাসপাতাল ও ডাফরিনে চিকিৎসকের কাজ পান। বেনিয়াটোলা লেন ও সুকিয়া স্ট্রিটে তাঁর ব্যক্তিগত চেম্বারও ছিল। ডিগ্রি ভুল হলে তিনি প্র্যাকটিসের অনুমতি পান কী করে?”
কাদম্বিনী-বিতর্কে গঠিত মেডিক্যালের কমিটির অন্যতম সদস্য, ইতিহাসের গবেষক বরুণ চট্টোপাধ্যায়েরও দাবি, ব্রিটিশ ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮৮৬ ও ১৮৮৭ সালের গেজেটের প্রতিলিপি আনানো হয়েছে। সেখানে ১৮৮৬ সালের স্নাতকদের তালিকায় কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কাদম্বিনীর ডিগ্রিকে অনুমোদন না দিলে তাদের গেজেটে তা নথিভুক্ত হবে কেন?
কিন্তু উৎপলবাবু সেই যুক্তি না-মেনে পাল্টা দাবি করেছেন, কাদম্বিনী মেডিক্যাল থেকে স্নাতক হয়েছিলেন এমন কোনও প্রমাণ মেডিক্যালে নেই। আর জিবিএমসি ডিগ্রিকে কখনওই এমবি-র সমতুল মনে করা যায় না। তাঁর কথার সমর্থন করেছেন লেখিকা তথা গবেষক চিত্রা দেব। তিনিও জানিয়েছেন, কাদম্বিনী মেডিক্যালে ভর্তি হওয়া প্রথম ছাত্রী হতে পারেন, কিন্তু তিনি এমবি পাশ করেননি। সেটা প্রথম করেছিলেন বিধুমুখী বসু। |