ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বয়স শতাব্দী অভিমুখে অগ্রসর হইতেছে, কিন্তু এখনও তাহা যথার্থ ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি হইয়া উঠিতে পারিল না। জন্মলগ্ন হইতেই এই দলের তাত্ত্বিকরা সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি নির্নিমেষ চাহিয়া থাকিতেন, মস্কো যাহা বলিত তাহাই পালন করিতেন, সেই কারণেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ রাতারাতি জনযুদ্ধে পরিণত হইয়াছিল, দেশের স্বাধীনতা ‘ঝুটা আজাদি’ বলিয়া সাব্যস্ত হইয়াছিল। ১৯৪৯ সালে চিনে কমিউনিস্ট পার্টির শাসন প্রতিষ্ঠিত হইবার পরে ভারতের কমিউনিস্টদের আত্মিক সমস্যাবলিতে এক নূতন মাত্রা সংযুক্ত হয়, বেজিং এবং মস্কোর পারস্পরিক দূরত্ব, মতানৈক্য ও বিরোধ যত বাড়িতে থাকে, এ দেশের পার্টিও ততই অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগিতে থাকে। অন্তর্দ্বন্দ্ব, কিন্তু তাহা অন্তরের দ্বন্দ্ব নহে, বাহির হইতে চালিত। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্তরটিই বাহিরের দ্বারা চালিত ছিল। বিশেষত, চিন সম্পর্কে কী অবস্থান লওয়া হইবে, তাহা উত্তরোত্তর এই দলের চিন্তাভাবনায় দীর্ঘ হইতে দীর্ঘতর ছায়া ফেলিতে শুরু করে। এক সময় সেই ছায়া এমন প্রবল আকার ধারণ করে যে তজ্জনিত অন্তর্দ্বন্দ্ব শেষ অবধি পার্টির বিভাজনের একটি বড় কারণ হইয়া দাঁড়ায়। গাঁধীজির মতাদর্শ বা নেহরুর নীতি সম্পর্কে মতানৈক্যের কারণে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি আলোড়িত এবং বিভাজিত হইলে এক রকম বোঝা যাইত, কিন্তু কে চিনের পক্ষে, কে তাহার বিপক্ষে, কিংবা চিনের রাষ্ট্র চরিত্রে কতটা কমিউনিস্ট তাহা লইয়া বিতর্কের তাড়নায় ভারতের পার্টি ভাগ হইয়া গেল বিচিত্র বইকী।
সেই ধারা সমানে চলিতেছে। ভাবী পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতিপর্বে সি পি আই এম-এর অভ্যন্তরে একটি বিতর্ক হইয়াছে। চিনের পার্টিকে এখন কমিউনিস্ট বা সমাজতন্ত্রীর বলা যাইবে কি না, বিতর্ক সেই বিষয়েই। যাঁহারা এই প্রশ্নের সদর্থক উত্তর দিয়াছেন, তাঁহারা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী হইয়াছেন। অর্থাৎ সি পি আই এম-এর সিদ্ধান্ত: চিন এখনও কমিউনিস্ট পার্টি শাসিত দেশ। এই প্রশ্নটির পরিপ্রেক্ষিত বুঝিতে কোনও অসুবিধা নাই। চিনের কমিউনিস্ট পার্টি দুই দশকের বেশি সময় ধরিয়া দেশের আর্থিক নীতিতে মৌলিক সংস্কার ঘটাইয়াছে, বাজারের শাসন এবং বিশ্বায়নকে দুই হাত বাড়াইয়া স্বীকার করিয়াছে। তাহার ‘সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’ চরিত্রে ও আচরণে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি হইতে কোনও ভাবেই আলাদা করা কঠিন। সম্পত্তির রাষ্ট্রীয় মালিকানা এখনও বহুলাংশে বহাল বটে, কিন্তু তাহাতে দেশের অর্থনীতির গতি এবং প্রকৃতির সংস্কার আটকায় নাই। স্বভাবতই, চিনের পার্টিকে এখনও কমিউনিস্ট বলা যায় কি না, তাহা এক কূটপ্রশ্ন।
কিন্তু সেই প্রশ্ন লইয়া সি পি আই এম ব্যতিব্যস্ত হইবে কেন? বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক নীতিতে যে পরিবর্তন আনিয়াছিলেন, তাহার ‘সমাজতান্ত্রিকতা’ লইয়াও তো বিস্তর তর্ক হইতে পারে, হইয়াছেও, কিন্তু চিনের কমিউনিস্ট পার্টি সেই তর্কে প্রবৃত্ত হইয়াছে বলিয়া তো শোনা যায় নাই। সোভিয়েত ইউনিয়ন অথবা চিন বা কিউবা কিংবা ভিয়েতনাম লইয়া এমন নিরন্তর আলোড়নের ফলে সি পি আই এম-এর কোন আত্মোন্নতি হইয়াছে, তাহা দলই জানে, কিন্তু অনুক্ষণ ‘চিনের চিন্তা আমাদের চিন্তা’ জপ করিতে গিয়া এই দলটির ভারতবোধ যে নিতান্ত অপূর্ণ থাকিয়া গিয়াছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। জাতপাত, ধর্ম, আঞ্চলিকতা ইত্যাদি ‘দেশজ’ বিষয়গুলিকে আপন রাজনৈতিক চিন্তায় ও পদ্ধতিতে গ্রথিত করিতে পারে নাই এই দল, এই অক্ষমতাই সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তাহার প্রান্তিকতার একটি বড় কারণ। এক দিকে কেতাবি বামপন্থার আনুগত্য, অন্য দিকে বিদেশি বামপন্থীদের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া দুইয়ে মিলিয়া ভারতের কমিউনিস্টদের আজও ভারতীয় হইতে দেয় নাই। আজও তাঁহারা চিনের কমিউনিস্ট পার্টির সমাজতান্ত্রিকতা মাপিতেছেন। |