রবিবাসরীয় গল্প
উত্তম-সুচিত্রার গল্প

আজ শুক্রবার, টিফিনের পরে প্রোগ্রাম
নীহার দত্ত ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি লম্বা। টিকোলো নাক। হাসলে মিষ্টি লাগে। সুন্দর গোঁফ। গায়ের রং ফর্সা। গলার আওয়াজ দরাজ। ব্যাঙ্কে চাকুরিরত। রিক্রিয়েশন ক্লাবের সব প্রোগ্রামের ঘোষক। বাইক আছে। নিজেদের বাড়ি। বিয়ে হয়নি। বয়স ৪৫। খুব ডিও ব্যবহার করতে হয়। বেশ লোমশ। বলবান স্বাস্থ্য। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। ইদানীং গান শিখছেন। একটা প্রেম ছিল। জমেনি। বস্তুত সংসারে তিনি একেবারে একা।
উত্তর কলকাতায় আগে বাড়ি ছিল নীহার দত্তদের। ভাড়া বাড়ি। বাবা-মা দু’জনেই সরকারি চাকুরে ছিলেন। বছর তিনেক আগে, সোনারপুরে ছ’কাঠা জমি কিনে ছিমছাম বাড়ি বানিয়েছিলেন তাঁরা। ৪ খানা ঘর। বড় বড়। রান্নাঘর। খাবার জায়গা। বারান্দা দুটো। ছাদে একটা ঘর। চিলেকোঠা এবং ঠাকুর ঘর। নীহার দত্তকে এত বড় বাড়ি এখন একা সামলাতে হচ্ছে। বছর দেড়েক হল তাঁর বাবা-মা, দু’জনেই গত হয়েছেন।
নীহার দত্তরা যখন উত্তর কলকাতায় থাকতেন, সে সময় হেদো, সিমলে, শ্যামপুকুর, বাগবাজার, হাতিবাগান, বিডন স্ট্রিট যেখানে যত রক্তদান শিবির হত অথবা রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত জয়ন্তী কিংবা গাঁধী-নেতাজি জয়ন্তী অথবা স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস, বিশ্ব এডস দিবস সর্বত্র ঘোষকের ভূমিকায় নীহার দত্ত...
‘নমস্কার! উপস্থিত ভদ্রজন এবং উত্তর কলকাতার মা-বোনেরা! দু’ফোঁটা রক্ত, মোটে নয় শক্ত। রক্তদান জীবন দান। আসুন। রক্ত দিয়ে রক্তঋণ শোধ করুন। যুবকেরা আগুয়ান হও। রক্ত দাও! রক্ত দাও।’ অথবা ‘আজ প্রাণ খুলে হাসুন! বুক ভরে শ্বাস নিন! বন্ধুকে আলিঙ্গন করুন! জাত-পাত-ধর্ম, যত সব বর্ম খুলে, ছুড়ে ফেলে, দু’হাত ছড়িয়ে ডেকে নিন সাথিকে। ওই দেখো পতাকা উড্ডীন। আজ আমরা স্বাধীন!’
এই সব অমর ঘোষণা এখন সোনারপুরে চলে গিয়েছে স্থান পরিবর্তন করে। এবং একই সঙ্গে নীহার দত্তের অফিসযাত্রার পথও হয়েছে অনেক দীর্ঘ। আগে ছিল শ্যামপুকুর থেকে উল্টোডাঙা। অটোর পথ। এখন ট্রেনের মান্থলি হয়েছে। শিয়ালদায় নেমে আবার বাস। এখন কেন্দ্র এবং রাজ্যের পরিবহণ। তবে নীহার দত্তের এতে ক্লান্তি নেই। তিনি এখন নতুন করে গান শিখছেন। সর্বক্ষণ সুরে মশগুল থাকেন। তাঁর একটা প্রেম ছিল। হয়নি।
যে-দিন অফিসের রিক্রিয়েশন ক্লাবে প্রোগ্রাম থাকে, সে-দিন নীহার দত্ত বাইক নিয়ে আসেন। ব্যাগে আলাদা করে প্রোগ্রামের জামা-কাপড় নিয়ে আসেন। মেক-আপ কিটও থাকে। নীহার দত্তের প্রেম ছিল অফিসেরই উর্মিলা মিত্রের সঙ্গে। উর্মিলাও এখনও বিয়ে করেননি। তাঁর বয়স ৩৯। প্রেমটা ছিল বছর দুয়েক। কেন যে হল না, কেটে গেল, তা নিয়ে অফিসে অনেক রকমের গসিপ চালু আছে। তবে নীহার দত্ত এবং উর্মিলা মিত্র দু’জনেই এখনও পরিষ্কার নন কারণ সম্বন্ধে।
উর্মিলাও আবৃত্তি করেন। অফিসে তাঁরও নাম আছে। বস্তুত নীহার দত্ত এবং উর্মিলা মিত্রের যৌথ নিবেদন অফিসে সব সময়েই হিট। আজ অফিসে, সাউথ এশিয়ান নারী দিবস উপলক্ষে প্রোগ্রাম। আজ নীহার দত্ত বাইকে করে এসেছেন। আজ উর্মিলা মিত্র ব্যাগে করে কাগজের ফুলের মালা এনেছেন। আজ শুক্রবার। টিফিনের পরে প্রোগ্রাম। সঙ্গে ভোলাদার ক্যান্টিনের ফিশ ফ্রাই এবং পাউরুটি টোস্ট। সঙ্গে ডবল হাফ চা।
উর্মিলা মিত্রও লম্বা। ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি। তাঁরও টিকোলো নাক। ডান গালে টোল। বাঁ গালে তিল। পিঠ পর্যন্ত চুল। কোমর সরু। রং ফর্সা। ত্বক মসৃণ। মুখে কোনও রিঙ্কলস নেই। দাঁত ঝকঝকে। আত্মবিশ্বাস চনমনে। বুদ্ধি প্রখর। বাবা নেই। মা আছেন। আর কেউ নেই। এক ভাই। বিলেতে। সেখানেই থিতু হয়েছেন। নিজেদের বাড়ি। দক্ষিণ কলকাতায়। বাবা কেন্দ্রীয় সরকারের শুল্ক দফতরের বড় চাকুরে ছিলেন। সচ্ছল অবস্থা। দুটো ঘরে এসি আছে। গাড়ি আছে। বাড়িতে এক জন বড় এবং এক জন শিশুশ্রমিক আছেন। এ ছাড়াও আর এক মহিলা আসেন রান্না করতে। জামাকাপড় কাচতে আসেন আরও এক জন মহিলা। পুরুষ কর্মী কেবল বাগানের মালি। এবং বাড়ি পরিষ্কার করার এক জন মোট দু’জন। এই দু’জন রবিবার করে আসেন। উর্মিলা মিত্রের বাড়িতে সাত দিনই সরগরম।
নীহার দত্তের সঙ্গে উর্মিলা মিত্রের প্রেম হয়েছিল অফিসেরই একটা প্রোগ্রামের সূত্রে। তার পর দু’জনে একসঙ্গে ২৭টা প্রোগ্রাম করেছেন। আজ আবার একসঙ্গে।
নীহার দত্ত বললেন, ‘বেশি চড়া মেক-আপ নিয়ো না।’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘আমাদের ব্রেক-আপের পর আজই আমাদের প্রথম প্রোগ্রাম!’
নীহার দত্ত বললেন, ‘তাই?’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘হ্যাঁ গো।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘এক বার রিহার্স করে নেবে নাকি?’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘দরকার হবে না।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘ঠিক আছে। মেক-আপটা দেখে, বেশি চড়া হয়ে যায় না যেন। নারী দিবসের ব্যাপার আছে কিন্তু। শাড়িটাও দেখে নিয়ো।’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘জানি রে বাবা। ওই জন্যই তো সেই শাড়িটা নিয়ে এসেছি।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘কোনটা?’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘সেই যে ছাই ছাই রঙের সাউথ কটনটা কিনে দিয়েছিলে দক্ষিণাপণ থেকে; সেই শাড়িটা। ওটা যাবে না?’
নীহার দত্ত বললেন, ‘তা হলে আজ আর কাগজের মালাটা পোরো না।’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘ঠিক আছে বাবা।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘আজ আমি যা বলছি সব শুনবে?’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘তাই-ই তো শুনতাম।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘তাই?’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘হ্যাঁ তাই-ই। তোমার অবশ্য মনে নেই।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘আজকে ও-সব কথা থাক।’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘ফর দ্য সেক অব দ্য প্রোগ্রাম!’

¶২¶

সন্ধের পর বাগবাজারে, গঙ্গার পাড়ে
বাগবাজারে ফেরিঘাটের কাছে চায়ের দোকানে সন্ধের সময় নীহার দত্ত আর উর্মিলা মিত্র অনেক অনেক দিন চা খেয়েছেন। অনেকক্ষণ বসে গল্প করেছেন। লোকজনের মাঝে গঙ্গার পাড়ের এই জায়গাটা তাঁদের এককালে খুবই প্রিয় ছিল। আজ অফিসের প্রোগ্রামের শেষে দু’জনে আবার এসেছেন। নীহার দত্ত বাইকটাকে অটোস্ট্যান্ডের কাছে দাঁড় করিয়েছেন। আজও প্রোগ্রাম খুব ভাল হয়েছে। সকলে খুব হাততালি দিয়েছেন। ম্যানেজার বলেছেন, ‘আপনারা দু’জন অফিসের অ্যাসেট।’ দু’জন একসঙ্গে বলেছেন, ‘থ্যাঙ্কস!’ তার পর উর্মিলা মিত্রই নীহার দত্তকে বলেছেন, ‘গঙ্গায় নিয়ে যাবে?’ নীহার দত্ত বলেছেন, ‘তুমি যাবে?’ উর্মিলা মিত্র বলেছেন, ‘যাব।’ নীহার দত্ত বলেছেন, ‘চলো।’
দু’জনে আজ চায়ের দোকানে বেশিক্ষণ বসেননি। গঙ্গার পাড়ে, ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছেন। এখানে আবছা আলো। বাকিটা অন্ধকার। গঙ্গার জলের রং এখন আঁধার মাখা। তার ওপরে অনেক আলোর রকমারি। মাঝে মাঝে লঞ্চের আলো। নৌকোতে হ্যারিকেন বাঁধা। মাথার ওপরে আকাশের তারা।
উর্মিলা যেন কখন নীহারের হাতটা ধরেছেন।
গঙ্গার ওপারে কী হচ্ছে এখন? বোধ হয় তাঁদের দু’জনের মতোই অন্য দু’জন দাঁড়িয়ে আছেন। উর্মিলা মিত্র বোধ হয় তাই-ই ভাবছেন। নীহার দত্তও ভাবছেন বোধ হয়।
ওপারের সেই পুরুষের হাত ধরেছেন ওপারের সেই মহিলা। মহিলা বোধ হয় কিছু বলতে চাইছেন। সেই পুরুষও বোধ হয় কিছু শুনতে চাইছেন। কিন্তু কেউই কিছু বলছেন না। শুনছেনও না।
ওপারের সেই পুরুষও এখন ওপারের সেই মহিলার হাত ধরেছেন। মহিলা আবেশে চোখ বুজেছেন। পুরুষ তাঁর দু’হাতের তালুতে বন্দি করেছেন মহিলার দশ আঙুল। মহিলা যেন মোমের। তাপে গলে যাবেন যেন। থরথর কাঁপছেন মহিলা। তার পর কেঁদে উঠেছেন তিনি।
এপারে দাঁড়িয়ে নীহার দত্ত আর উর্মিলা মিত্র ওপারের কথা ভাবছেন। ভাবছেন ওপারের পুরুষ আর মহিলা কী বলছেন, কী করছেন সে কথা। নীহার দত্ত ভাবছেন, ওপারের পুরুষ বলছেন, ‘আবার হয় না?’ ওপারের মহিলা বলছেন বোধ হয়, ‘এখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।’ উর্মিলা মিত্র ভাবছেন, ওপারের পুরুষ বলছেন বোধ হয়, ‘কেন হয় না? কীসের দেরি?’ মহিলা বলছেন, ‘আমি এখন আর এক জনের হয়ে গেছি।’ নীহার দত্ত ভাবছেন, ওই পুরুষ বলছেন, ‘কী বলছ? কবে?’ মহিলা বলছেন, ‘তুমি আমাকে ছেড়ে গেছ দু’বছর আগে। আমি অন্যের হয়েছি তিন মাস আগে।’ উর্মিলা মিত্র ভাবছেন, পুরুষ বলছেন বোধ হয়, ‘মিথ্যে কথা!’ মহিলা বলছেন বোধ হয়, ‘সত্যি কথা।’ নীহার দত্ত ভাবছেন, পুরুষ তখন ওই মহিলার আঙুলগুলো ছেড়ে দিয়েছেন। এ পারে উর্মিলা মিত্রও নীহার দত্তের হাতটা ছেড়ে দিলেন।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘কী হল?’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘কিছু না।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘বাড়ি যাবে?’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘চলো’।
গঙ্গার ওপারের ওই দু’জন পুরুষ-মহিলার কথা ভাবতে ভাবতে দু’জন বাইকে গিয়ে বসলেন। বাইক চলে গেল গঙ্গা ছেড়ে।

¶৩¶

রাতে, দুই বাড়িতে, দু’জনে
উর্মিলা মিত্রের বাড়ি কাঁকুলিয়ায়।
বাইকে নীহার দত্ত আর উর্মিলা মিত্র একটাও কথা বলেননি। বাড়ির সামনে এসে উর্মিলা বলেছেন, ‘চা খেয়ে যাবে এক কাপ।’ নীহার দত্ত বলেছেন, ‘আজ থাক। অনেক রাত হয়েছে।’ উর্মিলা বলেছেন, ‘কী এমন রাত হয়েছে? তুমি তো এখান থেকে রাত ১টাতেও গিয়েছ।’ নীহার দত্ত বলেছেন, ‘সে সময় সব কিছু অন্য রকম ছিল।’ উর্মিলা বলেছেন, ‘কী রকম ছিল?’ নীহার দত্ত বলেছেন, ‘চলো। চা খাব।’ উর্মিলা বলেছেন, ‘এসো।’
অনেক দিন পরে আজ নীহার দত্ত উর্মিলার বাড়িতে এলেন। তাঁকে দেখে উর্মিলার মা বললেন, ‘কেমন আছো?’ নীহার দত্ত বললেন, ‘ভাল। আপনি?’ উর্মিলার মা হাঁটু থেকে কাঁধ পর্যন্ত ব্যথার বর্ণানা দিলেন। উর্মিলা ভেতরের ঘর থেকে এসে বললেন, ‘ওপরে চলো।’ নীহার দত্ত উর্মিলার ওপরের ঘরে চলে গেলেন।
উর্মিলা মিত্রের ঘরটা যেমন ছিল আগে ঠিক তেমনই আছে। জানলার কাছে খাট। দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথের ছবি। একপাশে ড্রেসিং টেবিল। তার পাশে টিভি। সঙ্গে ডিভিডি প্লেয়ার। তার পাশে সিডি-ডিভিডির র্যাক। উর্মিলার দারুণ কালেকশন। নীহার দত্ত দেখলেন, তাঁর দেওয়া সিডিগুলো খুব যত্ন করে সাজানো রয়েছে। নীহার দত্ত একটা তুলে নিলেন। তাতে লেখা রয়েছে, ‘জন্মদিনে উর্মিকে নীহার। ২০০৯।’ আর একটায় লেখা, ‘উর্মিমালাকে ২৫ বৈশাখে। নী।’
চা নিয়ে উর্মিলা কখন ঘরে ঢুকেছেন খেয়াল করেননি নীহার দত্ত। উর্মিলা তাঁকে বললেন, ‘চা-টা নাও। ওগুলো সব তোমার দেওয়া সিডি।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘আমার চিঠিগুলো আছে?’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘সবগুলো আছে।’
নীহার দত্ত বলেন, ‘দেখাও।’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘কেন দেখাব।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘আমারই তো লেখা!’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘আমাকে লেখা।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘তাতে কী?’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘তাতেই সব।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘কী সব?’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘ওই চিঠিগুলো নিয়েই তো আমি বেঁচে আছি।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘রক্ত-মাংসের মানুষটা তো তোমার সামনেই ছিল। আছেও এখনও।’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘মানুষটাকে বিশ্বাস হয় না।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘মানুষটাকে বিশ্বাস হয় না!’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘ভয় করে।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘কবে থেকে বিশ্বাস হয় না তোমার? কীসের জন্য ভয় করে তোমার?’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘চিঠিতে যা যা তুমি লিখেছ, সেই লেখাগুলো নিয়ে আমি থেকেছি। কিন্তু লেখার কথাগুলোকে ভয় করেছে। ভয় করেছে এই ভেবে যে, ওই কথাগুলো লেখা ছেড়ে বাইরে, চিঠির বাইরে বেরিয়ে গেলেই মিথ্যে হয়ে যাবে না তো? ওই কথাগুলোকে আমি আপন করেছি। তোমাকে আমার আপন মনে হয়নি। লেখার কথাগুলোকে বিশ্বাস করেছি। তোমাকে বিশ্বাস হয়নি। আমি, তোমার কথা আর তোমাকে একসঙ্গে পাইনি। চিনতেও পারিনি।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘কবে থেকে আমাকে চিনতে পারোনি?’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘প্রথম দিন থেকেই বোধ হয়।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘আমায় বলোনি কেন?’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘কী বলব? তোমাকে ভালও তো বেসেছিলাম।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘এখনও বাসো?’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘বাসি না তা তো বলতে পারছি না।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘তা হলে হ্যাঁ বলো।’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘সেটাও তো জোর দিয়ে বলতে পারছি না।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘তা হলে চিঠিগুলোকে ধরে রেখেছ কেন?’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘ওই যে বললাম, ওই কথাগুলো সত্যি বলে।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘আমি মিথ্যে?’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘কে জানে?’
নীহার দত্ত বললেন, ‘তুমি না বলতে পারছ না?’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘পারছি না তো।’
নীহার দত্ত চলে গেলেন। চায়ের কাপটা চা ভর্তি হয়ে পড়ে রইল।
বাড়িতে অনেকগুলো তালা খুলে তবে ঘরে ঢুকতে হয় নীহার দত্তকে। অনেক দিন হল তিনি একাই থাকেন। আজ যেন তাঁর সত্যিই একা মনে হচ্ছে। নীহার দত্ত রাতের খাবার ফ্রিজ থেকে বার করে গরম করেছেন। রাত এখন গভীর। খাওয়া হয়নি এখনও। টিভিতে ‘অ্যানিমেল প্ল্যানেট’ চলছে। একটা সিংহ হরিণ খাচ্ছে। হাড় ভাঙার শব্দ হচ্ছে। নীহার দত্ত দেখছেন। সিংহের বাচ্চারাও সবাই এসে জড়ো হয়েছে। দুটো শকুন এসেছে। এসেছে ক’টা হায়নাও। নীহার দত্ত উর্মিলা মিত্রের লেখা ক’টা চিঠি বার করেছেন। নীহার দত্ত এক বার চিঠিতে মন দিচ্ছেন, এক বার হরিণের হাড় ভাঙার শব্দে টিভিতে মন দিচ্ছেন।
উর্মিলার এই চিঠিগুলো চার বছর আগে লেখা। নীহার দত্ত সাল ধরে ধরে প্যাকেট করে রেখেছেন। এই সময় থেকেই উর্মিলা যেন পাল্টে গেছেন বলে মনে হচ্ছে নীহার দত্তের। তিনি একটার পর একটা চিঠি পড়ছেন আর এ কথাই ভাবছেন। কেন উর্মিলা মিত্র পাল্টে গেলেন, নীহার দত্ত তা বোঝার চেষ্টা করছেন এখন। হঠাৎ তাঁর মোবাইল ফোন বেজে উঠল। নীহার দত্ত দেখলেন উর্মিলা। বহু দিন পরে এত রাতে উর্মিলার ফোন এল।
নীহার দত্ত বললেন, ‘কী হয়েছে? ঘুমোওনি?’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘তুমিও তো ঘুমোওনি।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘কী করছ?’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘একটা লোকের সঙ্গে কথা বলছি।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘বলো।’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘লোকটা বোকা।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘ভাল।’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘আমায় ভালবাসে না।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘বাসে।’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘কতটা?’
নীহার দত্ত বললেন, ‘মাপেনি কোনও দিন।’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘বাইকটা নিয়ে এক্ষুনি চলে এসো।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘এখন!’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘এক্ষুনি।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘না।’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘এক্ষুনি এসো।’
নীহার দত্ত বললেন, ‘কাল সকালে যাব। তুমি এখন ঘুমিয়ে পড়ো।’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘এক্ষুনি এসো!’
নীহার দত্ত বললেন, ‘আমি তো চিঠিতে এ রকম কথা লিখতাম না। লিখতাম তো সব ধীর-স্থির-শান্ত কথা। তোমার তো ওই কথাগুলোকেই পছন্দ। বাস্তবে আমি তো এর বিপরীত। তুমি যাকে বিশ্বাস করো না। আমি এখন তাই, বাস্তবেও চিঠির কথাগুলোর মতোই ধীর-স্থির হয়ে গেছি।
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘প্লিজ, এক্ষুনি এসো না গো!’ নীহার দত্ত বললেন, ‘কাল সকালে যাব। গুড নাইট!’

¶৪¶

আজ শনিবার, ১৩ পৌষ, আজ থেকে সব অন্য রকম
নীহার দত্ত সকালে উর্মিলা মিত্রের বাড়িতে যাননি। অফিসেও নেই তিনি। উর্মিলা অনেককে জিজ্ঞেস করলেন, জানা গেল নীহার দত্ত আসেননি। মোবাইলের সুইচ অফ। কোথায় গেলেন নীহার দত্ত? উর্মিলা মিত্র দু’বার টয়লেটে গিয়ে কেঁদে, চোখে মুখে জল দিয়ে এসেছেন। তবুও স্বাভাবিক হতে পারছেন না। ম্যানেজারকে বলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন উর্মিলা মিত্র। কোথায় খুঁজবেন নীহারকে? কোথায় চলে গেলেন নীহার দত্ত? উর্মিলার প্রায় পাগলের মতো অবস্থা। সোনারপুরে নীহার দত্তের বাড়িতে গিয়ে দেখলেন তালা ঝুলছে। বাগবাজারে গঙ্গার পাড়ে গিয়ে খুঁজলেন। নেই। আরও সম্ভাব্য যে সব জায়গায় তাঁরা এক সঙ্গে যেতেন, কোত্থাও নেই। মাঝে মাঝেই ফোন করছেন উর্মিলা মিত্র। সুইচ অফ। এখন তিনি কী করবেন?
কাঁদতে কাঁদতেই বাড়ি চলে এলেন উর্মিলা মিত্র। মা দরজা খুলে দিলেন। উর্মিলাকে দেখলেন, কিছু বললেন না। উর্মিলা সোজা চলে গেলেন দোতলায় নিজের ঘরে। দেখলে তাঁর খাটে শুয়ে দিব্যি নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন নীহার দত্ত। উর্মিলা মিত্র হতভম্ব! তাঁর কাঁধের ঝোলানো ব্যাগটা ছুড়ে মারলেন নীহার দত্তের গায়। তার পর ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁর ওপর। চুল ধরে টেনে তুললেন। নীহার দত্তও যেন তৈরি ছিলেন এই ঘটনার জন্য। তিনি জড়িয়ে ধরলেন উর্মিলা মিত্রকে। উর্মিলা কেঁদে উঠলেন। নীহার বললেন, ‘এখন থেকে আমার লেখা কথা আর আমি এক।’
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উর্মিলার মা বললেন, ‘ও বেচারা, তুই অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই এসে সেই যে ঘুমিয়েছে, ডাক ওকে। খায়নি কিছু।’ উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘তোমাকে ওপরে উঠতে হবে না সিঁড়ি ভেঙে। আমরা যাচ্ছি। খেতে দাও।’ মা আবার নীচে নেমে গেলেন।
নীহার দত্ত বললেন, ‘আজ শনিবার, ১৩ পৌষ, ১৪১৭ বঙ্গাব্দ; আজ থেকে সব অন্য রকম।’
উর্মিলা মিত্র বললেন, ‘তোমাকে আর ছাড়ছি না!’

ছবি: সায়ন চক্রবর্তী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.