মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি সহজ কথা বলিয়া একটি জটিল সমস্যার সূচনা করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, চিকিৎসকদের কাজের মূল্যায়নের উপর তাঁহাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা নির্ভর করিবে। উত্তম প্রস্তাব, প্রত্যাশিতও বটে। সরকারি কর্মীর পদোন্নতি কেবল প্রবীণত্বের ভিত্তিতে নহে, পারদর্শিতা এবং তৎপরতার ভিত্তিতে হওয়াই সঙ্গত, এই দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমে মান্যতা পাইতেছে। কিন্তু মূল্যায়ন হইবে কী প্রকারে? বিস্ময়কর ইহাই যে, এ রাজ্যে স্বাস্থ্য-বরাদ্দের সিংহভাগ চিকিৎসকদের বেতনখাতে ব্যয় হইলেও, তাহাদের কাজের মূল্যায়নের কোনও মাপকাঠি আজও তৈরি হয় নাই। কে ভাল চিকিৎসক, কে মন্দ, কে কাজে আগ্রহী, কে উদাসীন, কে রোগীর আস্থাভাজন, কে নহে, ইহার কোনওটিই বুঝিবার কোনও পদ্ধতি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিংবা স্বাস্থ্য দফতরের বিভিন্ন স্তরের কর্তাদের হাতে নাই। তাঁহারা কেবল দেখিয়া থাকেন, যে কোনও সরকারি কর্মীদের ন্যায় চিকিৎসকরাও নিয়মিত, এবং যথাসময়ে উপস্থিত থাকিতেছেন কি না, চাকরির আবশ্যক শর্তগুলি মানিতেছেন কি না। কিন্তু চিকিৎসার পদ্ধতি এবং ফলাফল সম্পর্কিত মূল্যায়নের কোনও ব্যবস্থা নাই। অর্থাৎ, কোনও রোগীর রোগ নির্ণয়ে যে প্রশ্নগুলি করা প্রয়োজন, যে যে পরীক্ষা করা প্রয়োজন, তাহার নিরসনে যে সকল ঔষধ এবং পরামর্শ দেওয়া প্রয়োজন, সে সবগুলি হইল কি না, তাহা বিচার করিয়া দেখিতে হইবে। অপর দিকে, যথানিয়মে চিকিৎসা করাইয়া রোগীর ওই সমস্যা সারিল কি না, তিনি আরাম পাইলেন কি না, তাহাও দেখিতে হইবে। রোগীদের একটি নমুনার মধ্যে সমীক্ষা করিয়া তাহা বোঝা সম্ভব। হাসপাতাল ও তাহার চিকিৎসকদের সম্পর্কে স্থানীয় মানুষ ও জনপ্রতিনিধিদের অনুভব-অভিযোগ কী, তাহার নিয়মিত নথিভূক্তিও মূল্যায়নের একটি উপায়। কিন্তু এমন কোনও উপায়ই স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অবলম্বন করা হয় নাই। ফলে যিনি মফস্সলের হাসপাতালে বহু পরিশ্রমে ও যত্নে রোগী দেখেন, অবসরের সময়ে তিক্ততা এবং বিরক্তি লইয়া তিনি বিদায় নিয়াছেন। যথাযোগ্য সম্মান-সুযোগ পান নাই, এমন চিকিৎসকের সংখ্যা কম নহে। আবার যাঁহারা হাসপাতালে বিরল হইয়াও সব সুবিধা ভোগ করিয়াছেন, তাঁহাদের দৃষ্টান্তও প্রচুর। স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা না করিলেও, চিকিৎসা তথা চিকিৎসকদের মূল্যায়ন করেন অর্থনীতিবিদরা। এমন একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়াছে, ভারতে গড়ে ৪২ শতাংশ ক্ষেত্রে সরকারি চিকিৎসকরা তাঁহাদের কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন। পশ্চিমবঙ্গে একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গিয়াছে, জেলাস্তরের হাসপাতালগুলিতে ডাক্তারদের যত ঘণ্টা আউটডোরে উপস্থিত থাকিবার কথা, তাঁহারা থাকিয়াছেন তাহার অর্ধেকেরও কম (৪৪ শতাংশ)। চিকিৎসার মান লইয়া বিশ্বব্যাঙ্কের অর্থনীতিবিদদের একটি গবেষণার ফলও নিরাশাব্যঞ্জক। রোগী সাজিয়া গবেষকরা হাসপাতালে গিয়া দেখিয়াছেন, তাঁহাদের কল্পিত উপসর্গের চিকিৎসায় যেগুলি করা প্রয়োজন বলিয়া ওই চিকিৎসকরাই পূর্বে জানাইয়াছিলেন, কার্যক্ষেত্রে তাহার মাত্র কয়েকটি তাঁহারা করিয়াছেন। দেখিয়া শুনিয়া গবেষকদের সিদ্ধান্ত, সরকারি চিকিৎসক হাতুড়ের অধিক পারদর্শী হইলেও, কার্যত তাঁহাদের চিকিৎসার মান উন্নততর নহে। চিকিৎসকরা এই সকল মূল্যায়নে ক্ষুব্ধ হইতে পারেন, কিন্তু বিকল্প মূল্যায়ন পদ্ধতি কী হইবে, তাহা তাঁহাদেরই প্রস্তাব করিতে হইবে। মুখ্যমন্ত্রী একটি বাস্তব সমস্যা উত্থাপিত করিয়াছেন। ইহার উত্তর সন্ধান করা, অর্থাৎ এক প্রকার আত্মমূল্যায়নে ব্রতী হওয়া চিকিৎসক সমাজের কর্তব্য। |