|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
ঘুণ ঐতিহ্যেই, দল বদলে তা দূর করা যাবে না |
ছাত্র-রাজনীতির সংস্কার করতে চাইলে প্রথমে বদলানো দরকার ‘রাজনীতি’র মানসিকতা, যে রাজনীতি
গড়ে তুলেছে বর্তমান ছাত্র রাজনীতির অবয়ব। হিংসা আর প্রতিহিংসার বলয় থেকে মুক্তির পথ খুঁজেছেন
শিবাজীপ্রতিম বসু |
আট নম্বর ঘরের সেই রোগা ছেলেটার করুণ আর্তি এখনও কানে বাজে: স্যর একটু দেখুন, যত বার ভোট দিতে যাচ্ছি, তত বার ওরা পর্দা তুলে দেখছে! ‘পর্দা’ বলতে ডেকরেটারের জ্যালজেলে সাদা কাপড়, যা আড়াআড়ি টাঙানো একটা দড়ি থেকে ঝুলছে তার পেছনে টেবিল, ভোট দেওয়ার জায়গা। ওই আবডালের বাইরে থেকেও কিছুটা বোঝা যায় লম্বা কাগজটার কোন দিকে কে ভোট দিচ্ছে। তবু তাতেও শান্তি নেই। পর্দা তুলে কেউ কেউ ঢুকে পড়ছে ভেতরে, ‘ঠিকমত’ জায়গায় ভোট দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছে, নতুবা কলেজ
থেকে বেরোলে ‘দেখে নেওয়ার’ শাসানিও দেওয়া হচ্ছে।
বছর দশেক আগেকার চিত্র। নব্বই শতাংশেরও বেশি আসনে ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ জিতে তৎকালীন প্রধান শাসক দলের ছাত্র শাখা ইউনিয়ন ফের দখল করতে চলেছে। কিছু দুর্মতি, বিরোধী দলের ছাত্ররা কয়েকটি আসনে প্রার্থিপদ দিয়েছে: বহু চোখরাঙানিতেও তারা ‘প্রত্যাহার’ করেনি, বা ‘প্রশাসনিক কারণে’ তাদের ফর্ম ‘বাতিল’ করা যায়নি। সেই কয়েকটি আসনেই ভোট হচ্ছে। যে ছেলেটি ভোট দিতে পারছে না এবং যারা তাকে বাধা দিচ্ছে, তারা সবাই আমার ছাত্র। ফলে, আমি বিজয়ী পক্ষকে বোঝাতে থাকি: তোমরা তো ইতিমধ্যেই জিতে গিয়েছ, একটা ভোট বিপক্ষে গেলে ক্ষতি কী? বরং তোমরা যে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করো, এটাই প্রমাণিত হবে। সে দিন না-জানি কেন ‘ওরা’ আমার কথা মেনে নিয়েছিল। ফলে, ছেলেটি ভোট দিতে পারে। কয়েক দিন আগে পড়া ছাত্র-নির্বাচনের ওপর লেখা নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর রচনাটি সেই পুরনো স্মৃতি উসকে দিল।
পশ্চিমবঙ্গের কলেজে কলেজে বেশ কিছু দিন ধরে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অধ্যক্ষ নিগ্রহ, ভাঙচুরের অভিঘাত বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যম বাহিত হয়ে যে ভাবে আমাদের ত্রস্ত করে চলেছে, তার সঙ্গে সে দিনের ‘নিঃশব্দ’ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কলেজের পর কলেজ, এমনকী বিশ্ববিদ্যালয় ‘দখল’ করার ঐতিহ্য স্মরণ করলে মনে হবে আইনি খোলস বজায় রেখে চোরা সন্ত্রাসের আবহে পূর্বতন শাসক ছাত্রদল যে ভাবে কেল্লা ফতে করেছে, তার তুলনায় আজকের ‘ভৈরববাহিনী’ শিশু, নেহাতই শিশু! তখন শিক্ষা ক্ষেত্রে ‘অনিলায়নের’ তুঙ্গ মুহূর্ত। কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র প্রশাসনিক মুখ্য পদে ‘আমাদের লোক’ বসানোর পালা চলেছে। ফলে, কলেজে ছাত্র-ভোটার তালিকা প্রস্তুতির সময় থেকেই চলে প্রশাসনিক কায়দায় ছাত্র ইউনিয়নকে নিজেদের কব্জায় রাখার
মসৃণ প্রস্তুতি।
নানা কারণ দর্শিয়ে (বেশির ভাগ সময়েই বার্ষিক ‘ফি’ জমা না দেওয়ার কারণে, অথবা নামের বানান ভুল লেখার জন্য) প্রতিপক্ষ ছাত্রদের নাম যথাসম্ভব বাদ দিয়ে ভোটার তালিকা তৈরি হত। তার পর প্রার্থীদের ফর্ম বাছাইয়ের সময়ও নানান ‘টেকনিক্যাল’ কারণে নাম বাতিল হত। এর সঙ্গেই চলত অদৃশ্য সন্ত্রাসের কনসার্ট। কলেজে-ক্লাসে-ক্যান্টিনে হালকা ‘থ্রেট’, বাড়িতে ফোন, বা পার্টির লোকাল দাদাদের দিয়ে ‘চমকানো’।
অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী, বিশেষত মেয়েরা এতেই কাত। চিন্তিত অভিভাবকরাও এত সবে ঘাবড়ে গিয়ে বাড়ির মেয়েকে কলেজের ‘ফালতু’ ভোটের ঝামেলায় জড়াতে দিতেন না। ফলে, মেশিনের মসৃণতায় ‘গণতান্ত্রিক’ পদ্ধতিতেই বছর বছর ভোট আসত যেত, তাতে ক্ষমতাসীন পক্ষের হেলদোল হত না এবং কোনও দৃশ্যময়তা না থাকায় তা সংবাদমাধ্যমেও খুব একটা গুরুত্ব পেত না। |
|
তবু তার মধ্যে কোথাও কোথাও চিত্রনাট্যে গোল বাধত। নানা হিসেব উল্টে বিরোধী পক্ষই হয়তো জিতে গেল, বা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ শাসক পক্ষের হুকুম-তামিল করতে চাইলেন না। তার ফল হত মারাত্মক। তখন মারধর, ভাঙচুর, অধ্যক্ষ ঘেরাও ও হেনস্থা সবই চলত অকথ্য পর্যায়ে। আমাদের পাশের কলেজের এক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তো বিরোধী পক্ষের জয়ের ফলাফল পরিবর্তন ঘটাতে রাজি না হওয়ায়, সারা রাত ঘেরাও থেকে, চরম নিগ্রহ সহ্য করে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। তবে স্বীকার করতেই হবে, এই ঘটনা আকছার ঘটত না বেশির ভাগ সময়েই ঠুঁটো প্রশাসন আত্মসমর্পণ করত। ফলে, অলিলায়িত শিক্ষাযন্ত্র চলত গড়গড়িয়ে।
সমস্যা এই যে, নতুন শাসক পক্ষের ছাত্রদের কাছে এমন এক মসৃণ যন্ত্র নেই। সঙ্গে নেই বামপন্থী দলের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণ। একটি সংগঠনের মধ্যেই এদের প্রচুর উপদল এবং তার চেয়েও বেশি স্বঘোষিতা নেতা। অনেকেই গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল। ফলে, সর্বোচ্চ নেতৃত্বের নির্দেশের তোয়াক্কা না করে চলছে নৈরাজ্য, যাকে সম্পূর্ণ ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা বর্তমান প্রশাসনের এই মুহূর্তে নেই। ফলে, বহু ক্ষেত্রেই আগে যা চোখেও পড়ত না, সে সব ঘটনা সহসা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
তবে, আরও গভীর অনুসন্ধান করলে বোঝা যাবে সমস্যাটা ‘সাংস্কৃতিক’। বিগত সাড়ে তিন দশকে, সদ্য প্রাক্তন শাসক দল এই রাজ্যে যে শাসন-সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে, মূল কথা হল: যে যখন শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে, সে সমাজের সমস্ত পরিসর ও প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের অধিকারী হবে।
কয়েক মাস আগে যখন দীর্ঘ তিন যুগের শাসনের অবসান ঘটে সরকার ‘পরিবর্তন’ সূচিত হল, তখন অনেকে আশা করেছিলেন, বোধ হয় এ বার সামাজিক ক্ষেত্রগুলি, বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি দলীয় প্রভাব মুক্ত হয়ে স্বাধীন বিকাশের কেন্দ্র হয়ে উঠবে। কিন্তু কেউ কেউ আমার মতো সন্দেহী, আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিল যেহেতু এই ব্যাধি সাংস্কৃতিক, তাই তা এত সহজে ঘুচে যাওয়ার নয়। অর্থাৎ, সরকারের পরিবর্তন হলেও, শাসক দলের ছাত্রপক্ষের দখলদারির মানসিকতা এত সহজে চলে যাবে না। তার কারণ এই যে, দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক অভ্যাসে তারা এতে কোনও গর্হিত অন্যায় দেখবে না। ফলে, তারাও শাসনক্ষমতা দখলের দম্ভে তড়িঘড়ি কলেজ-ক্ষমতা দখল করতে চাইবে। অথচ, এই কাজ সুচারু ভাবে করার জন্য যে মসৃণ মেশিনের প্রয়োজন, তা তাদের হাতে নেই। তার ফলে যত বিপত্তি।
সুতরাং, সত্যিই যদি ‘তুলনা’ করতে হয়, তবে বর্তমান শাসক পক্ষ (আজ যাঁরা শিক্ষা ক্ষেত্রে ‘গেল’ ’গেল’ রব তুলেছেন, তাঁদের) বলতেই পারেন: ‘তুমি মহারাজ, সাধু হলে আজ/ আমি আজ চোর বটে’। কিন্তু বিষয়টা নিছক তুলনার হতে পারে না। সব ক্ষেত্রেই যদি তুলনা এবং প্রতিতুলনা চলতে থাকে, তবে কীসের পরিবর্তন?
তুলনা অনেক সময়েই হাস্যকর সংখ্যাতাত্ত্বিক কচকচানিতে পর্যবসিত হয়। যেমন, কয়েক বছর আগের শাসক দলের একটি বহুল লিখিত দেওয়াল প্রচারের বুলি: খুন: পশ্চিমবঙ্গে (...), বিহারে (...); ধর্ষণ: পশ্চিমবঙ্গে (...), বিহারে (...)। এর দ্বারা কী মহৎ প্রমাণ হত? হয়তো সংখ্যার বিচারে বিহারে অপরাধপ্রবণতা বেশি, এ কথা বোঝা যেত। কিন্তু তার ফলে কি পশ্চিমবঙ্গে ঘটা অপরাধের ভার লাঘব হত?
সংখ্যাতাত্ত্বিক তুলনাটা কোনও বিবেচনার কাজ নয়। আসল সমস্যাটা নৈতিক। আগের পক্ষের ছাত্ররা যত অনৈতিক ভাবে, প্রশাসন ও ত্রাসের যুগল প্রয়োগে কলেজের ক্ষমতা দখল করে থাকুন না কেন, তা বর্তমান পক্ষের যেন-তেন-প্রকারেণ ক্ষমতাদখলে যুক্তি সিদ্ধ করে না। তবে আবার বলি, যেহেতু ব্যাধিটা মুখ্যত সাংস্কৃতিক বহু অভ্যাসে মজ্জায় ঢুকে পড়েছে অল্প কিছু সময়ে তা থেকে মুক্ত হওয়াটা প্রায় অসম্ভব। তার জন্য প্রয়োজন প্রতি দিনের সদাজাগ্রত প্রচেষ্টা এবং শাসক দলের সর্বোচ্চ মহলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। কোনও অপরাধ লঘু করে না দেখে, দরকার আইনের শাসনকে নিজের পথে চলতে দেওয়া।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও পুরনো কর্তাভজা মানসিকতা থেকে বার হতে হবে। সব চেয়ে প্রয়োজন, কোনও ভাবেই ছাত্র রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে নিজেদের জড়িয়ে না ফেলা। জানি, এই সব অশান্তির মেঘ দৃশ্যমান থাকবে। কিন্তু কেবল প্রতিতুলনায় সমস্যাটা ঘুচবে না। সমস্যাটা নৈতিক। ‘তুমি অধম তা বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন?’
|
শ্রীচৈতন্য কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক |
|
|
|
|
|