|
|
|
|
|
|
|
ব্যাগ গুছিয়ে... |
একটি প্রাগৈতিহাসিক চিঠি
কালের স্রোত নষ্ট করতে পারেনি ভীমবেটকার গুহাচিত্র।
অমলিন তার রং। লিখছেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় |
|
দাক্ষিণাত্য মালভূমির উপকণ্ঠে, বিন্ধ্য পর্বতমালার উত্তর সীমানার গা ঘেঁষে, মধ্যপ্রদেশের রাইসেন জেলার রাতাপানি অভয়ারণ্যের মধ্যে একটি রুক্ষ এবং নিচু পাহাড়ি অঞ্চল জুড়ে ভীমবেটকার ব্যাপ্তি। ভীমবেটকার পর্ণমোচী জঙ্গলমহল পাহাড় প্রকৃতির শুষ্কতা ও রুক্ষতাকে ঢেকে দিয়েছে অনেকটাই। নিঝুম সন্ধ্যায় বনমোরগ, কোয়েল, হুপো, শালিখ আর মাছরাঙারা দলে দলে এসে আশ্রয় নেয় ভীমবেটকার গুহায়। আছে শ্লথ ভালুক, হায়না, নীলগাই, চিতল হরিণ আর সজারু। গ্রামের মানুষ আর পশুপাখির জন্য আছে বেতোয়া আর নর্মদার জল।
মাঝারি আকৃতির দানা দানা স্যান্ডস্টোনের এই পাহাড়গুলিতে দুধ সাদা রঙে হালকা গোলাপি ছোঁয়া এসেছে। ভীমবেটকার ঘন জঙ্গল সংলগ্ন উপত্যকায় বসন্তে পলাশের আগুন জ্বলে। মহুয়া ফুলের গন্ধে চার দিক ম ম করে। প্রকৃতির খেয়ালে পাহাড় যেন কথা বলে এখানে। এক একটা পাহাড়ের আকৃতি এক এক রকম। প্রাগৈতিহাসিক যুগে যখন মানুষ ছিল না তখন এই পাহাড় ছিল সমুদ্রের কাছাকাছি। তখন জলের খরস্রোতে তৈরি হয়েছিল গুহাগুলি। আদিম মানুষ সেই গুহা আবিষ্কার করে সেখানে বসবাস শুরু করে। আপন মনে মেলে ধরে তাদের সৃজনশীলতা, যার ফলস্বরূপ আজও আমরা দেখতে পাই এই গুহাচিত্রগুলি। |
|
পাহাড়ের নানা আকৃতি দেখে শেষ করা যায় না। কিন্তু সবচেয়ে বড় দ্রষ্টব্য হল গুহাচিত্র। বিশাল একখানি জু-রক রয়েছে যার ভেতরে আপন খেয়ালে বহু যুগ ধরে বহু মানুষ এঁকে গেছে একপাল পশুর রেখাচিত্র। কোনও ছবিতে ঘোড়সওয়ার নিয়ে চলেছে একপাল যোদ্ধা। কোনওটিতে কেউ এঁকে রেখেছে মোষের প্রতিকৃতি। কোথাও আবার হাতির পাল কিংবা ছুটন্ত হরিণের সার। কেউ এঁকে রেখেছে ঘোড়ার পিঠে বাজনদার এবং নৃত্যরত মানুষ। কোনওটিতে রাখাল বালক বাঁচিয়ে রেখেছে এই সব দুষ্প্রাপ্য গুহাচিত্র। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও একে ছুঁতে পারেনি।
ভারতবর্ষের মানবসভ্যতার এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ১৯৫৭-’৫৮ সালে আবিষ্কার করে জনসমক্ষে তুলে ধরেন ভি এস ওয়াকাঙ্কার। প্রায় চারশোটি চিত্রাঙ্কিত গুহা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ভীমবেটকার জঙ্গলে। এই শৈলাশ্রয়গুলি ইউনেস্কো-ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ। পেশাদার প্রত্নতত্ত্ববিদেরা ভীমবেটকায় পাওয়া পাথরের অস্ত্র, প্রাগৈতিহাসিক কঙ্কাল, ভস্মচূর্ণ এবং মৃৎপাত্রের টুকরো নিয়ে অনেক গবেষণা করে এক লক্ষ বছরের কাহিনি তৈরি করেছেন। কিন্তু আপামর জনসাধারণের কাছে ভীমবেটকার মাহাত্ম্য হল তার গুহার দেওয়াল চিত্র। কালের স্রোত যাকে বিনষ্ট করতে পারেনি। মুছে যায়নি সেই সব গুহাচিত্রের রং। ভীমবেটকার ছবির বিষয়বস্তু প্রথমে ছিল পশুপাখি। পরে তার সঙ্গে জুড়েছে নারী, পুরুষ ও শিশুর অবয়ব। তারও পরে পশুর সঙ্গে মানুষের যুদ্ধ, পশুর পিঠে মানুষের আরোহণ ইত্যাদি। ঘোড়ায় চড়া ও মাথায় ছাতা নেওয়া রাজার ছবির অপূর্ব চিত্র যা এখনও নজর কাড়ে। এ ছাড়াও রয়েছে জ্যামিতিক নকশাচিত্র। এর থেকে বোঝা যায় যে কালের আবর্তনে সমাজ কী ভাবে পাল্টে গেছে। |
|
কিছু কিছু শিকারের দৃশ্য ও নৃত্যরত মানব-মানবী আঁকার ধরনটির সঙ্গে এখনকার সাঁওতাল ও তফসিলি উপজাতির পুজোর সময় গৃহ অলঙ্করণের দেওয়াল চিত্রের বেশ ভাল রকম মিল পাওয়া যায়। ভারতবর্ষের লোকসংস্কৃতির ধারাবাহিকতার এক অত্যাশ্চর্য নিদর্শন এই ভীমবেটকা। সাড়ে ছ’হাজার বছরের বিবর্তনে ছবির বিষয়বস্তু যেমন বদলে গেছে, ঠিক তেমনই পাল্টে গেছে ছবি আঁকার পদ্ধতি, ব্যবহৃত রং ও সরঞ্জাম। ভীমবেটকার গুহাচিত্রে তিন ধরনের ছবি দেখা যায়। যা এখনকার ভাষায় জল রং, তেল রং এবং শুকনো মোম রং। বেশির ভাগ ছবি সাদা ও লাল রঙে আঁকা। আবার কিছু কিছু সবুজ, কমলা, হলদে ও বেগুনি।
মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপালের ৪৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে ওবাইদুলাগঞ্জ-ইটারসি হাইওয়ের (৬৯ নম্বর জাতীয় সড়ক) ধারে ভীমবেটকার বিশাল জঙ্গল। ভীমবেটকার গা ঘেঁষে ভিয়ানপুর গ্রাম। ভীমবেটকার পার্বত্য এলাকার উচ্চতা সমুদ্রতল থেকে ৬০০ মিটার।
কথিত আছে, পঞ্চপাণ্ডবেরা অজ্ঞাতবাসের সময় এখানে বাস করেছিলেন। ভীমবেটকা সংলগ্ন লাক্ষাজুহার জঙ্গলে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার চক্রান্তে লাক্ষা নির্মিত গৃহ সুকৌশলে নির্মাণ করেন দুর্যোধন।
|
কী ভাবে যাবেন |
|
হাওড়া থেকে ট্রেনে ভোপাল। সেখান থেকে গাড়িতে ঘণ্টা দু’য়েকে ভীমবেটকা। |
কখন যাবেন |
গ্রীষ্মকাল বাদ দিয়ে জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত ভীমবেটকা যাওয়া যায়। |
কোথায় থাকবেন |
ভীমবেটকায় মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের হোটেল আছে।
ভোপালে অনেক বেসরকারি হোটেলও আছে। |
|
|
|
|
|
|
|