পরিবারের শিশুদের দেখাশোনার জন্য ছুটি যে প্রয়োজন, সে নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। শুধু শিশু নয়, বয়স্কদের দেখভালের দায়িত্বও পরিবারের মেয়েদেরই ওপর বর্তায়, সেটাও অনস্বীকার্য। যেটা এই সরকারি ছুটির বিধিতে ধরা নেই। যেমন ধরা নেই পরিবারের আরও যে সব দায়িত্ব মেয়েদের উপরে ছেড়ে দেওয়া হয়, সে সব কাজে ব্যয়িত সময়ের হিসেব। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন আসবে, কে ছুটি নেবে? মেয়েরাই। দেওরের বিয়ের কেনাকাটি করতে যেতে হবে, কে যাবে ছুটি নিয়ে? বউদি ছাড়া আর কে? ‘ও ঠিক ছুটি ম্যানেজ করে নেবে’! অবশ্য অসংগঠিত ক্ষেত্রেও তো মেয়েরা কাজ করে ন্যায্য ছুটিটুকু পান না, তা নিয়ে তদবির করার লোকও প্রায় নেই। সে কথায় আপাতত যাচ্ছি না। প্রশ্ন হল, সন্তান ধারণ করা একটি জৈবিক বিষয়। সে জন্য একটি নারীশরীর প্রয়োজন। তাই এখনও মায়ের কোনও বিকল্প নেই। সে জন্য মাতৃকালীন ছুটি মেয়েরাই পেতে পারেন। তাই সন্তান ধারণ করলে মাতৃকালীন ছুটির অধিকারী হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যখন এক জন মা দত্তক নিয়েও মাতৃত্বকালীন ছুটির হকদার হয়ে ওঠেন, সেটা এগোনোর চিহ্ন হিসেবেই ধরা যায়। কিন্তু পরীক্ষা বা অসুখের সময় মাকেই সন্তানের পাশে থাকতে হবে, এ কথা সরকারি ভাবে বললে সন্তানের প্রতি সমদায়িত্ব থেকে যেন বাবাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। মায়েরা বাইরে কাজ করলেও ঘরটাই যে তাঁদের জীবনে মুখ্য, দাগা বুলিয়ে দেওয়া হয় সে ভাবনাটাতেও।
অর্থনীতি এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের কাজে যোগদানের হার বাড়ছে সব দেশেই। আমাদের গড় আয়ুও বাড়ছে। নির্ভরশীল বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ও অনুপাত বাড়ছে। তিরিশ বছর আগে যে মেয়েরা কাজে যেতেন, তাঁদের যত জনের মা-বাবা-শ্বশুর-শাশুড়ি আশি বছর পর্যন্ত বাঁচতেন, আজ তার তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক ওই বয়স পর্যন্ত বাঁচেন। আবার তিরিশ বছর আগে যে বয়স পর্যন্ত পরিবার সন্তানদের দেখাশোনা করত, জীবনযাত্রার মান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সন্তানদের থেকে তার চেয়েও বেশি বয়স পর্যন্ত তাদের দেখাশোনা করা হয় এবং আরও বেশি মাত্রাতেই করা হয়, তাই সন্তানদের কাছে প্রত্যাশা বেড়েছে। ফলে তাদের পিছনে ব্যয়িত সময় বেড়েছে। তাই পড়ার পর টিউশনি তো বটেই, মেয়েকে ক্রিকেট প্র্যাকটিসে বা ছেলেকে নাটকের স্কুলে দিয়ে মায়েদের অপেক্ষা করার সময় বেড়েছে। আর এ সবই হয়েছে, কারণ চার দিক থেকে পরিবার-স্কুল-খবরের কাগজ-মেয়েদের পত্রিকা, সবাই বড় গলায় ঘোষণা করছে যে ভাল করে সন্তানদের, পরিবারকে দেখাশোনা মেয়েদের, মায়েদের কাজ। তাই মা বাইরে কাজ করেন বলে বাবা নিয়মিত স্কুলের অভিভাবকদের সভায় গেলে দিদিমণিদের কাছে রীতিমত বকুনি খান, ‘এ বার থেকে মাকে পাঠাবেন’!
বিদেশেও বিবাহিতা মেয়েদের কাজে যোগদানের ক্ষেত্রে এই একই সমস্যা। বাইরের কাজ বেড়েছে কিন্তু পরিবারের দায়িত্ব ততটা কমেনি। সেখানে রাষ্ট্র অনেক সময় বাচ্চাদের দেখাশোনার ভার নিচ্ছে, যাতে মায়েরা শুধু নন, বাবারাও নিশ্চিন্তে কাজে যেতে পারেন। এখানেই হচ্ছে বিদেশের সঙ্গে আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকদের মনোভাবের মূল ফারাক। সেখানে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে থেকেই দায়িত্ব দু’জনের, এ ভাবনাটা স্বীকৃতি পেয়েছে। সেখানে যেমন মাতৃকালীন ছুটির সঙ্গে সঙ্গে পিতৃকালীন ছুটি আছে, তেমনই সন্তানপালনের জন্য বাবা-মায়েদের দু’জনের যে কোনও এক জন ছুটি নিতে পারবেন বলে (পেরেন্টাল লিভ) ব্যবস্থাও আছে। তবে সেখানেও একলা মায়েদের পরিবারের সংখ্যা খুব বেশি, আর বিয়ে ভাঙার হারও যথেষ্ট বেশি বলে সন্তান বেশির ভাগ মায়ের দায়িত্বেই থেকে যায়। বাবারা দায়িত্ব এড়িয়ে পালিয়েছে এই ঘটনা পশ্চিমী দেশে খুব নিয়মিত ঘটে থাকে। আর শেষ বিচারে সেখানেও মেয়েরাই বেশি ঘরের কাজ করেন, এখনও।
পশ্চিমী দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের মতো দেশের মেয়েদের পারিবারিক দায়িত্বের বড় ফারাক হল যে, সেখানে বয়স্কদের ভার মোটামুটি ভাবে রাষ্ট্র নিয়েছে। কিন্তু আমাদের মতো দেশে, যেখানে পরিবারের বাঁধন এখনও কিছুটা বজায় রয়েছে, রাষ্ট্র নিজেকে কল্যাণকামী বলে দাবি করলেও বয়স্কদের দায়িত্ব এখনও পরিবারের উপরেই রয়েছে। বয়স্ক মানুষদের গড় আয়ু বাড়ার ফলে সে সব দেশে বেড়েছে ‘ক্রনিক’ ধরনের অসুখের হার। ফলে ভারত, চিন বা ব্রাজিলের মতো দেশে, মেয়েদের কাজ অনেকটা বেড়ে গিয়েছে।
|
সন্তান ধারণ আর পালন যে সমাজেরই প্রয়োজনে, সেটা পুরুষ সহকর্মীরা এবং সমাজ এখনও মনে করে না। সন্তান ধারণ আর পালন একটি নারীর শুধুমাত্র ব্যক্তিগত খুশির বিষয় বলেই ধরা হয়। তাই নারী-পুরুষ দু’জনেই এই ছুটি পেলে সন্তানপালনের বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষিতটাকে ধরা যেতে পারত। নয়তো সরকারি দফতরও বাধ্য না হলে নারীকর্মী নিতে চাইবে না, ‘ওঁদের অনেক বেশি ছুটি দিতে হয়’ বলে একঘরে করে রাখা সম্ভব হবে। একই মাইনেতে বেশি ছুটি মানে আসলে মাইনেটাই বেশি। এই যুক্তিতে নারীকর্মীরা অনেক বেশি ‘দামি’, অতএব ওঁদের ছাঁটো এই ধরনের আলোচনা বাতিল হয়ে যেত যদি নারী-পুরুষ সব কর্মীই চাইল্ড কেয়ার লিভ পেতেন।
পশ্চিমী দেশে শিশু জন্মের সময় থেকেই বাবারা আছেন, কারণ এখন সন্তান জন্মদানের সময় লেবার রুমেই পিতার উপস্থিতি প্রত্যাশিত। বরং পুরুষ কর্মীরা এই ছুটি নিলে তাঁদের চাকরির খতিয়ানে তা বিশেষ অবদান বলে উল্লেখিত থাকবে, যা তাঁদের পদোন্নতি বা অন্যান্য সুবিধার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেবে এ ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আমাদের ছেলেরাও বড় হয়ে বাবার মতন শিশু পালনকে তার নিজের কাজ বলে মনে করবে। |