কার্লোস পাহিরা: পেন ওর্জি। রাকেশ মাসি।
সুভাষ ভৌমিক: আনোয়ার আলি। মেহতাব হোসেন।
দুই বড় ক্লাবের দুই প্রাক্তন কোচ। তাঁদের চোখে বড় ম্যাচের সেরা দুই ফুটবলার কে, প্রশ্ন করলে ওই নাম চারটে এল।
দুই বড় ক্লাবে খেলা দুই প্রাক্তন ফুটবলার। তাঁরা কী বলেন এই প্রশ্নে?
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য: পেন ওর্জি। রাকেশ মাসি।
দীপেন্দু বিশ্বাস: পেন ওর্জি। আনোয়ার আলি।
ম্যাচটার পরে প্রেসবক্সের তর্কেও অনেক নাম ভাসছিল। কিংশুক দেবনাথ, ওডাফা ওকোলি, পাইতে।
শনিবার সেই বিরল বড় ম্যাচ, যেখানে অনেকেই সেরা হওয়ার দাবিদার। চব্বিশ ঘন্টা কেটে যাওয়ার পরে কিন্তু দেখাচ্ছে, জোড়া ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ এঁরা কেউ নন। অন্য দু’জন।
কেরলের সাজি কুরিয়ান এবং গোয়ার ফ্রান্সিস ফার্নান্ডেজ।
বড় ম্যাচের দুই সহকারী রেফারি।
প্রথম জন রবিন সিংহের অফসাইড গোল ন্যায্য করে দিয়েছেন। দ্বিতীয় জন টোলগে ওজবে-র ন্যায্য গোল অফসাইড বলে বাতিল করেছেন। প্রথম জনের জন্য ভুক্তভোগী মোহনবাগান। দ্বিতীয় জনের জন্য ভুগল ইস্টবেঙ্গল। |
গোয়া ও বাংলার ফুটবলে আকচাআকচি এমন জায়গায়, গোয়ান ক্লাবের ম্যাচে বাঙালি রেফারি ভুল করলেই অন্য রং দেওয়া হয় হাস্যকর ভাবে। বাংলার ক্লাবের ম্যাচে গোয়ান রেফারি ভুল করলেই বলা হয়, ডেম্পো-চার্চিলকে সুবিধে দিতেই নাকি ওই সিদ্ধান্ত। অ্যালবার্তো কোলাসো এআইএফএফ সচিব থাকার সময় অনেক বাঙালি রেফারি ওই ‘অপরাধে’ ম্যাচ পাননি।
ইদানীং বেশ কিছু ম্যাচে রেফারিং বিতর্ক সব কিছু ছাপিয়ে গিয়েছে। সব ক্লাবই যার শিকার। নতুন সংযোজন, ৩০১ নম্বর মোহন-ইস্ট ম্যাচ।
দুই ক্লাবের সমর্থক ও কর্তাদের অভিযোগের ‘লিস্টি’ এ রকম:
মোহনবাগান: ফেডারেশন কাপ ফাইনালে দীনেশ নায়ার দুটি গোল বাতিল করে দেন। ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে রবিনের অফসাইড গোল বাতিল হয়নি।
ইস্টবেঙ্গল: প্রথম মোহনবাগান ম্যাচে পেনাল্টিটা ছিল না। দ্বিতীয় মোহনবাগান ম্যাচে টোলগের গোল বাতিল। চার্চিল ম্যাচে টোলগের গোল অফসাইড বলে বাতিল হয়ে যায়। পুণে এফসি ম্যাচে টোলগেকে পেনাল্টি দেওয়া হয়নি। বেচারা টোলগে! ‘দীনেশ নায়ার’-এর ফেড কাপ ফাইনালে তাঁরও একটা গোল বাতিল হয়েছিল!
মনে করার কারণ নেই, শুধু মোহন-ইস্টই বাজে রেফারিংয়ের শিকার। বরং উল্টো। ভিনরাজ্যের কোচেরা কলকাতায় এসে আদিযুগ থেকে এখনও বলে যান, ইস্ট-মোহনকে রেফারিরা জেতালেন। কলকাতায় ডেম্পো-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে বলজিৎ সিংহ ‘অফসাইড গোল’ দিয়ে তাঁদের হারিয়েছে বলে এখনও বলেন আর্মান্দো কোলাসো। প্রয়াগ ইউনাইটেড কর্তারা ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে তিনটি ম্যাচের কথা তোলেন। তার মধ্যে একবার পেনাল্টি দেওয়া হয়নি, দুটো লালকার্ড দেখানো হয়েছে। গোয়ায় ডেম্পো-চার্চিল, পুণে-সালগাওকর, সালগাওকর-লাজং, ডেম্পো-স্পোর্টিং ম্যাচে মারাত্মক ঝামেলা হয়েছে। ক্ষিপ্ত লোকের নাম কখনও করিম, কখনও চার্চিল, কখনও প্রদ্যুম রেড্ডি।
রেফারিং বিতর্ক যত গাঢ় হচ্ছে, তত উদাহরণ হিসেবে উঠছে উজবেক রেফারি রাভশান ইমাতভের নাম। কোনও বিতর্ক ছাড়াই যিনি কলকাতা লিগে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ করে গিয়েছেন।
দুটো প্রশ্ন বারবার উঠছে।
কেনই বা বারবার অফসাইড নিয়ে সমস্যা তৈরি হচ্ছে?
রাভশানরা মসৃণ ভাবে ম্যাচ খেলাতে পারলে ভারতীয় রেফারিরা পারেন না কেন?
শনিবার ম্যাচ কমিশনার ছিলেন এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে ভারতের একমাত্র ম্যাচ কমিশনার গৌতম কর। তাঁর সাফ কথা, “ঘর কা মুরগি ডাল বরাবর।”
অফসাইড নিয়ম নিয়ে বিভ্রান্তি হবে না কেন? এ বার কলকাতা লিগ শুরুর মুখে কলকাতা রেফারি সংস্থা শহরের সব নামী ক্লাবকে একটা চিঠি দিয়েছিল। অফসাইডের নতুন ব্যাখ্যা বোঝানোর জন্য তারা ক্লাস নিতে চেয়েছিল ফুটবলারদের। ভিডিও দেখিয়ে মিলন দত্ত, প্রদীপ নাগ, সুমন্ত ঘোষরা বোঝাতেন, কোন ধরনের ফাউল বক্সে হলে পেনাল্টি, কোনটা পেনাল্টি নয়। কোনও ক্লাবই সেই চিঠির উত্তর দেয়নি। বাস্তব বলছে, ফুটবলাররা নিয়ম নিয়ে বিভ্রান্ত। মোহনবাগান ডিফেন্ডাররা যে কারণে রবিনকে অফসাইড ট্র্যাপ করতে দ্বিধায় ছিলেন।
রাভশানরা একটা ম্যাচ খেলিয়ে পান ১২০০ ডলার। কলকাতায় তিন বিদেশিকে ম্যাচ খেলাতে আনার জন্য আইএফএ-র খরচ হয়েছিল চার থেকে সাড়ে চার লক্ষ টাকা। আই লিগে ম্যাচ খেলিয়ে রেফারিরা এখন পান ১২০০ টাকা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সেটা বেড়েছে। তবু এখনও ভারতীয় রেফারিরা নিধিরাম সর্দার। এই যে অফসাইড বা পেনাল্টি নিয়ে এত বিতর্ক, তাতে ভ্রুক্ষেপহীন এআইএফএফ কর্তারা। রেফারিদের সামান্য বৈজ্ঞানিক উপকরণ দিতে তাঁদের কাপর্ণ্য অসাধারণ।
বিদেশে তিন রেফারির টিম আগে নিজেদের বক্তব্য আদানপ্রদান করতেন বিপ ফ্ল্যাগের মাধ্যমে। সহকারী রেফারি কিছু বলতে চাইলে পতাকার হাতলে সুইচ টিপতেন। রেফারির হাতে তার সঙ্কেত যেত। এখন সেই মাধ্যম আরও আধুনিক। বিপের বদলে রেফারিদের মুখে রেডিও কমিউনিকেশন। এতে সরাসরি নিজেরা কথা বলতে পারেন রেফারিরা। অফসাইড, পেনাল্টি নিয়ে মত বিনিময় করা যায় খেলার মাঝেই। এতে ভুল সংশোধন হয় দ্রুত।
প্রশ্ন তোলা যায়, আই লিগ কমিটির কর্তারা ভারতীয় রেফারিদের জন্য অন্তত সিগন্যাল বিপ সিস্টেমের ব্যবস্থা করতে পারেন না কেন? আই লিগ হয় ছয়টি শহরে। ছয়টি কেন্দ্রেও তো ছয়টি সিস্টেম রাখা যেত। কিছু টাকা খরচ হত। কিন্তু প্রচুর বিতর্ক কমত। সাজি কুরিয়ান, ফ্রান্সিস ফার্নান্ডেজদের নিধিরাম সর্দার মনে হত না। মনে হত না, যত দোষ নন্দ ঘোষ।
ভুল বিশ্বের সেরা রেফারিও করেন! চেলসি বনাম ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড ম্যাচে বিশ্বকাপ ফাইনালের রেফারি হাওয়ার্ড ওয়েবের দুটি পেনাল্টির সিদ্ধান্ত নিয়েই প্রশ্ন অনেকের। টটেনহ্যাম বনাম ম্যাঞ্চেস্টার সিটি ম্যাচটা ধরা যাক। আবার হাওয়ার্ড ওয়েব। দেখতেই পাননি, তাঁর সামনে কী ভাবে মার্কো বালোতেলি পা মাড়িয়ে গেলেন স্কট পার্কারের। পরে ভিডিও দেখে বালোতেলিকে চার ম্যাচ সাসপেন্ড করে এফ এ। আমাদের ভারতে এআইএফএফ ক্লাবের আবেদনে দীনেশ নায়ার বা প্রতাপ সিংহকে মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলের ম্যাচ খেলাতে দেয়নি। বসিয়ে দিয়েছে মাঘো সিংহকে। অথচ ম্যাচে ঝামেলা করলেও কোনও ফুটবলারকে শাস্তি দিতে পারেনি তারা। স্পোর্টিংয়ের বিদেশি জেমস মোগা বর্ণবিদ্বেষী গালাগাল দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন মুম্বই এফসি-র কোচ খালিদ জামিলের বিরুদ্ধে। এআইএফএফ নির্বিকার। এখানে রেফারিকে ক্লাবকর্তা, কোচরা তুলোধোনা করে যান। কিছুই শাস্তি হয় না। বিদেশে ফার্গুসন, মোরিনহো, ওয়েঙ্গার-রা পর্যন্ত শাস্তি পান রেফারির সমালোচনার জন্য।
অনেক ঘুম তো হল। এআইএফএফের এখন জেগে ওঠার সময়! |