রবিবাসরীয় প্রবন্ধ
হাড় বাজার

ধর্মের হাড়
“তা হলে আপনি কঙ্কালগুলো দেখতে চান? সেটা খুব ঝামেলা নয়। আসলে আমরা ভেবেছিলাম, যদি কোনও খুনের কেস থাকে, তবে ঝামেলা। এমনি ডেড বডি চুরি করলে কেস হয় কি না জানি না। বোধ হয় ছাড়া পেয়ে যাবে।” সিগারেটটাকে প্রায় চুষে শেষ করে ছুড়ে ফেলে দিলেন সাব ইন্সপেক্টরটি। ভারত আর ভুটানের সীমান্তে পশ্চিমবঙ্গের একটা পুলিশ স্টেশন। পেছনেই একটা চৌকো সিমেন্টের গুদাম মতো। তার মধ্যেই ডাঁই করে রাখা মানুষের হাড়। প্রথম ঘরটার মেঝেতে কেবলই পায়ের হাড়। হাড়গুলোতে কেমন একটা মাটি মাটি গন্ধ। অনেকক্ষণ ধরে মাটিতে পড়ে আছে বলেই বোধ হয়।
পাশেই আর একটা বস্তায় একগাদা মাথার খুলি রাখা। সেগুলো আবার কপালের নীচ থেকে কাটা। ওপরের খুলিটা কী রকম বাটির মতো দেখায়।
ভাল করে দেখি। এই হাড়গুলো বেশি পুরনো আর খুব বেশি পালিশ করা। এগুলো তো ডাক্তারির জন্য বিক্রি হবে না। বুঝতে পারি খুঁজতে খুঁজতে আমি অন্য এক ধরনের হাড় বাজারে এসে পৌঁছেছি। এর খদ্দের ডাক্তাররা নয়, সন্ন্যাসীরা। ভুটানি বৌদ্ধদের মধ্যে কোনও কোনও গোষ্ঠীর মধ্যে বিশ্বাস আছে যে, নশ্বরতাকে বোঝার জন্যে মৃতদেহের কাছে সময় কাটাতে হয়। তাই এই বিশ্বাসীরা মানুষের হাড় দিয়ে বানানো নানান রকম পাত্র আর অন্যান্য জিনিস ব্যবহার করেন। যেমন, খুলি দিয়ে প্রার্থনা পাত্র, পায়ের হাড় দিয়ে বাঁশি, আরও অনেক কিছু। হাড় বাজার ২০০ বছর ধরে ভারত দুনিয়ার ডাক্তারি বাজারে হাড় জোগানের কেন্দ্র হিসেবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিল। ১৯৮৫ সালে ভারত সরকার মানুষের দেহাবশেষের ব্যবসা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন। ফলে দুনিয়া জুড়ে কঙ্কালের জোগান মুখ থুবড়ে পড়ে। পশ্চিম তখন চিন আর পূর্ব ইউরোপের দ্বারস্থ হয়, কিন্তু সেখানে এত কঙ্কাল মেলে না। আসলে ভারতের মতো ভাল ভাবে কঙ্কাল পালিশ করে, জোড়গুলোকে ঠিক মতো ভাবে বেঁধেছেঁদে জোগান দেওয়ার দক্ষতা সব দেশের নেই।
এখন ওই নিষেধাজ্ঞার পর বহু বছর পার হয়ে গেলেও, ব্যবসাটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে, এ কথা মনে করার কোনও কারণ নেই। কিছু হাড় ব্যবসায়ী এখনও ব্যবসা করে চলেছেন, সেই চেনা রুটেই। মৃতদেহ চুরি, বা বেওয়ারিশ লাশ জোগাড় করে, মাংস আর হাড় আলাদা করে কঙ্কালগুলো ডিলারদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাঁরা এর পর এই কঙ্কালগুলোকে পালিশ করে, জোড়া লাগিয়ে দুনিয়ার চার দিকে পাঠিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নেন। নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর কঙ্কালের সংখ্যা নিশ্চয় কমেছে, তবে দাম বেড়েছে অনেক বেশি।

কঙ্কাল কারখানা
বঙ্গোপসাগরে নিম্ন চাপের কারণে গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে সে-দিন একটানা বৃষ্টি চলছে। আমরা গাড়ি চালিয়ে চলেছি কলকাতা থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে এক গ্রামে। সেখানে পুলিশ একগাদা খুলি আবিষ্কার করেছে। আমার ভাড়া করা টয়োটা কোয়ালিস সেই কঙ্কালের কারখানার আধ মাইল দূরে আটকে গেল। কাদায় আর গাড়ি এগোবে না, অতএব নিজের হাড়, মাংস আর পেশির জোরই ভরসা। আকাশ স্লেটের মতো কালো, বৃষ্টিটা একঘেয়ে, ঘিনঘিনে। চার দিকে বিশাল বিশাল ব্যাঙ লাফাচ্ছে। কাদা ভেঙে এগোচ্ছি।
২০০৭ সালে পুলিশ যখন এখানে এসে পৌঁছেছিল, এক মাইল দূর থেকেই পচা মাংসের গন্ধ নাকে গিয়েছিল। বাঁশের কাঠামো থেকে মানুষের শিরদাঁড়ার অংশ দড়িতে ঝুলছিল। কারখানার মেঝেতে সারি সারি কঙ্কালের মতো করে হাড় সাজানো ছিল।
এই কারখানাটা ১০০ বছরেরও বেশি পুরনো। কেউ এর কথা জানত না। কিন্তু এক দিন এই কারখানার দু’জন শ্রমিক কোনও এক স্থানীয় ভাটিখানায় মদ খেতে খেতে বুক ফুলিয়ে বলে ফেলেছিল ওরা কেমন করে মৃতদেহ চুরি করে। গ্রামের লোকেরা তখন ওদের টানতে টানতে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়, সেখানে ওরা সব স্বীকার করে। মালিকের নামও জেরার মুখে কবুল করে ফেলে ওই শ্রমিকেরা। পুলিশ সেই মালিককে বার দুয়েক গ্রেফতারও করে, কিন্তু রাজনৈতিক দাদাদের সহায়তায় সে দু’বারই জামিন পায়, এবং পালিয়েও যায়।
দশ মিনিট ওই অন্ধকারে, দম আটকানো বৃষ্টিতে কাদার মধ্যে পা ডুবিয়ে এগোনোর পর আমি একটা আলো দেখতে পেলাম। একটা বাড়িতে চার জন বসে আছে। ‘আপনারা কি ওই কঙ্কাল কারখানার মালিককে চেনেন?’ জিজ্ঞেস করি আমি।
‘ওই শালা তো আমার পয়সা মেরেছে’, উত্তর দেন এক জন। বছর কুড়ির এক জন পুরুষ, সরু গোঁফ। ওঁদের পরিবার ওই কঙ্কাল কারখানায় বহু পুরুষ ধরে কাজ করে এসেছে। লোকটি বলেন উনি আমাকে সব দেখিয়ে দেবেন। সেই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আমরা রওনা দিই।
কঙ্কালের কারখানাটা আসলে একটা বাঁশের কাঠামো। মাথায় একটা তেরপলের ছাউনি। এ রকম এক ডজনেরও বেশি কারখানা আছে। এপ্রিল মাসে পুলিশ প্রচুর হাড়, হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের বালতি আর দুই পিপে ভর্তি কস্টিক কেমিক্যাল নিয়ে গেছে, কেমিক্যালটা কী, সেটা নাকি বোঝা যায়নি। এখন কেবল ওই কাঠামো আর মাটিতে গাঁথা একটা বিশাল হাড় ডোবানোর চৌবাচ্চা পড়ে আছে।
এই কারখানার মালিকেরা তিন পুরুষ ধরে এই ব্যবসায় ছিল। মৃতদেহ পেতে কোনও অসুবিধে ছিল না। কারণ, মালিকটিই আবার গ্রামের শ্মশানের কেয়ারটেকারও ছিল। তার নাকি মৃতদেহ সৎকারের লাইসেন্স ছিল। কিন্তু পুলিশ রিপোর্টারদের জানায় যে, সে আসলে কবর থেকে, মর্গ থেকে, শ্মশান থেকে মৃতদেহ চুরি করছিল। শ্মশানে অনেক সময় আত্মীয়রা মৃতদেহ চিতায় তুলে ওর জিম্মায় রেখে চলে যেত। অমনি সে চিতা থেকে দেহ নামিয়ে ফেলত। সংগৃহীত দেহগুলোকে কঙ্কালে পরিণত করার কাজের জন্য কারখানায় বারো জন মতো সর্বক্ষণের কর্মী ছিলেন।
যে লোকটি আমাকে কারখানাটা দেখাতে নিয়ে গেলেন, তিনি এই কর্মীদেরই এক জন ছিলেন। দিনে ৬৫ টাকা মতো মজুরি। কঙ্কালের জোড়গুলো ঠিক রাখার জন্যে মিলত বোনাস। কারণ, ডাক্তাররা সব সময়েই একটা ঠিকঠাক গোটা কঙ্কালের জন্যে বেশি দাম দিতে তৈরি, জোড়াতালি দিয়ে বানানো কঙ্কালের দাম কম।
এই কর্মীটি আমাকে দেহ থেকে কঙ্কাল তৈরির পদ্ধতিটা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন। প্রথমে মৃতদেহগুলোকে জালের ভেতর ভরে নদীতে ডুবিয়ে রাখা হয়। এখানে নানান জীবাণু আর মাছ মোটামুটি সপ্তাহখানেকের মধ্যে মাংস ক্ষয় করে ফেলে। হাড়গুলো আলাদা আলাদা হয়ে যায়, কিন্তু জালের মধ্যে থাকে বলে আলাদা হয়ে হারিয়ে যায় না। এর পর হাড়গুলোকে পরিষ্কার করে কস্টিক সোডা আর জল মেশানো পাত্রে সেদ্ধ করা হয়। কিন্তু এই সেদ্ধ করার ফলে হাড়ে আবার একটা হলদেটে রং হয়ে যায়। তখন তাদের ‘মেডিক্যাল হোয়াইট’ রঙে আনতে এক হপ্তা রোদে রেখে দিতে হয়, তার পর হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডে ডোবানো হয়।

যিশুর জীবন কাহিনি থেকে ধার করেই যেন এই দেহ
জোগানদারদের বলা হত, ‘রেজারেকশনিস্ট’ বা পুনরুত্থানবিদ।
ভেবে দেখুন, শল্যবিদ, অস্থিবিদ-এর মতো পুনরুত্থানবিদ!
কারণ, তাঁদের হাতেই কবর থেকে দেহগুলোর ‘পুনরুত্থান’ ঘটে!

বিদ্যার হাড়
মানুষের হাড় নিয়ে সংগঠিত পড়াশোনা শুরু হয়েছিল লিওনার্দো দা ভিঞ্চির স্কেচ থেকে। এই ধরনের কাজে ব্যবহৃত কঙ্কালের কথা প্রথম জানা যায় ১৫৪৩ সালে। চিকিৎসা শাস্ত্র যত এগোলো, চিকিৎসকদের মানব শরীর নিয়ে ধারণাকে আরও গভীর করে তোলার জন্যে কঙ্কালের প্রয়োজন বেড়ে চলল। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া নাগাদ ইউরোপে কঙ্কালের চাহিদা জোগানের থেকে অনেক গুণ বেড়ে গেল।
দুনিয়ার বড় বড় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের জন্মভূমি ইংল্যান্ডে দেহ চুরির একটা সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠেছিল। এমনকী কিছু কিছু সমাধিক্ষেত্র শোকগ্রস্ত পরিবার আর কঙ্কালের জন্যে দেহ দখলে মরিয়া চিকিৎসাশাস্ত্রের ছাত্রদের মধ্যে হাতাহাতি মারামারির জন্যে বিখ্যাত বা কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু আমেরিকায় গল্পটা ছিল আরও কঠিন। সেখানে চিকিৎসা ব্যবসা জন সংখ্যার থেকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছিল। ১৭৬০ সালে আমেরিকায় পাঁচটি মেডিক্যাল স্কুল ছিল। একশো বছরে সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় পঁয়ষট্টিতে। আমেরিকায় নানান রকম অসুখ বিসুখ লেগেই থাকত। ফলে ডাক্তারিতে রোজগারের সম্ভাবনা ছিল খুবই ভাল। ঠিকঠাক ভাবে শিখলে আর খাটতে রাজি থাকলে ডাক্তার হতে আর কোনও বাধা ছিল না। অন্যান্য অনেক জীবিকায় প্রবেশের ক্ষেত্রে গরিব বড় লোকের যে প্রশ্ন উঠত, ডাক্তারিতে ভর্তির ক্ষেত্রে উঠত না। এই পেশায় যোগদানে কোনও রকমের সামাজিক বাধা ছিল না। আর্থিক সংস্থান করতে পারলেই ভাল রোজগারের জন্যে পড়া যেত।
ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ছাত্র সংখ্যা হুহু করে বাড়তে থাকল, আর শেখানোর জন্য জরুরি জিনিসপত্রে টান পড়ল, বিশেষ করে শবদেহে।
ঐতিহাসিক মাইকেল স্যাপল তাঁর ‘আ ট্র্যাফিক ইন ডেড বডিজ’ বইয়ে লিখেছেন, কী ভাবে মেডিক্যাল কলেজে শব ব্যাবচ্ছেদের ঘরগুলো ডাক্তারি ছাত্র আর দেহ জোগানদারদের দহরম মহরমের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। পড়াশোনায় সাহায্যের জন্যে মৃতদেহ ছিল জরুরি, তাই সব ছাত্ররাই কঙ্কাল-কারবারিদের হাতে রাখার চেষ্টা করত।
যিশুর জীবন কাহিনি থেকে ধার করেই যেন এই দেহ জোগানদারদের বলা হত, ‘রেজারেকশনিস্ট’ বা পুনরুত্থানবিদ। ভেবে দেখুন, শল্যবিদ, অস্থিবিদ-এর মতো পুনরুত্থানবিদ! কারণ, তাঁদের হাতেই কবর থেকে দেহগুলোর ‘পুনরুত্থান’ ঘটে! এই বিশেষজ্ঞরা মেডিক্যাল কলেজে আড্ডা জমাতেন। তরুণ ডাক্তাররা তাদের সঙ্গে, যাকে বলা হয় ফাঁসুড়ে রসিকতায় মাততেন। এই সময়ের অনেক রিপোর্টে পড়া যায়, ডাক্তাররা কী ভাবে দেহগুলোর সঙ্গে পোজ দিতেন আর মেডিক্যাল কলেজের জানলা দিয়ে রাস্তার পথচারীদের দিকে কাটা হাত পা নাড়াতেন।
আমেরিকান সমাজ এই দেহ চুরির ব্যাপারটাকে মোটেও ভাল চোখে দেখত না। বেশির ভাগ দেহই চুরি হত কালো মানুষ বা আইরিশদের কবর থেকে। কারণ, এই দুই ধরনের মানুষই ছিলেন সমাজের সবচেয়ে নিচু তলার বাসিন্দা।
দেহ চুরি এতই বেড়েছিল যে, বড় লোকেদের সমাধিগুলো আস্তে আস্তে সুরক্ষিত হয়ে উঠল। সমাধিতে প্রহরী, কংক্রিটের স্তম্ভ এমনকী অ্যালার্ম লাগানোর প্রচলন হল। তবে মোটের ওপর ডাক্তারি শিক্ষার কথা মাথায় রেখে আইন এই ব্যাপারে তত কঠোর হয়নি। এই কারণেই মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে শুরু করেছিল। ১৭৬৫ থেকে ১৮৮৪ সালের মধ্যে দেহ চুরি নিয়ে আমেরিকা জুড়ে একটা-দুটো নয়, কুড়ি-কুড়িটা দাঙ্গার খবর পাওয়া যায়। লোক জন কবরখানায় জমায়েত হত, ফাঁকা কবর দেখলে গিয়ে মেডিক্যাল কলেজে হামলা করত। কিন্তু এই আন্দোলনের ফলে দেহ ব্যবসা বেআইনি হয়নি। সেটা অন্য একটা গল্প। এ বার সে গল্পে আসা যাক।

হাড় চাই হাড়
ওয়েস্টপোর্ট শহরে উইলিয়াম হেয়ার-এর একটা ভাঙাচোরা বোর্ডিং হাউস ছিল। সেই বোর্ডিংয়ের অধিকাংশ বাসিন্দাই ছিল হতভাগ্য গরিব মানুষ। প্রায়শই না খেতে পাওয়া বোর্ডাররা সেখানে মরে যেত। আর হেয়ারকে তাদের দেহগুলোর সদগতির দায়িত্ব নিতে হত।
এক বার এই রকম একটা দেহের শেষকৃত্যের জন্যে হেয়ার সেটি নিয়ে যাচ্ছিলেন। এক জন মানুষ দেহটি তাঁর কাছ থেকে কিনে নিতে চান। বিনিময়ে হেয়ার ১০ পাউন্ড পান। ক্রেতা হেয়ারকে আরও বলেন যে, আরও দেহ পেলে তিনি এই রকম টাকা দিতে রাজি আছেন। এই ঘটনার পরে হেয়ারের মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি চাপে। তিনি বার্ক বলে আর এক জনকে সঙ্গে নিয়ে এক বছর ধরে সতেরো জনকে বীভৎস ভাবে হত্যা করে দেহগুলো বিক্রি করে দেন। অনেকটা এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই ইংল্যান্ডে ১৮৩২ সালের ‘অ্যানাটমি অ্যাক্ট’ চালু হয়।
মৃতদেহটি জীবিত অবস্থায় কে ছিল, এই নিয়েও কিন্তু চিরকালই মাথাব্যথা ছিল। অনেক সময় ডাক্তারদের চেম্বারে ঝোলানো দেহগুলোতে লেখা থাকত যে সেগুলো মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত কালো মানুষদের দেহ। তার ফলে সাদা মানুষরা নিশ্চিত হতে পারতেন যে, তাঁদের জাতের দেহের মরণোত্তর অসম্মানের ভয় নেই। তাঁরা যে দেহ কঙ্কাল নিয়ে কাটাছেঁড়া করছেন, সেগুলো কালো মানুষের।
কিন্তু সমস্যা হল যে যথেষ্ট পরিমাণ কালো লোকেদের কঙ্কাল পাওয়া যাচ্ছিল না। ব্রিটিশ ডাক্তারদের তাই চোখ পড়ল উপনিবেশগুলোর ওপরে। স্বভাবতই উপনিবেশ ভারত বাদ পড়ল না।
ভারতে ডোম জাতির লোকেদের এই হাড় জোগানের কাজে লাগানো হল। ১৮৫০ সাল নাগাদ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ বছরে ১০০টা কঙ্কাল জোগান দিচ্ছিল। প্রায় ১০০ বছর পরেও নতুন স্বাধীন ভারত এই জোগানে অগ্রণী ছিল।
১৯৮৫ সালে ‘শিকাগো ট্টিবিউন’-এ খবর বেরোয় যে ভারত তার আগের বছর ষাট হাজার খুলি ও কঙ্কাল রফতানি করেছিল। ব্যবসার ভাল সময়ে কলকাতার হাড় কারখানার মোট বাৎসরিক ব্যবসার মূল্য ছিল দশ লক্ষ ডলার।

ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়া
কঙ্কাল ব্যবসায়ের স্বর্ণ যুগে কলকাতায় হাড়ের কারখানায় চাকরি করাটা বেশ সম্মানজনক ছিল। এই কারখানাগুলোতে শারীরবিদ্যা চর্চাভিত্তিক একটা বৈজ্ঞানিক পরিবেশ ছিল।
কলকাতা শহরের প্রশাসনও তখন প্রয়োজনীয় লাইসেন্স ইত্যাদির মাধ্যমে পূর্ণ সহায়তা করত। ব্যবসাটার ভাল দিকও ছিল। কেবল বেওয়ারিশ লাশের গতি হত তাই নয়, একটা বাণিজ্যিক ভাবে মরে যাওয়া শহর যেন তার কঙ্কাল বেচে করে খাচ্ছিল। কিন্তু সমস্যাটা হল যে কেবল বেওয়ারিশ লাশ আর ছোটখাটো কবর চুরি দিয়ে চাহিদা মেটানো যাচ্ছিল না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মরণোত্তর কঙ্কাল দানের ভরসায় জীবিতদের আগাম দাদন দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু সেও তো খুব সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কবে মরবে সেই ভরসায় তো নিয়মিত জোগান চালিয়ে যাওয়া যায় না। তাই বড় ধরনের মড়া চুরিতে জড়াতেই হল। ১৯৮৫ সালে পনেরোশো শিশুর কঙ্কাল আবিষ্কার হওয়ায় দেশ জুড়ে আলোড়ন তৈরি হল। খবরের কাগজ দাবি করল, ওই শিশুদের চুরি করে হত্যা করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আদেশ বলে মানব শরীরের রফতানি বেআইনি বলে ঘোষিত হল। কঙ্কালের ব্যবসা প্রকাশ্য ভাবে বন্ধ হয়ে গেল।
কিন্তু কোনও কোনও নদীর বুকে এখনও জালে ভরে ডোবানো থাকে লাশ। মাছেরা ঠোকর মারে। ফুটে ওঠে হাড়। এর পরে সে অ্যাসিডে ফর্সা হবে, পালিশ হবে। নানান নোটের হাত বদল হবে নানান থানায় আর এয়ারপোর্টে। এক দিন সেই মানুষ উড়ে যাবে কোনও এক উন্নত দেশে, অবশ্য মানুষ হিসেবে নয়, কঙ্কাল হয়ে। যেমন ওই মাছেরাও এক দিন দারুণ হোটেলে যাবে, অবশ্য ‘খাবার খেতে নয়, খাবার হিসেবে’।

সূত্র: দ্য রেড মার্কেট। স্কট কার্নি, উইলিয়াম মরো


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.