আমরি-কাণ্ডে মণি ছেত্রী ও প্রণব দাশগুপ্তের মতো দুই প্রবীণ চিকিৎসক গ্রেফতার হওয়ায় শহরের চিকিৎসক মহলের একাংশ যে প্রবল অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত এক বিতর্কসভায় তা পরিষ্কার হয়ে গেল।
রাজ্যে সুচিকিৎসা আদৌ হয় কি না, তা নিয়ে রবিবারের ওই বিতর্কসভায় দেখা গেল, যাঁদের হাতে চিকিৎসা দেওয়ার ভার, তাঁরাই সুবিচার চাইছেন! চিকিৎসকদের আক্ষেপ: যে কোনও পরিস্থিতিতে কাঠগড়ায় তাঁদেরই দাঁড়াতে হচ্ছে তা সে রোগীর মৃত্যুই হোক, কিংবা হাসপাতালে আগুন! রাজ্যের নতুন সরকারকে ঠেস দিয়ে কথা বলতেও পিছপা হলেন না বক্তা-চিকিৎসকদের কেউ কেউ।
বিতর্কের বিষয় ছিল: ‘পশ্চিমবঙ্গে সুচিকিৎসা হয় না।’ আলোচনাকে মূল সুরে গাঁথতে অর্থনীতির শিক্ষক অভিরূপ সরকার উন্নত চিকিৎসা পেতে রাজ্যের অসংখ্য গরিব মানুষের হয়রানির প্রসঙ্গ টেনেছিলেন। দাবি করেছিলেন, দক্ষিণের চিকিৎসকদের মধ্যে যে ‘সেবা’র মানসিকতা, পশ্চিমবঙ্গে তা দুষ্প্রাপ্য। জবাবে শহরের হৃদ্রোগ চিকিৎসক কুণাল সরকার টেনে আনলেন এ রাজ্যের ডাক্তারদের ‘দুরবস্থা’র প্রসঙ্গ। পরোক্ষ ভাবে এল আমরি-কাণ্ডও।
কুণালবাবু বললেন, “কখন হাসপাতালে আগুন লাগবে, আর কখন পুলিশ এসে তুলে নিয়ে যাবে, কেউ জানে না! ডাক্তারদের সময়টা মোটেই ভাল যাচ্ছে না।” প্রশাসনকে কিছুটা কটাক্ষ করে তাঁর মন্তব্য, “ডাক্তারদের পিছনে ছপটি হাতে ঘুরে বেড়ানোর প্রবণতা শুধু মহাকরণে সীমাবদ্ধ নয়। এখানে এসে দেখছি, অন্যদের মধ্যেও প্রবণতাটা ছড়িয়ে যাচ্ছে!” অভিরূপবাবুর উদ্দেশে কুণালবাবু বলেন, “আমজনতার স্বার্থে রাজ্যে পপুলেশন হেল্থ ইন্সিওরেন্স চালু করা যেতে পারে। জনশ্রুতি রয়েছে, অভিরূপবাবু নাকি সরকারের খুব কাছের লোক। উনি যদি সরকারের কানে বিমার বিষয়টা তুলতে পারেন, ভাল হয়। তবে শুনেছি, কানে তোলার কাজটা সহজ নয়!’’
চিকিৎসকদের ‘অসহায়তা’ নিয়ে সরব ছিলেন অস্থি-চিকিৎসক ইন্দ্রজিৎ সর্দারও। যাঁর আশঙ্কা, “যা কিছুই হোক, দেখা যাবে ডাক্তাররাই কাঠগড়ায়! এমনকী, হাসপাতালে আগুন লাগলেও ডাক্তার জেলে!” সব সময়ে চিকিৎসকেরাই কেন অভিযুক্ত হবেন, সে প্রশ্ন তুলে ইন্দ্রজিৎবাবুর খেদ, “ডাক্তারেরা ওষুধের দাম ঠিক করেন না, চিকিৎসার বাকি খরচ স্থির করেন না, রাস্তার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেন না। অথচ কিছু ঘটলে তাঁরা আক্রান্ত হন। কারণ, মানুষ চিকিৎসা পাওয়ার জন্য গিয়ে প্রথমে তাঁদের দেখে, শেষেও তাঁদেরই দেখে!” কুণাল-ইন্দ্রজিতেরা সওয়াল করছিলেন বিষয়ের বিপক্ষে। তাঁদের দলের ‘সেনাপতি’ প্রবীণ চিকিৎসক সুকুমারও মুখোপাধ্যায়ও সক্রিয় ছিলেন চিকিৎসকদের ‘সুরক্ষা’ নিয়ে। সুকুমারবাবু বলেন, “হাজরা মোড়ে দুর্ঘটনা ঘটল। রাস্তার জ্যাম পেরিয়ে এসএসকেএমে পৌঁছতেই বহু সময় লেগে গেল। আহত মানুষটি বাঁচলেন না। তাতেও সকলে চিকিৎসকেরই দোষ দেখেন।”
সুজাতা মুখোপাধ্যায়ের একটি বই প্রকাশ উপলক্ষ্যে রোটারি সদনে ওই অনুষ্ঠানের সূচনাতেই সঞ্চালক, সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্য মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, “এটা নিছক বিতর্কসভা। কাউকে পর্যুদস্ত করা উদ্দেশ্য নয়।”
কিন্তু বক্তাদের তির্যক মন্তব্যের তোড়ে বার বার ভেসে যাচ্ছিল তাঁর আবেদন। বিষয়ের পক্ষে অভিরূপবাবু ছাড়া ছিলেন নাট্য পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়, অভিনেতা আবীর চট্টোপাধ্যায়, সাংবাদিক স্বাতী ভট্টাচার্য। আর বিপক্ষে তিন চিকিৎসক ছাড়াও ছিলেন কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালের সিইও রূপালি বসু। আবীর তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানালেন, ‘চেনা-জানা’ না-থাকলে পশ্চিমবঙ্গে ভাল চিকিৎসা পাওয়া দুষ্কর। স্বাতীর অভিযোগ: চিকিৎসকদের পেশায় আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাব বড় বেশি। আর সুমনের উপলব্ধি: এ রাজ্যের সাধারণ মানুষ চিকিৎসা নিয়ে খুশি নন। বড় ডাক্তারের কাছে রোগীর মৃত্যু হলে এখনও তাঁদের মনে হয়, পাড়ার ডাক্তার ছেড়ে বড় ডাক্তারের কাছে গিয়ে লাভ তো হলই না, উল্টে সর্বস্বান্ত হলাম!
রাজ্যের চিকিৎসা-পরিকাঠামো নিয়ে মানুষের এই সব ক্ষোভের জবাব দিতে দিয়ে চিকিৎসকেরা মূলত তাঁদের আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টিই সামনে আনলেন। তার মাঝে সুকুমারবাবুর ‘পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে’ গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ কিংবা রোবোটিক সার্জারি চালুর ক্ষেত্রে কলকাতার ‘এগিয়ে থাকা’ নিয়ে রূপালিদেবীর দাবি নেহাতই যেন নিয়মরক্ষার মতো ছুঁয়ে গেল মূল বিষয়কে।
তবু, বিতর্কের শেষে যখন দর্শক-শ্রোতাদের মতামত জানতে চাওয়া হল, তখন রায় গেল চিকিৎসকদের পক্ষে! সেটা কি শুধু শ্রোতাদের মধ্যে ডাক্তারদের উপস্থিতি বেশি থাকার কারণে? |