রাজ্যে পরিবহণ ক্ষেত্রে আর ভর্তুকি দেওয়া হবে না বলে নতুন বছরের শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মাস ঘুরল না।
শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রীরই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, সরকারি পরিবহণ নিগমে ভর্তুকি প্রথা চালু থাকছে। বামফ্রন্টের আমলে ‘অবৈধ ভাবে’ চাকরি পেয়েছেন বলে যে-সব কর্মীর বেতন নতুন সরকার আটকে রেখেছিল, তাঁরাও বেতন পাবেন। মিলবে আটকে থাকা পেনশন। তবে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্য সরকার চিরদিন পরিবহণ ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেবে না। আপাতত আগামী ছ’মাস এই ভর্তুকি ব্যবস্থা চালু থাকবে।
এ দিন মহাকরণে রাজ্যের পাঁচটি পরিবহণ নিগমের চেয়ারম্যান, ম্যানেজিং ডিরেক্টর, বাম ও অ-বাম সব শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি এবং পরিবহণমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। ভর্তুকির আশা ছেড়ে কী ভাবে নিগমগুলি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে এবং সাধারণ মানুষকে কী ভাবে আরও ভাল পরিষেবা দেওয়া যায়, সেটাই ছিল মূল আলোচ্য। পরে পরিবহণমন্ত্রী জানান, মুখ্যমন্ত্রী বিলগ্নিকরণের বিরুদ্ধে। তবে ‘প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপ’ বা পিপিপি স্বাগত। কী ভাবে পিপিপি প্রক্রিয়া চালানো হবে? মন্ত্রীর বক্তব্য, “কোনও বাণিজ্যিক সংস্থা যদি এগিয়ে এসে কোনও নিগমের দায়ভার নিতে রাজি হয়, আমাদের আপত্তি নেই। তবে এখনও কিছুই চূড়ান্ত হয়নি। আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হবে।” |
সাংবাদিক বৈঠকে রাজদেও গোয়ালা এবং মদন মিত্র। শুক্রবার মহাকরণে। নিজস্ব চিত্র |
পরিবহণে আর ভর্তুকি দেওয়া হবে না বলে গত ৩ জানুয়ারি মহাকরণেই জানিয়েছিলেন মমতা। সেই সূত্র ধরে গত মঙ্গলবার পরিবহণমন্ত্রীও মহাকরণে একই কথা জানিয়েছিলেন। সরকারি পরিবহণ নিগমগুলিতে যে-সব কর্মীর নিয়োগ ‘অবৈধ’, তাঁদের বেতন আটকে রাখার কথাও জানিয়েছিলেন মদনবাবু। কিন্তু সে-দিন সন্ধ্যায় হুগলিতে বিক্রম সিংহ নামে সিটিসি-র এক কর্মীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর জেরে বুধবারেই আগের মত থেকে কিছুটা সরে আসেন পরিবহণমন্ত্রী। সে-দিনই ঠিক হয়েছিল, সরকারি পরিবহণ নিগমগুলির কর্মীদের বেতন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে শুক্রবার মহাকরণে বৈঠকে বসে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন মুখ্যমন্ত্রী।
এ দিন বৈঠক চলে এক ঘণ্টারও বেশি। পরে পরিবহণমন্ত্রী জানান, আপাতত (ছ’মাসের জন্য) পরিবহণ নিগমগুলিতে সব কর্মীই নিয়মিত বেতন পাবেন। যাঁদের বেতন আটকে ছিল, তাঁরা বকেয়া টাকাও পেয়ে যাবেন। কোনও কর্মীকেই ছাঁটাই করবে না সরকার। কলকাতা ট্রাম কোম্পানির প্রাক্তন চেয়ারম্যান তথা সিটু নেতা রাজদেও গোয়ালাকে পাশে নিয়ে মন্ত্রী বলেন, “স্বাস্থ্যের কারণে যে-কাজ করা উচিত নয়, বিভিন্ন নিগমের অনেক কর্মীই তা করছেন। তাঁদের স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য মেডিক্যাল বোর্ড বসানো হবে। বোর্ডের সদস্যেরাই ঠিক করে দেবেন, মানসিক ক্ষমতা অনুযায়ী কোন কর্মী কোথায় কাজ করবেন।” পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর, নিগমগুলিতে এমন ‘অদক্ষ’ কর্মীর সংখ্যা ৬৪৬।
বৃহস্পতিবারেই বাস চালানোর সময় অসুস্থ হয়ে এনবিএসটিসি-র এক চালকের মৃত্যু হয়। পুলিশ এবং সেই বাসের যাত্রীদের একাংশ জানিয়েছেন, ভবেন্দ্রনাথ সরকার (৫৬) নামে ওই বাসচালক দিনহাটার বাসিন্দা। সে-দিন দিনহাটা থেকেই তিনি রায়গঞ্জ রওনা হন। গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছে অসুস্থ হয়ে লুটিয়ে পড়েন। তাঁকে রায়গঞ্জ জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেখানকার চিকিৎসকেরা তাঁকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ‘রেফার’ করেন। কিন্তু পথেই মৃত্যু হয় তাঁর। ভবেন্দ্রবাবুর দাদা সুভাষ সরকারের অভিযোগ, “ডিসেম্বরের বেতন এখনও হয়নি। আগের দু’মাসের বেতনও পুরো হাতে পায়নি ভাই। ধারদেনা করেই সংসার চলছিল। আমার ধারণা, বেতন না-পাওয়ার দুশ্চিন্তা থেকেই অসুস্থ হয়ে ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে।” এনবিএসটিসির ম্যানেজার ডিরেক্টর সি মুরুগন অবশ্য বলেছেন, “ওই চালক অসুস্থ ছিলেন। হৃদ্রোগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।”
‘অবৈধ’ নিয়োগের প্রশ্ন তুলে বিভিন্ন পরিবহণ নিগমের ৮৯৪ জনের আর্থিক পাওনাগণ্ডা চার মাস আটকে রেখেছিল রাজ্য সরকার। আদালতের নির্দেশে তিনটি পরিবহণ নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টরেরাও বেতন পাচ্ছেন না। এই পরিস্থিতিতে নিগমের কাজকর্ম গতি হারাচ্ছিল বলে অভিযোগ। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারের বেশ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিবহণমন্ত্রী। তিনি বলেন, “নিগমগুলির হাল ফেরাতে একটি ‘পাইলট প্রজেক্ট’ হাতে নেওয়া হচ্ছে। কী ভাবে তা বাস্তবায়িত হবে, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট নিগমের চেয়ারম্যান, ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং কর্মী সংগঠনের নেতারা একসঙ্গে বসে আলোচনা করে ঠিক করবেন।” |
|
|
নিগম মোট বাস |
রাস্তায় চলে |
স্থায়ী কর্মী |
অস্থায়ী কর্মী |
সিটিসি |
২৮০ |
১০৫ |
৬০৮৫ |
৩৫৮ |
সিএসটিসি |
১১৮০ |
৪৫০ |
৫৯৭৫ |
৮৫ |
এনবিএসটিসি |
৭০৫ |
৪৯৮ |
৩৭০৫ |
৩২৯ |
এসবিএসটিসি |
৪৮৪ |
৩৭৫ |
২৩৫৪ |
১৬৭ |
ডব্লিউবিএসটিসি |
৩৫২ |
৩০৩ |
৬২৩ |
১২২ |
|
বাসের ভাড়া বাড়ানোর কোনও প্রসঙ্গ অবশ্য এ দিনের বৈঠকে ওঠেনি। ভাড়া বাড়ানোয় সায়ও নেই রাজ্য সরকারের। তবে এর মধ্যেই ‘অন্য’ পথে হেঁটে কী ভাবে নিগমগুলির আয় বাড়ানো যায়, প্রাথমিক ভাবে তা নির্দিষ্ট করেছে পরিবহণ দফতর। এর প্রধান উপায় ‘অ্যাসেট ব্যঙ্ক’ তৈরি করা। কী ভাবে? মদনবাবু বলেন, “ডিপোর ফাঁকা জায়গা বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে, প্রয়োজনে টিকিটেও স্পনসরশিপ চালু হবে। দু’টি বা তিনটি নিগমকে একসঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া যায় কি না, আলোচনা হবে সেই বিষয়েও। এ ছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানের খরচও কমাতে বলা হয়েছে নিগম-কর্তৃপক্ষকে।” যে-সব বাস বসে গিয়েছে, সেগুলির সমস্যা জানতে যান-বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করবে পরিবহণ দফতর।
বৈঠক থেকে বেরিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা করেন সিটু নেতা রাজদেও গোয়ালা। তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী যে-ভাবে নিগমগুলির কর্তা ও শ্রমিক-নেতাদের একসঙ্গে কাজ করতে বললেন, তাতে শ্রমিকদের মনোবল বাড়বে।” সিটিসি-র মৃত কর্মী বিক্রম সিংহের স্ত্রীকে তাঁর যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি দেওয়ার দাবি জানান সিটু নেতৃত্ব। ইতিমধ্যে পরিবহণমন্ত্রী নিজে গিয়ে মৃতের পরিবারের হাতে ৫০ হাজার টাকা তুলে দিয়েছেন।
পরিবহণমন্ত্রী এ দিন মিনিবাস ও বাস-মালিক সংগঠনের সঙ্গেও বৈঠক করেন। পরে বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেটের সহ-সভাপতি দীপক সরকার এবং মিনিবাস ওনার্স কো-অর্ডিনেশন কমিটির সভাপতি অবশেষ দাঁ বলেন, “আগের পরিবহণমন্ত্রীও দু’বার বৈঠক করেছিলেন। কিন্তু আমাদের দাবিদাওয়ার সুরাহা হয়নি। এ দিনও আমরা বাস-ভাড়া বাড়ানোর দাবি জানিয়েছি। খুচরোর সমস্যার দিকেও নজর দিতে অনুরোধ করেছি সরকারকে।” |