|
|
|
|
|
|
|
এটা ভেবো না যে গ্ল্যামারে খাটুনি কম |
বাবা-মায়ের পছন্দ-অপছন্দ ওর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। বরং ওকে খোঁজখবর
নেওয়ার স্বাধীনতা দিলে, নতুন পেশার অনিশ্চয়তাটা হাতে-কলমে বুঝতে পারলে
ও নিজের সিদ্ধান্তে নিজেই পৌঁছতে পারবে। পরামর্শ দিচ্ছেন রংগন চক্রবর্তী |
|
আমার বয়স ২১ বছর। অত্যন্ত নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে। পড়াশোনায় সাধারণ মানের ছাত্রী। পড়াশোনা করতে আমার একদম ভাল লাগে না। তাই আমার বাবা সব সময় অন্য ছেলে-মেয়ের সঙ্গে আমার তুলনা করেন। আমি এর প্রতিবাদ করলেই বাগ্বিতণ্ডা শুরু হয়ে যায়। বাবা মা চান আমি কোনও সরকারি চাকরি করি। কিন্তু আমি চাকরি করতে অনিচ্ছুক। আমি গ্ল্যামার জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এটাই আমার স্বপ্ন। আমার পরিবারের বক্তব্য, গ্রামের মেয়েদের ওই দুনিয়ায় যেতে নেই। তাঁরা কেউই এই ব্যাপারটা চান না। আমাকে সব সময় ব্যঙ্গ করা হয়। খুব অসহায় বোধ করছি। আমার পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। আমার কী করণীয়? অনুগ্রহ করে আমায় কিছু পরামর্শ দিলে বাধিত হব।
মানসী সরকার, পুরুলিয়া। |
|
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য |
|
তোমাকে বলছি |
মানসী,
কতগুলো জিনিস বোধ হয় প্রথমেই খোলাখুলি আলোচনা করা দরকার। তুমি যেহেতু গ্ল্যামার জগতের কথা বলছ, অনেকেই তোমাকে বলবেন: ও বাবা, ওই জগৎটা খুব অনিশ্চিত, খুব গণ্ডগোলের, ইত্যাদি। আমি সেই কথা বলতে চাই না। কারণ, অনিশ্চয়তা কেবল গ্ল্যামার জগতেই, তা ঠিক নয়। আমরা একটা সামাজিক কাঠামোর মধ্যে বাস করি। সেই কাঠামোয় জীবনের একটা ছক আছে। ভাল হোক, মন্দ হোক, সেই ছকটা আমাদের একটা চেনা রাস্তা দেয়। যেমন ধরো, আজকেও অধিকাংশ মেয়ের কাছে বিয়ে করে পরিবারের ভেতরে বাকি জীবন কাটানোটা একটা চেনা উপায়। আজকের দিনে কিছু কিছু পরিবারে একটা নতুন চেতনা এসেছে, সেটা হল, মেয়েদের নিজেদের একটা চাকরি করা দরকার। আমি এটাকে খুব ভাল মনে করি। কারণ, একটা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকলে বিয়ে করে বা না করে, যে জীবনটাই তুমি কাটাও না কেন, তার মধ্যে তোমার নিজের একটা জোর থাকবে। এই যে তোমার বাবা-মা চান তুমি একটা চাকরি করো, এটা তো অতি সাধু প্রস্তাব। আমি তো বলব, ওঁরা যে বিয়ে দিয়ে তোমার দায়মুক্ত না-হয়ে তোমাকে স্বাবলম্বী হতে বলছেন, এটা খুবই ভাল। তোমার পড়াশোনা করতে ভাল লাগে না। আমারও লাগত না। কিন্তু একটা বয়সে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমি পড়াশোনা করি বা না করি, আমার জীবনের রোজগারের দায় কিন্তু আমাকেই নিতে হবে। সেই দায়েই কিন্তু পড়াশোনা করেছি, কাজ করেছি, এখনও কাজ না থাকার ভয় পাই। কারণ ভাবি, কার ঘাড়ে গিয়ে পড়ব?
কাজেই, টিকে থাকার একটা যুক্তিতে আমরা একটা কাঠামোর মধ্যে দিয়ে যাই। ভালবেসে সবাই হয়তো যাই না। তবে এর মধ্যেও অনেকগুলো ভাললাগার জায়গা থাকে। তুমি এই কাঠামোর বাইরে যা-কিছুই হতে চাও না কেন, সেটা কিন্তু কঠিন। সেটা কেবল গ্ল্যামার নয়, খেলোয়াড়, লেখক, কবি, ফটোগ্রাফার যা-ই হতে চাও, প্রচুর ঝুঁকি নিতে হয়। সেটা কিন্তু কেবল ‘আমার পড়তে ভাল লাগে না, আমি ওইটা হতে চাই’ বলে কাটিয়ে দিলে হয় না। এর একটা ভাল উপায় হল, পাড়ে দাঁড়িয়ে জলে একটু করে পা ডুবিয়ে দেখা। বেসিক পড়াশোনা চালিয়ে গিয়ে একটা মূলধারার কাজের জন্যে নিজেকে তৈরি করে, পাশাপাশি স্বপ্নটাকে লালন করা। অনেক সময় আমরা সেটা না করে, এই স্বপ্নটাকে কেবল পড়াশোনা না-করার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করি।
আজকাল অনেক রকমের সুযোগ এসেছে। টেলিভিশনে বা বাইরে অনেক রকমের ট্যালেন্ট শো হয়, নিজেদের পোর্টফোলিয়ো বানিয়ে টেলিভিশন চ্যানেল বা খবরের কাগজ, বা প্রোডাকশন হাউসে জমা দেওয়া যায়। শুনেছি, কলকাতায় দিনে ৫৪টা টেলিভিশন সিরিয়াল চলে, তার প্রায় সব নায়িকাই নতুন মুখ। তাদের অনেকেই গ্রাম বা ছোট শহরের। কাজেই, সম্ভাবনা নেই তা মোটেই নয়। তবে এই মেয়েদের অনেককেই দেখি নানান ভাবে স্কুল-কলেজের পড়া বা অন্য কোনও কোয়ালিফিকেশন তৈরি করে রাখতে। কারণ, একটা সিরিয়ালের পর আর একটা আসবে কি না, একটা বয়সের পরে মডেলিং-এর কাজ আর পাওয়া যেবে কি না, সেটা খুবই অনিশ্চিত। তাই গ্ল্যামারে আসা মানে কিন্তু কম খাটুনি নয়, বরং আরও বেশি খাটুনি। |
|
বাবা-মাকে বলছি |
আপনাদের মেয়ে যেটাকে গ্ল্যামার বলছে, সেটা খুব সম্ভবত মডেলিং আর টেলিভিশন ফিল্মের দুনিয়া। ক্ষমতা থাকলে অভিনয়ের জগতে কিন্তু মোটামুটি রোজগারের কেরিয়ার করা অসম্ভব নয়। মডেলিং হয়তো আর একটু বেশি অনিশ্চিত। যদি ওকে শুধু বাধা দেন, তবে ওর ঝোঁকটা বাড়বে, আর পড়াশোনা না-করার জেদ চাপবে বেশি। তার চেয়ে ওকে ওর ইচ্ছের দিকে একটু সাহায্য করলে ক্ষতি কী? একটা পোর্টফোলিয়ো করে কিছু জায়গায় জমা দিক। দেখুক, রেসপন্স কেমন। এক-আধটা কাজ করলে তার সমস্যা, খাটুনি, এই সব ব্যাপারগুলো সম্পর্কে একটা ধারণা হবে। সবটাই হয়তো অত দারুণ আর মনে হবে না। নিজেও বুঝবে, কেন মাটিতে পা রাখা ভাল। আমরা যারা টেলিভিশন ফিল্ম ইত্যাদি ক্ষেত্রে কাজ করি, সাধারণত দু’ধরনের বাবা-মা দেখি। এক ধরনের হল, যাঁরা নিজেদের স্বপ্নগুলো ছেলে-মেয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে, তাদের নিয়ে মরণছুট ছুটছেন। আর এক দল হল, ‘ও লাইনে গেলে ঠ্যাং ভেঙে দেব’ বলে শাসাচ্ছেন। এই দুটোর কোনওটাই হওয়ার দরকার নেই। সন্তান বড় হয়ে কী করতে চায়, সেই স্বাধীনতা মেনে নেওয়া জরুরি। বাবা-মায়ের পছন্দ-অপছন্দ কোনওটাই চাপিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। ওকে খোঁজখবর নেওয়ার স্বাধীনতা দিলে, অনিশ্চয়তাটা হাতে-কলমে বুঝতে পারলে ও নিজের সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারবে। সেটা কিন্তু আপনাদের সবার পক্ষেই ভাল হবে। |
|
ছেলেমেয়েকে নিয়ে মা-বাবার সমস্যা? নাকি মা-বাবাকে নিয়ে ছেলেমেয়ের সমস্যা? পড়ার খরচ
নিয়ে অভিভাবকের দুশ্চিন্তা? দূরের শহরে পড়তে যাওয়ার নামে মেয়ের গায়ে জ্বর আসা? যে
মুশকিলই হোক না কেন, পরিবারের সবাই মিলেই সমাধানে পৌঁছতে হবে। এ বার থেকে
‘প্রস্তুতি’-ও কথা বলবে গোটা পরিবারের সঙ্গেই। অভিভাবকদের বা সন্তানের যে কোনও দুশ্চিন্তার
কথা আমাদের জানান (এবং জানাও) নিজেদের সমস্যা। সুচিন্তিত উত্তর দেবেন বিশেষজ্ঞরা।
ইমেল: prastuti@abp.in বিষয়: Haate Haat।
অথবা, চিঠি পাঠান (এবং পাঠাও) এই ঠিকানায়:
হাতে হাত, প্রস্তুতি,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
এ বি পি প্রাঃ লিঃ,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০ ০০১ |
|
|
|
|
|
|