কলকাতা ও আসানসোলের বস্তিবাসীদের পুনর্বাসন প্রকল্পের কাজ শেষ করার জন্য হাতে সময় আর মাত্র দু’মাস। কাজ শেষ না-হলে আগামী ৩১ মার্চের পর কেন্দ্রের ৭৫ শতাংশ টাকাই ফিরে যাবে! সেই অর্থ ফেরত-যাওয়া আটকাতে শেষ মুহূর্তে কোমর বেঁধে নেমেছেন রাজ্যের পুর-নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। কেন্দ্রের কাছে অতিরিক্ত সময় চেয়ে দরবার করেছেন তিনি। ‘জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আরবান রিনিউয়াল মিশন’ প্রকল্পের অধীনে কলকাতা ও আসানসোলে বস্তিবাসীদের দু’টি করে ঘর, রান্নাঘর, শৌচালয় এবং সংলগ্ন এলাকার রাস্তাঘাট, জল সরবরাহ-সহ অন্যান্য পরিকাঠামো তৈরির জন্য ২০০৫ সালে অনুমোদন দিয়েছিল কেন্দ্র। দুই শহরের জন্য দেড় হাজার কোটি টাকার অনুমোদন মিলেছিল। কলকাতা পুরসভা এবং কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভলপমেন্ট অথরিটি (কেএমডিএ)-কে ভাগাভাগি করে কলকাতার বস্তি এলাকায় বাড়ি তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। আসানসোলের দায়িত্ব ছিল স্থানীয় পুরসভার উপর। ২০০৬ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে এই প্রকল্পের টাকাও আসতে থাকে। কিন্তু সময়ের কাজ সময়ে না-করার জন্য মেয়াদ শেষের দু’মাস আগে এখনও দুই শহরের বেশির ভাগ কাজই ‘অসম্পূর্ণ’।
কেন কাজ হল না? তৃণমূল পরিচালিত কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, “কলকাতায় বস্তিবাসীরা একে তো জায়গা ছাড়তে চাননি। দখল করে থাকা জায়গার বদলে ফাঁকা জায়গাও পাওয়া যায়নি। কোনও জায়গায় তাঁরা যখন রাজি হয়েছেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। কলকাতার বাড়ি পিছু বরাদ্দ ১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা। এখন সেই খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে তিন থেকে চার লক্ষের মতো। বাড়তি টাকা কেন্দ্র দেবে না। পুরসভার পক্ষেও এত অতিরিক্ত টাকা দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় কাজ করা যায়নি।” ঘটনাচক্রে, সদ্য সদ্যই বস্তি উন্নয়ন দফতরটি মেয়র শোভনবাবুর হাত থেকে নিয়ে মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষের হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তৃণমূলের আসানসোল পুরসভার মেয়র তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “যে চারটি জায়গায় এই কাজ শুরু হয়েছিল, তার তিনটিতে অনেকটাই কাজ হয়েছে। তবে ফেজ-১ প্রকল্পের ওয়ার্ক-অর্ডারকেই রেলপাড় প্রকল্পের টেন্ডার হিসেবে দেখানো হয়েছিল বিগত বাম পুরবোর্ডের আমলে। ওই প্রকল্পের আলাদা টেন্ডার নোটিস দেখাতে না পারায় কেন্দ্র আর ওই প্রকল্পের অনুমোদন দেয়নি।”
নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরেও এই প্রকল্পের কাজ যে কার্যত কিছুই হয়নি, তা জানিয়ে পুরমন্ত্রী হাকিম বলেন, “কোথাও বস্তিবাসীদের বাধা, কোথাও জমির সমস্যা, কোথাও বস্তি-পরিবারের সংখ্যা সুনির্দিষ্ট না-থাকায় কাজ করা যায়নি। গত সাত মাসে মেটিয়াবুরুজ ও নোনাডাঙা ছাড়া কলকাতা পুরসভার কোথাও কাজ হয়নি। বাকি দু’মাসের মধ্যে কাজ শেষ করা সম্ভবও নয়। আসানসোলে অবশ্য অনেকটা কাজ হয়েছে।” যদিও সরকারি তথ্য বলছে, গত ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আসানসোলে ২৫ হাজারের জায়গায় মাত্র সাড়ে সাত হাজার ঘর তৈরি হয়েছে।
অসমাপ্ত কাজ সর্ম্পূণ করতে শেষ মুহূর্তে কেন্দ্রের দ্বারস্থ পুরমন্ত্রী বলেছেন, “৩১ মার্চের পরে টাকাটা যাতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ফিরে না যায়, সে জন্য আরও দু’বছর অতিরিক্ত সময় দিতে কেন্দ্রীয় আবাসন এবং শহুরে দারিদ্র্য দূরীকরণ মন্ত্রী কুমারী শৈলজাকে অনুরোধ করেছি। নীতিগত সম্মতি দিয়েছে কেন্দ্র।” ওই মন্ত্রক সূত্রে জানা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ-সহ অনেক রাজ্য অতিরিক্ত সময় চেয়ে অনুরোধ করলেও বাড়তি সময় দেওয়ার ব্যাপারে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে আরও সময় দেওয়া হবে কি না, তা যোজনা কমিশনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ৩১ মার্চের আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ঘর তৈরির সময় বস্তিবাসীদের সাময়িক অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করে সেই জমিতে কাজ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ‘জবরদখল’ জায়গা ছাড়তে বস্তিবাসীরা রাজি না-হওয়ায় কাজের গতি শ্লথ হয়েছে বলে পুরকর্তাদের অভিযোগ। এক কর্তার কথায়, “কিছু দিন অন্তর নতুন নতুন পরিবার আসছে বস্তিতে। ফলে প্রয়োজনীয় বাড়ির সংখ্যাও ক্রমাগত বাড়ছে।” রাজারঘাট, হাতগাছিয়া, কাছারিপাড়া, পাগলাডাঙা, গার্ডেনরিচ, আনন্দনগর মিলিয়ে প্রায় ১৩ হাজার বাড়ি তৈরির কথা থাকলেও সেখানে মাত্র দু’হাজারের মতো বাড়ি তৈরি হয়েছে বলে পুরসভা সূত্রের খবর।
চেতলা, ঝোড়ো বস্তি, কলকাতা এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্রুভমেন্ট প্রোজেক্ট (কেইআইপি), কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীদের পুনর্বাসন ছাড়াও নোনাডাঙা, গল্ফগ্রিন, উল্টোডাঙার বস্তিতে ঘর তৈরির দায়িত্ব ছিল কেএমডিএ-র। সরকারি তথ্য বলছে, উল্টোডাঙা, ঝোড়ো বস্তি, গল্ফগ্রিন এবং কুমোরটুলিতে একটিও বাড়ি তৈরি হয়নি। নোনাডাঙা এবং কেইআইপি এলাকায় কিছুটা কাজ হয়েছে বলে জানিয়েছেন কেএমডিএ-র সিইও বিবেক ভরদ্বাজ। তাঁর কথায়, “সাড়ে ছ’হাজারের মতো বাড়ি তৈরির কথা ছিল ওই জায়গাগুলোতে। কিন্তু বারবার আলোচনা সত্ত্বেও জায়গা ছাড়ছেন না বস্তিবাসীরা। কুমোরটুলির জমি নিয়ে একটা সমস্যা (ওই জমির সত্ত্ব রাজ্য সরকার এখনও কেএমডিএ-কে দেয়নি) থাকায় সেখানে কাজ বন্ধ রয়েছে।” |