তত্ত্বকথা পরিসংখ্যান হইয়া দেখা দিলে এক রকম লাগে। বাস্তবে ঘটিলে অন্য রকম। স্বামী স্ত্রীকে বারণ করিয়াছে, বাড়ির বাহিরে যাওয়া চলিবে না। ইহা ঠিক কী ধরনের সংকট? লঘু, না গুরু? জাতীয় মহিলা কমিশন সাব্যস্ত করিয়াছে, ইহা তেমন কোনও বড় অপরাধ নহে, যাহাকে গৃহ-হিংসা, পরিভাষায় ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স’ বলা চলে। সুতরাং, এই বিধি এই ধরনের ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নহে। এই মনোভাবের প্রেক্ষিতেই প্রশ্নটি উঠিয়া আসে। গৃহ-হিংসার যথাযথ সংজ্ঞাটি কী? তত্ত্বমতে ইহা হিংসাত্মক কার্যের আওতায় না পড়িতে পারে, কিন্তু বাস্তবে এই ধরনের ঘটনা ঠিক কী পরিমাণ মানসিক পীড়ার সৃষ্টি করে, তাহা উপলব্ধি করা কঠিন নহে। সেই সূত্রেই হিংসার গুরুত্ব বিচারের কাজটি গুরুত্বপূর্ণ হইয়া দেখা দেয়। শারীরিক নির্যাতন ব্যতীত মানসিক নির্যাতনও যে রীতিমতো হিংসাত্মক হইয়া উঠিতে পারে, সেই কথা নূতন কিছু নহে। সংকট হয় তখনই, যখন আপাত-লঘু কোনও সংকট কার্যক্ষেত্রে অসহনীয় হইয়া দেখা দেয়। স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে যদি বাড়ির বাহিরে পদার্পণ করা না যায়, তখন সেই বসবাস কারাগারের তুল্য মনে হইলে, বা এই জাতীয় আচরণকে হিংসাত্মক মনে হইলেও, তাহাকে অন্যায় বলা চলিবে না। সত্য, কেন এই ধরনের ফতোয়া, কী পরিস্থিতিতে তাহা আরোপ করা হইয়াছিল, সবই বিচার বিবেচনার দাবি রাখে। এই ধরনের প্রতিটি সংকটই পরিস্থিতি-সাপেক্ষ। তাই বলিয়া কলমের এক খোঁচায় ইহাকে লঘু হিসাবে বর্ণনা করিলে সমস্যাটির অতি-সরলীকরণ হইতে পারে। মহিলা কমিশন বিষয়টি ভাবিয়া দেখিলে ভাল।
পদার্থবিদ্যায় আপেক্ষিক গুরুত্ব বলিয়া একটি বিষয় আছে। এই আপেক্ষিকতার বিষয়টিকে গৃহ-হিংসার ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা চলে। যে কোনও বিধিই কিছু না কিছু শাস্তিদানের বন্দোবস্ত রাখে। সুতরাং, সেই সুযোগে বিভিন্ন বিধিরই কিছু না কিছু অপব্যবহার-ও হয়। বিধি আছে এবং তাহা সর্বদাই সুপ্রযুক্ত হইয়াছে, এমন দাবি কেবল কল্পলোকেই সম্ভব হইতে পারে। অতঃপর প্রশ্ন, বিষয়টিকে কোন দৃষ্টিকোণ হইতে বিচার করা হইবে? মহিলা কমিশনের মতে, ‘গৃহ-হিংসা নিবারণী বিধি’ যত ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হইয়াছে, তাহার পঁচাশি শতাংশই কার্যত অকিঞ্চিৎকর, মনোবিদের পরামর্শের মাধ্যমেই তাহা মিটাইয়া ফেলা সম্ভব। মনোবিদের শলায় সমস্যাটি মিটিয়া যাইতে পারে, এই পর্যবেক্ষণটি সত্য হইতেই পারে, কিন্তু তাহা কোনও মতেই এই কথা প্রমাণ করে না যে, সমস্যাটি গুরুত্বহীন। যদি সম্ভাব্য কোনও হিংসার পরিসর হিসাবে গৃহ পরিসরকে মানিয়া লইতে হয়, যাহা এই ক্ষেত্রে হইয়াছে, তাহা হইলে হিংসার প্রকৃতিকেও গৃহ-পরিসরের মূল্যমানেই বিচার করা উচিত।
দ্বিতীয় একটি কথাও এই সূত্রে উঠিয়া আসে। যদি তর্কের খাতিরে ইহা মানিতেই হয় যে, অধিকাংশ অভিযোগই এক অর্থে তেমন গুরুতর কিছু নহে, তাহা হইলেও একটি নিহিত সত্য কিন্তু অস্বীকার করা চলে না। তাহা ইহাই যে, এই বিধিটি আসিয়া দীর্ঘকাল যাবৎ কার্যত মূক হইয়া থাকা একটি জনগোষ্ঠীকে মুখর হইবার সাহস দিয়াছে। এই মূল্যটি কম নহে। মহিলা কমিশন যথার্থই খেয়াল করিয়াছে, এখনও পর্যন্ত অনেক বৃহৎ অপরাধই এই আইনের আওতায় আসিতেছে না। ইহা সত্য। এবং, এই সত্যটি মানিলে ইহাও মানিতে হয় যে, দৈনন্দিনের কিছু বাস্তব কিন্তু আপাত অর্থে ক্ষুদ্র সংকটকে এই বিধির আওতা হইতে বাদ দিলে নূতন সমস্যা সৃষ্টি হইতে পারে। তখন মহিলাদের ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়াটি ধাক্কা খাইতে পারে। গৃহ-পরিসরে যে সমস্যা বিদ্যমান, তাহা কত দূর লঘু বা গুরু, সেই প্রকৃতি লইয়া তর্ক চলিতে পারে। সমস্যাটিকে উড়াইয়া দেওয়া চলে না। |