ট্রেন থামার পরে ভিড় ঠেলে কোনওমতে নেমে ‘এক চিলতে’ প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েছেন প্রৌঢ়। সঙ্গে-সঙ্গেই পিছন থেকে আওয়াজ, “দাদা, দোকানের সামনেটা ছেড়ে দাঁড়াবেন।” আর সহ্য করতে পারলেন না ওই প্রৌঢ়। বললেন, “কোথায় দাঁড়াব বলে দিন। এটা কি বাজার না স্টেশন?” ততক্ষণে অবশ্য ট্রেন থেকে নামা অন্য যাত্রীরা বলতে শুরু করেছেন, “দাদা, সরে ঝগড়া করুন। যেতে পারছি না।”
প্ল্যাটফর্মের হকারদের জন্য শহরতলির স্টেশনগুলিতে এখন ট্রেনে ওঠা-নামাই দায় বলে অভিযোগ করছেন যাত্রীরা সকলেই। কোথাও কোথাও প্ল্যাটফর্মের প্রায় ৭০ শতাংশ জবরদখল
হয়ে গিয়েছে। ক্রমশ সংকীর্ণ হতে থাকা প্ল্যাটফর্মে ওঠানামা করতে গিয়ে হামেশাই ঘটছে দুর্ঘটনা। ১২ কামরার ট্রেন চালু হয়নি। অথচ সম্প্রসারিত প্ল্যাটফর্মগুলিও হকারদের দখলে। যাত্রীদের অভিযোগ, তাঁদের স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে হেলদোল নেই রেল কর্তৃপক্ষের। বরং হকার উচ্ছেদ নিয়ে একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাতেই ব্যস্ত তাঁরা।
শিয়ালদহ স্টেশনকে হকারমুক্ত করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। তবে ওই স্টেশনটি পেরিয়ে বিধাননগর রোড স্টেশন থেকেই প্ল্যাটফর্মের ছবিটা একেবারেই অন্য রকম। নিত্যযাত্রীরা জানালেন, বিধাননগর বাদ দিয়ে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ওই শাখার দমদম জংশন, দুর্গানগর, বিরাটি, মধ্যমগ্রাম, হৃদয়পুর, বারাসতের প্ল্যাটফর্মগুলির। এই সব স্টেশনের কোথাও প্ল্যাটফর্মের একপাশে দোকান, কোথাও আবার প্ল্যাটফর্মের মাঝখান দিয়ে দু’দিকে মুখ করে বসে গিয়েছে হকার। |
প্ল্যাটফর্মে হকার-রাজ। ছবি: সুদীপ ঘোষ |
নিত্যযাত্রীদের বক্তব্য, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যা যা জিনিসের প্রয়োজন, তার সব কিছুই মিলবে বারাসত স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের দোকানে। সেই সব দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষাও যেন ‘অন্যায়’। বিরাটি স্টেশনের যাত্রীরা জানান, বেশির ভাগ দোকানই চলছে ভাড়ায়। যেমন, রাজনৈতিক দলের খাতায় রয়েছে এক জনের নাম। তিনি এক সময়ে প্ল্যাটফর্মের উপরে ছোট্ট চালায় পান-বিড়ি-সিগারেট বিক্রি করতেন। আস্তে আস্তে আর একটি কচুরি-আলুর দমের দোকান করেন। এখন সেই ব্যক্তি দু’টি দোকান ভাড়া দিয়ে নিজে মোটরবাইকে ঘুরে বেড়ান। এক-একটি প্ল্যাটফর্মে শ’খানেক এমন স্থায়ী দোকান রয়েছে। আবার প্ল্যাটফর্মে কাপড় পেতে ফল, ফুল, খাবার, জামা-কাপড় নিয়ে অস্থায়ী দোকানও রয়েছে প্রায় একশো।
প্ল্যাটফর্মে দোকান করা নিয়ে বেশ কিছু দিন আগে দুর্গানগরে দুই সিপিএম নেতা খুনের পরে প্ল্যাটফর্মের দখলদারি নিয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ছবিটা বেআব্রু হয়েছে। ৯ বগি থেকে ১২ বগির ট্রেনের জন্য প্ল্যাটর্ফম বাড়ানোর কাজ শেষ। ট্রেন চালু না হলেও দোকান তৈরি বা ফাঁকা টেবিল-চেয়ার-বেঞ্চ ফেলে জায়গা দখল হয়ে গিয়েছে। হাবরায় প্লাটফর্ম সম্প্রসারণ হতেই সিটু-এআইটিটিইউসি-র সংঘর্ষে জখম হন ১২ জন। এই টানাপাড়েন থেকে শিক্ষা নেয় বারাসত। প্ল্যাটফর্ম দখল নিয়ে সংঘর্ষ বা হকার উচ্ছেদের মতো ঘটনা ঠেকাতে তৈরি হয় সর্বদলীয় কমিটি। তবে এখন সেই কমিটি ভেঙে গিয়েছে। হকারদের বেশির ভাগই তৃণমূল সমর্থিত এআইটিইউসি-র সংগঠন শিয়ালদহ ডিভিশন হকার্স ইউনিয়নের ছাতার তলায়।
হকার বসানোয় অবশ্য মদত রয়েছে সব রাজনৈতিক দলেরই। হকারদের পক্ষে সওয়ালও করেছেন তারা। শিয়ালদহ ডিভিশন হকার্স ইউনিয়নের বারাসত শাখার সম্পাদক বাসুদেব দাসের বক্তব্য, “যাত্রীদের স্বচ্ছন্দে ওঠানামা ও প্ল্যাটফর্ম পরিষ্কার রাখতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নতুন কেউ যাতে বসতে না পারে, তা-ও দেখা হচ্ছে। কিন্তু হকারদের পরিবারের কথাও তো ভাবতে হবে!” অন্য দিকে, সিটু সমর্থিত পশ্চিমবঙ্গ রেলওয়ে হকার্স ইউনিয়নের জেলা সম্পাদক গার্গী চট্টোপাধ্যায় বলেন, “হকারেরা কিন্তু যাত্রীদের জন্যই বেঁচে রয়েছে। আমরা সব সময়ে হকারদের লাইসেন্স এবং তাদের উচ্ছেদ করা হলে পুনর্বাসনের কথা বলেছি। নতুন হকার বসতেও দিইনি। কিন্তু এখন তো প্ল্যাটফর্মে তৃণমূলের অফিস। অসামাজিক কাজকর্মও হচ্ছে।”
এ ব্যাপারে কী বলছেন রেলকর্তারা? পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সমীর গোস্বামী বলেন, “প্ল্যাটফর্মে হকার বাড়লে যাতায়াতে সমস্যা হলেও হকার সরানোর কাজ পুলিশ করে। আমরা পুলিশের সঙ্গে থাকি। তারা হকার উচ্ছেদ করলে আমরা সঙ্গে থাকব।” পুলিশের কর্তারা অবশ্য ঠিক উল্টো কথা বলেছেন। এসআরপি (শিয়ালদহ) তাপসরঞ্জন ঘোষ বলেন, “যাদের জায়গা, উচ্ছেদ তারাই করে। আমরা সঙ্গে থাকি। হকারদের জন্য যাত্রীদের সমস্যা হলেও উচ্ছেদের কোনও নির্দেশ নেই।”
হকার সরাবেন কারা, সেই প্রশ্নেই অগত্যা আটকে নিত্যযাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্য। |