|
|
|
|
আজ আনুষ্ঠানিক প্রকাশ |
‘ভারতীয়’ হওয়ার দিশা নেই সিপিএমের দলিলে |
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
দফায় দফায় দিল্লি ও কলকাতায় বৈঠকই সার। ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ কী ভাবে ‘ভারতীয়’ হয়ে উঠবে, মতাদর্শগত দলিলে তার স্পষ্ট দিশা নেই বলে সিপিএমের মধ্যে অভিযোগ উঠতে চলেছে। প্রকাশ কারাট-সহ দলের শীর্ষ নেতৃত্বের আশঙ্কা, এই দলিলের বিরুদ্ধে দলে সমালোচনার ঝড় উঠবে। এপ্রিল মাসে কোঝিকোড়ে পার্টি কংগ্রেসেও এর ধাক্কা সামলাতে হবে।
সোমবার কারাট আনুষ্ঠানিক ভাবে মতাদর্শগত দলিল প্রকাশ করবেন। তার ঠিক আগে এ কে গোপালন ভবনে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তার কারণ অনেকগুলি। প্রথমত, মূল আলোচ্য বিষয়, চিনের সমাজতন্ত্র নিয়ে কোনও নিদির্ষ্ট অবস্থান নেওয়া যায়নি। এর পক্ষে-বিপক্ষে, ভাল-মন্দ, দু’রকম যুক্তিই রয়েছে। যা পরস্পরবিরোধী। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গে চিনের পথ অনুসরণ করে শিল্পায়নে দল যে সিলমোহর বসিয়েছিল, তা মুছে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু ভবিষ্যতে বাম-সরকার ক্ষমতায় এলে কী নীতি নেবে, তা স্পষ্ট বলা নেই। তৃতীয়ত, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, ভেনেজুয়েলা লাতিন আমেরিকার তিনটি দেশের বিকল্প নীতির উদারহণ তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু সিপিএমের পক্ষে তা অনুকরণযোগ্য, সে কথাও জোর দিয়ে বলা হচ্ছে না। কারণ ভারতের সঙ্গে লাতিন আমেরিকার বিস্তর অমিল। চতুর্থত, নানা রকমের মতামত রাখতে গিয়ে মতাদর্শগত দলিল আয়তনে এতটাই বড় হয়েছে যে, তা পড়ে বোধগম্য করতে গিয়ে দলের নেতারা ঘুমিয়ে পড়বেন কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। মূল দলিলের সঙ্গে আবার একটি বড় আকারের ‘সংযোজনী’ জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
এই পরিস্থিতি তৈরি হল কেন? পলিটব্যুরো সূত্রে বলা হচ্ছে, চিনের প্রশ্নে দলে ঐকমত্য না-থাকার ফলেই এই দশা। চিনের সমাজতন্ত্রের মডেল অনুকরণ করে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা পশ্চিমবঙ্গে বন্ধ-ধর্মঘটের বদলে ‘উন্নয়নের পথেই শ্রেণি-সংগ্রাম’-এর স্লোগান তুলেছিলেন। ২০০৫-এর দিল্লি পার্টি কংগ্রেস তাকে সমর্থন জানিয়ে বলে, বিশ্বায়নের এই যুগে পুঁজির সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। এ বার সেই সিলমোহর তুলে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিকল্প কী, তা-ও বলা হচ্ছে না। ফলে যার যার নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
মতাদর্শগত দলিলে মূলত দু’টি প্রশ্ন তুলে ধরা হয়েছে। এক, চিনের মতো সমাজতান্ত্রিক দেশে আর্থিক সংস্কারের ফলে কি একটি নতুন শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে, যারা ‘প্রতিবিপ্লব’ ঘটাতে পারে? দুই, এই আর্থিক সংস্কারের ফলে কি সমাজতন্ত্র মজবুত হচ্ছে? এর একটি প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ হলে অন্যটির উত্তর ‘না’ হওয়া উচিত। মজার কথা হল, দলিলে দু’টিরই উত্তর ইতিবাচক। চিনের কমিউনিস্ট পার্টিতে প্রচুর পুঁজিপতি ঢুকে পড়েছে, সে কথা মেনে নেওয়া হচ্ছে। সিটু-নেতৃত্ব-সহ দলের কট্টরপন্থী অংশের সেটাই মত। আবার চিনের আর্থিক উন্নয়নের ফলে তার সুফল সকলেই পাচ্ছেন বলে সীতারাম ইয়েচুরি-বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের মতটাও রাখা হয়েছে। দু’রকম যুক্তিই রেখে দিয়ে বলা হয়েছে, এর বেশি এখনই বলার প্রয়োজন নেই।
এ কে জি ভবন সূত্রের খবর, সাধারণ সম্পাদক নিজে চিনের মডেলের বিরোধী হলেও, প্রকাশ্যে কোনও অবস্থান নিচ্ছেন না। কারণ, চিনের প্রশ্নে তাঁর নিজের রাজ্য কেরল আড়াআড়ি ভাবে বিভক্ত। তা ছাড়া, চিনের কমিউনিস্ট পার্টির পুরোপুরি বিরুদ্ধ অবস্থান নিলে সিপিএম তাদের সঙ্গে সব রকম ছিন্ন করছে না কেন, সেই প্রশ্ন উঠবে। প্রচার হবে, চিনের বিরুদ্ধে সিপিএম আমেরিকার পাশে দাঁড়াচ্ছে। এই অবস্থায় কারাটের মন লাতিন আমেরিকায় মজে রয়েছে। ইকুয়েডর, বলিভিয়া, ভেনেজুয়েলা আর্থিক উদারনীতির বদলে উন্নয়নের যে বিকল্প নীতি নিয়েছে, তা নিয়ে তিনি দলের নেতাদের ভাবাতে চাইছেন। কিন্তু এই সব দেশের শাসক দলগুলির কোনওটিই কমিউনিস্ট পার্টি নয়। ফলে তাদের বেশি সুনাম গাইলে কারাট সিপিএমের দলীয় চরিত্র বদলাতে চাইছেন কি না, সেই প্রশ্ন উঠতে পারে।
তা হলে মতাদর্শগত দলিল তৈরি করে লাভ কী হল?
এক পলিটব্যুরো সদস্যের জবাব, “এখন তো এই দলিল নিয়ে পার্টির সর্বস্তরে আলোচনা হবে। অনেক মতামত, প্রশ্ন, আপত্তি উঠবে। অনেকেই সংশোধন চাইবেন। সব মিলিয়ে পাটি কংগ্রেসে চূড়ান্ত দলিল গৃহীত হবে।” সেখানে কি দলিলের চরিত্র বদলে যেতে পারে? ওই নেতার জবাব, “অসম্ভব না। পশ্চিমবঙ্গেও অনেকে বুদ্ধদেবের সঙ্গে একমত নন। জেলা সম্মেলনে তাঁর নীতির সমালোচনা হয়েছে। তেমনই কারাট-প্রভাবিত রাজ্যেও তাঁর বিরুদ্ধ মত রয়েছে। পার্টি কংগ্রেসের আগে দুই শিবিরই নিজেদের পক্ষে ভোট জোগাড়ের চেষ্টা করবেন।” এ কে জি ভবনের এক নেতার সরস মন্তব্য, “পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত!” |
|
|
|
|
|