মানবাধিকার ভঙ্গের অভিযোগ অজস্র। মানবাধিকার কমিশনে পর্বতপ্রমাণ স্তূপ রচিত হইয়াছে। সমস্যা নিরসনের জন্য নির্দেশ ছিল, জেলায় জেলায় মানবাধিকার আদালত গড়িতে হইবে। দীর্ঘ টালবাহানার পরে তাহা গড়াও হইল। নূতন সরকার ক্ষমতায় আসিয়া উদ্যোগ গ্রহণ করিলেন। খটকা একটিই। লোকে জানিতে পারিল না। এমন একটি উদ্যোগ যে সরকারি স্তরে গৃহীত হইয়াছে, অভিযোগ করিবার জন্য কলিকাতায় ছুটিয়া আসিতে হইবে না, যে যাহার জেলাতেই অভিযোগ দায়ের করিতে পারিবেন, সেই জরুরি তথ্যটি বৃহত্তর জনমণ্ডলীর অবগতির আড়ালেই রহিয়া গেল। সুতরাং, আদালত আদালতের মতো থাকিয়া গেল, জনতা জনতার ন্যায়। চার মাস হইয়া গেল, রাজ্যের উনিশটি জেলাতেই মানবাধিকার আদালত গড়া হইয়াছে। দায়ের করা মামলার সংখ্যা মাত্রই এক। এই ঘটনাই প্রমাণ করে, সুশাসনের ক্ষেত্রে তথ্যের যথাযথ সঞ্চারের গুরুত্ব কী বিপুল! বিশেষ করিয়া গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে তাহা আরও তাৎপর্যবাহী। কারণ গণতন্ত্র জনতার মঙ্গলের জন্য উৎসর্গীকৃত। এমন কাণ্ড অনেক সময়ই হইয়া থাকে যে, সেই মর্মে বিভিন্ন বন্দোবস্ত গৃহীত হইল, অথচ সেই সংবাদগুলি জনস্তরে যথাযোগ্য রূপে পৌঁছাইতে পারিল না। ফলে, শুধুই তথ্যগুলি জানা ছিল না বলিয়া অজস্র মানুষ সেই সব বন্দোবস্তের সুবিধাগুলি লইতে পারিলেন না। অথচ, এই সব তথ্য জানিতে পারিবার পূর্ণ অধিকার তাহাদের আছে। এই রূপে, গণতন্ত্রের মৌলিক উদ্দেশ্যটিই ব্যাহত হইল।
মানবাধিকার আদালতের এই দৃষ্টান্ত হইতে একটি শিক্ষাগ্রহণ জরুরি। শুধু জনতার হিতার্থে উদ্যোগ গ্রহণ করিলেই চলিবে না, তাহার খবর, তাহার সুফল ইত্যাদি তথ্য জনতার নিকট পৌঁছাইয়া দিতে হইবে। তথ্য সম্প্রচার জনহিত সাধনেরই একটি পন্থা। এই সংকট অবশ্য নূতন নহে। পূর্বেও এমন কাণ্ড দেখা গিয়াছে। গ্রামবাসীর জন্য নানা প্রকল্পের খবর গ্রামবাসীরা জানিতেই পারেন নাই। প্রকল্পের অর্থ আসিয়া দীর্ঘকাল নিষ্কর্মা পড়িয়া থাকিবার পরে এক সময় ফিরিয়াও গিয়াছে। ইহা সংকটের একটি দিক। অন্য দিকটিও একই রকম ভয়ঙ্কর। প্রকল্প চালু হইয়াছে, লোকে সংবাদও পাইল, কিন্তু কিছু লোক পাইল। সকলে পাইল না। পশ্চিমবঙ্গে গত কিছু দশকের অভিজ্ঞতায় এমন অপকর্ম বিরল নহে। দলতন্ত্রের অভিশাপ সুশাসনের ভিতরেও ভাগাভাগির বিষ ছড়াইয়াছে। তথ্যের সঞ্চারকে এই সকল সমস্যা হইতে মুক্ত করা জরুরি। সমস্যা হইল, গণতন্ত্রকে শুধুই ‘জনতার জন্য’ হিসাবে ভাবিলে চলিবে না, গণতন্ত্রের ধ্রুপদী মার্কিন সংজ্ঞায় সফল গণতন্ত্রের অন্যতম একটি চিহ্ন ইহাই যে তাহা ‘জনতার দ্বারা’-ও বটে। সেই বিষয়টি কত দূর মান্য করা হয়, তাহা লইয়া সন্দেহ থাকিয়াই যায়। প্রকৃত গণতন্ত্র জনতার পূর্ণ অংশগ্রহণ ব্যতীত অগ্রসর হইতে পারে না। প্রশাসন ‘জনতার জন্য’ নানাবিধ কাজকর্ম করিল বটে, কিন্তু তাহা ‘জনতার দ্বারা’ হইয়া উঠিল না, তাহাতে বিশেষ লাভ নাই। এই জন্যই লাভ নাই যে ইহার মাধ্যমে জনতা এবং প্রশাসনের ভিতর সেতুবন্ধটি ঘটিল না। এক ধরনের কৌলীন্য প্রথা প্রশাসনকে আচ্ছন্ন রাখিল। এই সেতুবন্ধন ছাড়া গণতন্ত্রের সাফল্য দূর অস্ত্। মানবাধিকার আদালতের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া একটি জরুরি প্রশ্ন উঠিয়া আসিয়াছে। অবিলম্বে তাহার উত্তর সন্ধান করা বাঞ্ছনীয়। বস্তুত, অত্যাবশ্যক। |