সত্যিই পরের তিনটে রবিবার কোনও অসুবিধে হল না। দূরে চৌরাস্তার মোড়ে মেয়েটার আবছা চেহারা ক্রমে বড় হতে হতে চোখের তিন হাত সামনে দিয়ে চলে গেল। খানিক পরে পিছনে পিছনে রতনও রওনা হল। হাসপাতাল কম্পাউন্ডের কিছুটা দূরে থমকে দাঁড়িয়ে মেয়েটার অদৃশ্য হয়ে যাওয়া দেখল। কিন্তু চতুর্থ রবিবার রতনের নিজের মনেই কেমন একটা অস্বস্তি তৈরি হল। মনে হল এই যে দূর থেকে হেঁটে আসা মেয়েটার দিকে সে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, মেয়েটার চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখটাও ঘুরে যায়, এটা হয়তো কেউ না কেউ লক্ষ করছে। উল্টো ফুটে পরপর তিনটে দোকান। দোকানের ছেলেগুলো খেয়াল করতেই পারে।
কালক্রমে মেয়েটার নামও রতনের জানা হয়ে গেল। অবশ্য না জানলেও তার অবস্থার কিছু হেরফের হত না। সে শুধু সপ্তাহে এক দিন বিকেলের আলোয় মেয়েটাকে সামনে থেকে আর পিছন থেকে অনেকক্ষণ ধরে দেখে। এই সময়টুকু তার বড় ফুরফুরে লাগে। সব কিছু সুন্দর মনে হয়। কেন এমনটা হয়, রতন ভেবেছে। ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেনি। তার মনে হয়েছে, এই রিকশা-অটো-মোটরবাইক আর অগণিত পথচারীর ভিড়ের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়াটার মতো ওই মেয়েটার সারা শরীরে একটা ভাল লাগা মাখানো আছে।
গত রবিবার সামনে দিয়ে চলে যেতে যেতে মেয়েটা হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে তার দিকে তাকিয়েছিল। সত্যিই তার দিকে তাকিয়েছিল? সংশয়ী মনটাকে এক থাপ্পড় কষিয়ে রতন বলে, আলবাত তাকিয়েছিল। কেন তাকিয়েছিল? মেয়েটা কি জানে ওকে দেখার জন্যই রতন এখানে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর পিছু পিছু যায়। কেমন করে জানবে? ও তো মুখ নিচু করে হাঁটে, কখনও পিছন ফিরে তাকায়নি। শুধু গত রবিবার...
এখন চৈত্র মাসের শেষ দিক। সাড়ে পাঁচটায় অনেক আলো, গাছের মাথায় মাথায় অনেক রোদ। কৃষ্ণচূড়ার ডালপালাগুলো রং আর রোদ মিশিয়ে তুমুল হইচই উৎসবে মেতে আছে।
আর ঠিক তখনই পথ চলতি জনতার ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে রতনের সামনে দাঁড়িয়ে হারাধন জিজ্ঞেস করল, বাবু বড় ডাকঘরটা কোন দিকে?
ঘড়ির হৃদয়ের খবর নেওয়া হল না রতনের। প্রশ্নটা সে স্পষ্টই শুনতে পেয়েছিল। এবং কেউ তার সঙ্গে ফচকেমি করছে ভেবে খিঁচিয়ে উঠতে গিয়ে সামনে এক জন অপরিচিত মানুষকে দেখে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তার মানে?
না, মানে...। লোকটা খানিক থতমত খেয়ে বিনীত সুরে বলল, ওই বড় ডাকঘরটা কুনদিকে সিটাই জানতে চাইছিলাম। সেই বাসিস্ট্যান থেকি হাঁটতে হাঁটতে আসছি। কত লোককে জিগালাম। কেহ বলে সিধা যাও, খানেক পরে কেহ বলে ডাহিনে যাও আবার খানিক পরে কেহ বলে বাঁয়ে যাও।
হারাধনের কথা শুনতে শুনতে রোদচশমাটা খুলে রতন ওকে জরিপ করছিল। স্পষ্টতই গ্রামের লোক। হাঁটুর কিছুটা নীচে নামানো ধুতি, হাফ হাতা আকাশি শার্ট, হাওয়াই চপ্পল, মাথার অল্প পরিমাণ চুল তেল জবজবে, মুখে অন্তত এক সপ্তাহের না কামানো দাড়ি।
লোকটা তার চেয়ে বয়সে অনেকটাই বড়। তবু রতনের মনে হল বেকার হলেও সে গ্র্যাজুয়েট তো বটে, শহরেও বাস করে। সুতরাং লোকটাকে আপনি বলার কোনও দরকার নেই। তাই বুড়ো আঙুলে নিজের পিছন দিকটা নির্দেশ করে বলল, পড়তে পারো? কৃষ্ণচূড়া গুঁড়িটার আড়াল ছিল। সামান্য ডান দিকে দু’পা সরে গিয়ে লালের ওপরে সাদা রং দিয়ে লেখা সাইনবোর্ডটার দিকে একটু তাকিয়ে একগাল হেসে হারাধন বলল, এতক্ষণে খুঁজি পেলাম।
ওর খুশি খুশি মুখের দিকে তাকিয়ে রতন বলল, খুঁজি পেলে কী হবে, আজ রবিবার ডাকঘর বন্ধ। রতনের কথার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া হল না। হারাধন তেমনি খুশি খুশি মুখেই বলল, সে খুলাই থাক আর বন্ধই থাক, ডাকঘরে আমার কী কাম!
তা হলে ডাকঘর খুঁজছিলে কেন? রতন সত্যিই অবাক হল।
হারাধন মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ডাকঘর খুঁজি নাই বাবু। শুনলাম ডাকঘরের উল্টা দিকে মন্ত্রীর বাড়ি, সিটা কুথায়?
রতন মনে মনে বিরক্ত হল। ভাবল, আচ্ছা উজবুক তো! সরাসরি মন্ত্রীর বাড়ি জানতে চাইলেই হত। মনের বিরক্তি চেপে আঙুল তুলে খানিকটা বাঁয়ে রাস্তার ওপারের একটা বাড়ি দেখিয়ে বলল, ওই যে সাদা দোতলা বাড়িটা।
হারাধন সামান্য সময় বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থেকে মুখ ফিরিয়ে হতাশ গলায় বলল, এই রকম মন্ত্রীর বাড়ি! আমি চাঁচোলের রাজবাড়ি, কাশিমবাজারের রাজবাড়ি, কোচবিহারের রাজার বাড়ি দেখিছি। রাজার বাড়ি ওই রকম আর মন্ত্রীর বাড়ি এই রকম! রতনের এ বার মজা লাগল। বলল, এখনকার পাবলিক খুব হিংসুটে। তাই মন্ত্রীরা ভাল ভাল বাড়িগুলো নিজের দেশে বানায় না।
— সেটা কী রকম? সিরিয়াস মুখে হারাধন জানতে চাইল। রতন সহজ করে, উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা ওকে বোঝাল। বলল, এই যে সাধারণ বাড়িটায় মন্ত্রী থাকে এটা পাবলিককে দেখাবার জন্য। দিল্লি, ভুবনেশ্বর আর দেরাদুনে মন্ত্রীর যে তিনখানা বাড়ি আছে সেগুলো মনে করো তোমার ওই রাজবাড়ির ছোট ভাই। তা যাকগে সে সব কথা, মন্ত্রীর বাড়িতে তোমার কী দরকার?
আগের মতোই মাথা নাড়তে নাড়তে হারাধন বলল, মন্ত্রীর বাড়িতে আমার কুনো দরকার নাই। শুনলাম মন্ত্রীর বাড়ির বাঁ হাতে যে রাস্তাখানা সিটা ধরি খানিকটা আগুলেই বিশাল বড় একখানা পাকুড় গাছ। সেই গাছে এত বকপাখি থাকে যে, দুনিয়ার আর কোনও গাছে অত বকপাখি থাকে না। এইটা কি ঠিক কথা? মানে, ওই রাস্তায় পাকুড় গাছ আছে?
এ বার রতনের একটু ধন্দ লাগল। লোকটা আসলে কী জানতে চাইছে, সেটা ঠিকঠাক বোঝার জন্য ভুরু কুঁচকে কুটিল চোখে সতর্ক ভাবে বলল, হ্যাঁ, পাকুড় গাছ আছে। সেখানে অনেক বকও আছে। কিন্তু এখন গেলে সবাইকে পাবে না। সবাই এখন বাসায় ফেরেনি। হারাধন হাসিমুখে বলল, কী যে বলেন বাবু, আমার কি এখুন বকপাখি দেখবার বয়স! পাকুড় গাছে আমার কাম নাই। শুনলাম, পাকুড় গাছখানা বাঁ হাতে রাখি খানিক আগুলেই ডাহিন হাতে কানা খুদুর গলি।
এ বার রতন প্রচণ্ড খেপে গিয়ে মনে মনে বলল, হারামজাদা! প্রকাশ্যে ঝাঁঝালো গলায় ব্যঙ্গ মিশিয়ে বলে উঠল, তাই বলো, তুমি কানা খুদুর গলি খুঁজতে বেরিয়েছ! তা এতক্ষণ ওই সব ডাকঘর, মন্ত্রী বাড়ি ধানাইপানাই করছিলে কেন? সরাসরি ওই গলির কথা বলতে লজ্জা হচ্ছিল?
রতনের রাগটা হারাধন বুঝতে পারল, কিন্তু কারণটা তেমন স্পষ্ট হল না তার কাছে। তাই থতমত খেয়ে আমতা আমতা করে বলল, না, মানে, সিদ্ধাইয়ের ব্যাপার তো, সব কিছু ঠিকঠাক মিইলে না নিলে কুনো কাম হবে না।
রতন গাঢ় সন্দেহে হারাধনের চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, সিদ্ধাই মানে?
পড়া না পারা ছাত্রের মতো মুখ করে খানিকটা ভেবে নিয়ে হারাধন বলল, সিদ্ধাইয়ের কুনো মানে নাই। সিদ্ধাই মানে সিদ্ধাই। মনে করেন, নিজির লোক অনেক দূরে আছে, কুনো খপর নাই, আপনের সিদ্ধাই থাকলি মনে নিলেই সেই লোককে দেখতি পাবেন, কেমুন আছে জানতি পারবেন। আবার মনে করেন, মাঠে বাহ্যে গিয়ে আপনের মনে হল, এখুন গোলাপ ফুলের খুশবু হোক। আপনের সিদ্ধাই থাকলি চারিভিতে তখুন খালি গোলাপের বাস। এই রকম আটখান সিদ্ধাই আছে।
হারাধনের কথা শেষ হওয়ার আগেই রতন ধমকে উঠল, থামো, ওগুলো সবাই জানে, অষ্টসিদ্ধি। কিন্তু তার সঙ্গে কানা খুদুর গলির কী যোগাযোগ?
যদিও ওদের কথা শোনার জন্য ধারেপাশে কেউ আড়ি পেতে নেই, তবু চার পাশটা এক বার দ্রুত চোখে দেখে নিয়ে গলার স্বর নামিয়ে হারাধন বলল, ইসব কথা কারেও বলতি নাই। কিন্তু আপনি লোক ভাল, অনেক উপকার করলেন, আপনেরে সব খুলেই বলি। এ দিক ও দিক একটু তাকিয়ে পোস্ট অফিসের চওড়া সিঁড়ির দিকে নির্দেশ করে হারাধন বলল, চলেন না বাবু, ওই ধাপিটায় খানিক বসি। হাত দিয়ে ধুলো ঝেড়ে সিঁড়িতে বসে হারাধন তার শার্টের ঝুল পকেট থেকে বিড়ির প্যাকেট আর দেশলাই বের করতেই রতন হাত বাড়াল। কৃতার্থ মুখে নিবেদনের ভঙ্গিতে ওর হাতে একটা বিড়ি দিয়ে হারাধন দেশলাই জ্বালাল। পর পর দুটো টান দিতেই রতন তার নিজের লোক হয়ে গেল। এ দিকে রতনের খিঁচড়ে যাওয়া মেজাজটাও খানিক শান্ত হয়ে কৌতূহলকে আসবার পথ করে দিল। জিজ্ঞেস করল, তোমার বাড়ি কোথায়?
— ডিহরচক।
— সেটা আবার কোথায়?
— এজ্ঞে বাবু, লালবাথানি বাসিস্ট্যান থেকি তিন মাইল পচছিমে।
লালবাথানি কোথায় সেটাও রতনের জানা নেই। তবে সেটা যে মুল্লুকেই হোক জানার দরকার নেই ভেবে রতন বলল, এ বার কী সব সিদ্ধাইয়ের কথা বলছিলে, খুলে বলো। তার আগে তোমার নামটা বলো।
— এজ্ঞে হারাধন মণ্ডল।
এর পর হারাধন রতনকে যে গল্পটা বিস্তারিত শোনাল, সেটা সংক্ষেপে এই রকম। ডিহরচক গ্রামে ঢুকবার মুখেই বিশাল এক প্রাচীন নিমগাছ। দিন দশেক আগে সেই গাছের তলায় এক সাধুবাবা আশ্রয় নিয়েছেন। হারাধন নিজে দিনমজুর। আজ কাজ জোটে তো কাল নেই। আজ ভাত জোটে তো কাল উপোস। সাধুবাবাকে প্রথম দিন গড় হয়ে প্রণাম করতে করতেই হারাধনের বুকের মধ্যে কে যেন বলে উঠল, এই সাধুবাবাই ইচ্ছে করলে তার দিন বদলে দিতে পারে। ফলে হারাধন প্রাণপণে এই হঠাৎ পাওয়া সুযোগটা আঁকড়ে ধরল। দিনরাত পড়ে রইল সাধুবাবার কাছে। শরীর দিয়ে যতটা সম্ভব সেবা করল। অবশেষে গত কাল সাধুবাবার কৃপা হয়েছে, হারাধনকে একটা সিদ্ধাই দিতে রাজি হয়েছেন। কথা থামিয়ে হারাধন আবার পকেটে হাত ঢোকাতেই রতন উজ্জ্বল চোখে জিজ্ঞেস করল, কী সিদ্ধাই? প্যাকেট থেকে দুটো বিড়ি বের করে একটা রতনের হাতে চালান করে হারাধন বলল, সাধুবাবার আটখান সিদ্ধাই আছে। তার থিকা সবচে ভালটা আমি চেহে নিলাম।
জ্বলন্ত দেশলাইয়ের কাঠির ওপরে মুখ নামিয়ে রতন তাড়াতাড়ি নিজের বিড়িটা ধরিয়ে নিয়ে ধোঁয়া ভরা গলাতেই জিজ্ঞেস করল, সেটা কী? ধীরেসুস্থে নিজের বিড়ি ধরিয়ে ফুঁ দিয়ে কাঠিটা নিভিয়ে এক বুক ধোঁয়া ভরে নিয়ে হারাধন বলল, কাম পাও আর নাই পাও, দু’বেলা ভরপেট ভাত গ্যারান্টি। প্রথমে হারাধনের কথায় রতনের তেমন চমক লাগল না। কিন্তু দ্বিতীয় বার নিজের মনে কথাটা ভাবতেই ভাত বাক্যটার অনুষঙ্গে তার মনে পড়ল আজ দুপুরে সে রাগ করে ভাত খায়নি।
অবশ্য রাগ না বলে সেটাকে অপমান বলাই ভাল। দাদা বউদি তো সেই তিন বছর আগে রতন বি এ পাশ করার পর থেকেই কথা শোনাচ্ছে। ইদানীং মা-ও খোঁটা দিতে শুরু করেছে। দাদার বক্তব্য, শুধু এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম লিখিয়ে বসে থাকলে শ্মশানের চিতায় উঠে কল লেটার পাবি। অন্য চেষ্টাও করতে হবে। অন্তত কয়েকটা টিউশানি তো খুঁজে নিতে পারিস।
ছাত্র পড়ানো! সর্বনাশ। কিন্তু দাদা অত সহজে ছাড়বার লোক নয়। ফুটপাথে নিজের সহব্যবসায়ীদের ধরাধরি করে তিনটে অপোগণ্ডকে অ আ ক খ শেখাবার জন্য রতনের জিম্মা করে দিয়েছে। সে যে কী যন্ত্রণা, প্রতিদিন দুটো ঘণ্টা। সাধারণত দাদার জন্য টিফিন কৌটোয় ভাত তরকারি নিয়ে বউদি বেরিয়ে যাওয়ার পরেই রতন বাড়িতে ঢোকে। মা ভাত বেড়ে দেয়। আজও তেমনটাই হচ্ছিল। কিন্তু ভাত বাড়তে বাড়তে মা হঠাৎ বিলাপ শুরু করল, আমারই পোড়া কপাল। ওই বাড়ির নান্টু, যে কিনা এক মাস আগে পাশ করল, সে-ও চাকরি পেয়ে গেল আর আমার ধম্মের ষাঁড়...
রতনের খুব খিদে পেয়েছিল তাই রাগটাও সীমা ছাড়িয়ে গেল। এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে পা দিয়ে জলের গেলাস উল্টে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে এল।
এখন হারাধনের মুখের ভরপেট ভাত গ্যারান্টি, শব্দগুলো সামান্য নাড়াচাড়া করতেই রতন বুঝতে পারল সিদ্ধাইটা এলেবেলে নয়, বেশ দামি, প্রচণ্ড দামি। তাই তাড়াতাড়ি সবটুকু শোনার জন্য সে অধৈর্য স্বরে জিজ্ঞেস করল, এর সঙ্গে কানা খুদুর গলির কী সম্পর্ক?
সম্পর্কটা হারাধন বুঝিয়ে বলল। সাধুবাবা বলেছেন, বড় ডাকঘরের উল্টো দিকে মন্ত্রীর বাড়ি, তার পরে পাকুড় গাছ, তার পরে কানা খুদুর গলি। ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় গলির এই মুখ দিয়ে ঢুকে ওই মুখ দিয়ে বেরোতে হবে। আবার ও দিক দিয়ে ঢুকে এ দিক দিয়ে ফিরে আসতে হবে। এমনটা এক বার করলেই হবে। জোরে হাঁটলে চলবে না। চার পাশটা খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে হাঁটতে হবে। পথে যদি কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে হাসিমুখে জবাব দিতে হবে। কেউ যদি খারাপ কথা বলে একটুও রাগ করা চলবে না। কেউ যদি কিছু চায়, সঙ্গে থাকলে দিতে হবে। আর সাধুবাবা কানে কানে যে মন্ত্রটা বলে দিয়েছেন সেটা সর্বক্ষণ জপ করতে হবে। এই সবটুকু ঠিকঠিক করতে পারলেই সিদ্ধাই।
|
কাজটা হারাধনের একটুও কঠিন মনে হয়নি। সাধুবাবা যে মন্ত্রটা দিয়েছেন, সেটা মাত্র চার অক্ষরের, ভুলবার কথাই নয়। আর শহরের গলিতে সন্ধ্যার সময় কে আর তাকে কী এমন জিজ্ঞেস করবে, কী-ই বা চাইবে! তাই সে রতনকে জিজ্ঞেস করল, বাবু গলিটা কি খুব বড়?
রতন মাথা নেড়ে বলল, আস্তে আস্তে হাঁটলে পনেরো মিনিট লাগবে।
তখনই হারাধনের সময়ের কথাটা মনে পড়ল। সচেতন ভাবে খেয়াল করল চার পাশটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। রতনের রিস্টওয়াচের দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইল, ক’টা বাজল বাবু?
রতনের প্রথমে মনে হল ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তবু রাস্তা থেকে ছিটকে আসা আলোয় তাকিয়ে দেখল সাতটা বাজতে দশ। সঙ্গে সঙ্গে বর্ণালীর কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল, কিন্তু থাকল না। একটা সুন্দরী রুপোলি মাছের মতো ভুস করে ভেসে উঠেই অতলে তলিয়ে গেল। সে ব্যগ্র স্বরে হারাধনকে বলল, এ বার তোমার রওনা হওয়া উচিত। আর শোনো, পনেরো পনেরো ত্রিশ মিনিট, বড় জোর চল্লিশ আমি এইখানে বসে থাকব। কী হল আমাকে জানিয়ে তবে যাবে। বেশি দেরি করবে না কিন্তু...। কথার মাঝেই একগাল হেসে হারাধন বলল, দেরি করলে আমার চলবেনি বাবু। লালবাথানির লাস্ট বাস সাড়ে আটটায়।
হারাধন চলে গেল। রতন মনে মনে কানা খুদুর গলিটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।
ঢোকার মুখেই ডান দিকে অন্নপূর্ণা পাইস হোটেল। ভাতের ফেন আর বাসি তরকারির ভ্যাপসা গন্ধ সব সময় ঘিরে থাকে হোটেলটাকে। বাঁ দিকে কানা খুদুর পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান। দোকানের পাটাতনের নীচে বাংলা আর রামের বোতল। এর ওপরে ওঠার মতো খদ্দের এ গলিতে আসে না। দু’পাশে গায়ে গায়ে ঘেঁষাঘেঁষি হতশ্রী কয়েকটা টালির বাড়ি। তার পরে খানিকটা ফাঁকা জমি। সেটা আগাছা ঝোপজঙ্গলের বসবাসের আর পথচারীদের মূত্রত্যাগের স্থান। এর পরেই বাঁ দিকে নিত্যগোপালের বড়ার দোকান। বড়া মানে খাসির চর্বির বড়া। দু’পাশের কাঁচা ড্রেন থেকে, ফাঁকা জমিটুকু থেকে আর নিত্যগোপালের কড়াইয়ে ফুটন্ত চর্বির বড়া থেকে উঠে আসা গন্ধের মিলনে অনেকটা জায়গা জুড়ে বিকেল থেকে শুরু হয় গন্ধের মহা মহোৎসব। তার পরে আবার কয়েকটা বাড়ি। বাড়ি না বলে ঘর বললেই ঠিকঠিক বলা হয়। ডান দিকের একটা ঘরের বারান্দায় উনুন জ্বালিয়ে পেঁয়াজি ভাজে চিন্তা মাসি। তার কাছে ছোলা টোপা আর বাংলা পাওয়া যায়। আবার সারি দেওয়া কয়েকটা ঘর পেরিয়ে সিমেন্ট বাঁধানো ছোট্ট একটা শনি মন্দির। সেখানে চৌপর দিন ভিড় থাকলেও সন্ধ্যায় ফাঁকা। উল্টো দিকে হুমদো কালীর পান-বিড়ির দোকান। ব্যবস্থা কানা খুদুর দোকানের মতোই। তবে এই দোকানে সারাক্ষণ জোরালো শব্দে হিন্দি গান বাজে। আবার কয়েকটা ঘর সব মিলিয়ে গলিটায় মোট পঁয়ত্রিশটা ঘর। কিন্তু সাড়ে ছ’টা বাজতে না বাজতেই নানা বয়সের, নানা পোশাকের, নানা প্রসাধনে আদিম প্রলোভনের পসরা সাজিয়ে অন্তত পঞ্চাশটা মেয়ে বেরিয়ে এসে পথে দাঁড়ায়। ছোট ছোট জটলা তৈরি হয় খুদুর, কালীর, চিন্তার, নিত্যগোপালের দোকানের সামনে। গানের শব্দ ছাপিয়ে ছররা গুলির মতো ছোট ছোট হাসির টুকরো ছিটকে পড়ে বাতাসে। বেল ফুলের মালা হেঁকে যায়। গলির বনেদি গন্ধ তাকে পাত্তা দেয় না।
গলির শেষ মাথায় দীনবন্ধু ডাক্তারের ওষুধের দোকান কাম চেম্বার। সেখানে চল্লিশ পাওয়ারের একটা বাল্ব ঝোলে। জরাজীর্ণ ধুলিমলিন কাচের আলমারিতে কী যে ওষুধ থাকে বোঝা যায় না। ঠিক তেমনি বোঝা যায় না দীনবন্ধুর দোকানের মাথায় টাঙানো সাইনবোর্ডটা। তিন দশকের রোদে-জলে সেটা একটুকরো বাঁধানো টিন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দোকানের টালির মাথায়। দীনবন্ধু শব্দটা বোঝা যায়, আর তার নীচের লাইনে ন’রোগ বিশেষজ্ঞ, কথাটা পড়া যায়। অবশ্য এতে দীনবন্ধু ডাক্তারের কিছু যায় আসে না। অন্তত একশো জন বাঁধা পেশেন্ট তার থেকেই।
সাড়ে ছ’টার পর থেকেই ক্রমে লোক চলাচল বাড়তে থাকে গলিটায়। হর্ন বাজিয়ে দু’চারখানা রিকশাও ঢুকে পড়ে। গলির এ মুখে ও মুখে দালালরা ফিসফিস শব্দে তিলোত্তমা উর্বশী আর সব্জির খেত থেকে সদ্য তুলে আনা শিশির জড়ানো ফুলকপিদের গল্প শোনাতে থাকে পথচারীর কানে কানে। কোনও কোনও চপলা আগ্রাসী বাণিজ্যে বিশ্বাসী, তারা পথচারীর পকেট ধরে টানাটানি করে। মাঝে মাঝে এ ঘর সে ঘর থেকে মত্ত হাসির ফোয়ারা ছলকে পড়ে রাস্তায়। দৃশ্যে শব্দে গন্ধে মানানসই এক উৎসবের চেহারায় জেগে ওঠে কানা খুদুর গলি। সব কিছু খাপে খাপে বসে যায়, বেমানান লাগে না। হঠাৎ যদি হুমদো কালী তার দোকানে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজিয়ে দেয় বা কর্পোরেশন থেকে ড্রেনটা বাঁধিয়ে দেয় অথবা ফাঁকা জমিটুকুর ঝোপজঙ্গল কেটে ফেলে একটা ফুলের দোকান বসে যায় তবে পুরো গলিটাই বড্ড বেখাপ্পা হয়ে যাবে।
মনে মনে গলিটার ছবি দেখতে দেখতে রতন ক্রমশই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে থাকে। পারবে তো? ডিহরচক গাঁয়ের ওই সাদাসিধে মানুষটা খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে, হাসিমুখে, কাউকে নিরাশ না করে, চার অক্ষরের মন্ত্রটা জপ করতে করতে দু’বার গলিটা পেরিয়ে আসতে পারবে তো? হে ভগবান যেন পারে। তা হলে আজই ওর সঙ্গে ডিহরচক গাঁয়ে চলে যাবে। সারা রাত সাধুবাবার দু’পা জড়িয়ে পড়ে থাকবে। বকুক, মারুক কিছুতেই সিদ্ধাই না নিয়ে ছাড়বে না। দরকার হলে সাধুবাবার সামনে আত্মহত্যা করবে।
প্রার্থনা জানাতে জানাতেই রতনের অন্য মনটা বলে উঠল, তোকেও তো সাধুবাবা কানা খুদুর গলি পার হতে বলবে। তুই পারবি তো? প্রার্থনারত মনটা চমকে উঠল। নিজেকেই জিজ্ঞেস করল, পারব তো? মনটা চুপ করে থাকল। সারাটা চেতনা জুড়ে এই অমোঘ প্রশ্ন নিয়ে হেড পোস্ট অফিসের সিঁড়িতে রাত দশটা পর্যন্ত বসে রইল রতন।
|