শেষ পর্যন্ত ওঁরা পারলেন!
ওঁরা, অর্থাৎ সরকারি হাসপাতালের এক দল চিকিৎসক। এবং এমন কিছু মানুষ, যাঁরা আদৌ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত না-হলেও বস্তুত ‘মুষ্ঠিভিক্ষা’ করে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে গড়ে তুলেছেন ক্যানসার চিকিৎসার পরিকাঠামো। গরিব রোগীকে যতটা সম্ভব স্বল্প খরচে পরিষেবাদানের লক্ষ্য নিয়ে। স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, সরকারি বা বেসরকারি স্তরে জেলায় এমন চিকিৎসাকেন্দ্র রাজ্যে এই প্রথম। তাঁদের আশা, আজ, (৪ ফেব্রুয়ারি) বিশ্ব ক্যানসার দিবসে এই ‘বহরমপুর মডেল’ই পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে প্রকৃত ‘বিকল্পের’ প্রতীক হয়ে উঠবে।
বহরমপুরের দু’টি সরকারি হাসপাতালের কোথাও ক্যানসার চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। স্বাস্থ্য দফতর-সূত্রের খবর: শুধু বহরমপুর নয়, রাজ্যের অন্যান্য জেলার মতো মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন অংশে কার্যত বিনা চিকিৎসায় বহু ক্যানসার রোগীর মৃত্যু হয়েছে। বহরমপুরের এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ক্যানসার চিকিৎসার পরিকাঠামো গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়। বাড়ি বাড়ি ঘুরে অর্থ সংগ্রহ করে তৈরি হয় চিকিৎসাকেন্দ্র। তার পরে প্রশ্ন দেখা দেয়, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাওয়া যাবে কী ভাবে? সংগঠনের সদস্যেরা কলকাতায় এসে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁদের উদ্যোগে সাড়া দিয়ে কলকাতার কয়েক জন ডাক্তার বহরমপুরে গিয়ে কাজ করতে রাজি হয়ে যান।
এই যৌথ প্রয়াসের পরিণতি হিসেবে গত ডিসেম্বরে বহরমপুরে চালু হয়েছে ওঁদের ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র। কলকাতার সেই সরকারি ডাক্তারেরা ফি রবিবার বহরমপুরে গিয়ে বিনা পয়সায় রোগী দেখছেন। ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে দরিদ্র রোগীদের জন্য কম খরচে কেমোথেরাপির ওষুধের বন্দোবস্ত করছেন। ওখানে কেমো দেওয়ার পরিকাঠামো ব্যবহারের জন্যও রোগীদের খরচ লাগছে না। কিন্তু উদ্যোক্তারা খরচ চালাচ্ছেন কী ভাবে?
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির তরফে কাঞ্চন মৈত্র বলেন, “আমরা বাড়ি-বাড়ি ঘুরে আক্ষরিক অর্থেই ভিক্ষা চাইছি। যে পরিবারে কারও ক্যানসার নেই, তাঁরাও ভবিষ্যতের আশঙ্কায় হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন।” প্রথম দফায় আট লক্ষ টাকা উঠেছে। কাঞ্চনবাবুর কথায়, “২০০৯ থেকে চেষ্টা চলছে। আগে ক্যানসার নিয়ে বিস্তর সচেতনতা শিবির করেছি। পরে মনে হল, চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে না পারলে, এ সবই অর্থহীন।”
কাঞ্চনবাবুদের উদ্যোগ সফল করতে মদতের হাত বাড়িয়েছেন যে চিকিৎসকেরা, তাঁদের কী বক্তব্য? এনআরএসের রেডিওথেরাপি-র প্রধান চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র চালু করার উদ্দেশ্যে ওই সংগঠনের সদস্যরা নিজেদের সঞ্চিত অর্থও খরচ করছেন! এটা শুনে আর বসে থাকতে পারলাম না। ওঁদের উদ্যোগে যুক্ত হয়ে গেলাম। রোগীদের কাছে চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়ার দায়বদ্ধতা তো আমাদের সকলেরই।” স্বাস্থ্য-সূত্রের খবর: বহরমপুরের কেন্দ্রটিতে নদিয়া, বীরভূম, বর্ধমানের একাংশ, এমনকী বাংলাদেশ থেকেও রোগী আসছেন।
রাজ্যে পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের আমলে স্থির হয়েছিল, কলকাতার বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের ক্যানসার-চিকিৎসকেরা জেলায় গিয়ে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেবেন। জেলাস্তরে ‘টিউমার বোর্ড’ গঠনেরও সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন, সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে ‘কলকাতামুখী’ না-করে জেলায় জেলায় ছড়িয়ে দেওয়া হবে। বাস্তবে অবশ্য সে পরিকল্পনাও খুব একটা এগোয়নি। এই অবস্থায় ‘বহরমপুর মডেল’ কি সরকারকে কোনও বার্তা দিচ্ছে?
স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, “পরিস্থিতি যে দিকে এগোচ্ছে, তাতে এমন উদ্যোগ শুরু না-হলে ক্যানসারে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। কারণ, জেলায় পরিকাঠামো ছড়িয়ে দিতে আমরা উদ্যোগী হলেও চিকিৎসকেরা অনেকেই আগ্রহী হচ্ছেন না। ভাবছেন, দায়িত্ব বেড়ে যাবে।” বেসরকারি হাসপাতালের ক্যানসার শল্য-চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “সরকারি-বেসরকারি ডাক্তারেরা এক সঙ্গে এমন প্রয়াসে সামিল হলে আরও বেশি মানুষ উপকৃত হবেন।” |