প্রতি পক্ষ
জীবনটাও তো এক জার্নি
ড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে। এই আপ্তবাক্যটি আজকাল সিনেমার ক্ষেত্রে খুব সত্য। শুধু বড় বাজেটের ঢাউস ছবিই যে নজর কাড়বে তা নয়, ছোট বাজেটেও ঝকঝকে, বুদ্ধিদীপ্ত এবং মূলত নগর-মননের ছবি করা যায়। আজ থেকে বছর চোদ্দ-পনেরো আগে, এক হায়দরাবাদি প্রথম এই কথাটা প্রমাণ করেছিলেন। ছবির নাম ‘হায়দরাবাদ ব্লুজ’।
সেই ছবির পরিচালক যিনি, তিনি স্বভাবসিদ্ধ প্রত্যয় এবং আলতো একটু উদাসীনতা নিয়ে বললেন, ‘‘না, আর শহর নয়, আমি এ বার গ্রামের দিকে তাকিয়েছি। এই দেশের অন্য রকম একটা মুখ দেখতে পেয়েছি। তাকেই আরও বেশি করে খুঁজতে চাই।’’
নাগেশ কুকুনুর যা ভাবেন, তা বলেন। এবং, যা বলেন, তা-ই করেন। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস লিখতে গেলে নাগেশকে নিয়ে একটা অধ্যায় শুরু করতেই হবে। সেই অধ্যায়ে আরও লেখা থাকবে যে, নাগেশ কুকুনুরকে দিয়েই টালিগঞ্জের সিনেমাপাড়ায় অন্য একটা অধ্যায় শুরু হল।
কারণ, নাগেশ কুকুনুর-ই বলিউডের সেই পরিচালক যিনি টলিউডি এক সংস্থার হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ হিন্দি ছবি করবেন বলে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। সেই ছবি সর্বভারতীয় তো বটেই, হালফিল হিন্দি ছবির রীতি মেনে আন্তর্জাতিক স্তরেও মুক্তি পাবে। টলিপাড়ায় হিন্দি ছবি আগেও হয়েছে, অজয় দেবগন এবং ঐশ্বর্যা রাইয়ের ‘রেনকোট’-এর কথা মনে পড়বেই। কিন্তু, সে ছবির পরিচালক, ঋতুপর্ণ ঘোষ, বলি-পাড়ার নন। সে দিক থেকে দেখলে বলিউডি পরিচালকের টলিউডি প্রযোজকের তরফে একটি পুরোদস্তুর বলিউডি ছবি করার ঘটনা নজিরবিহীন। সাক্ষাৎকারের গোড়াতেই নাগেশ জানালেন, সেই নির্মীয়মাণ ছবি নিয়ে কিছু বলবেন না।
কিন্তু, কেন তাঁকে ক্যামেরার সামনে আর দেখা যাচ্ছে না, সেটুকু তো বলবেন! যখন আমেরিকায় ছিলেন, তখন আস্ত একটা অভিনয়ের কোর্স করেছিলেন, সঙ্গে ছবি পরিচালনার জন্য মাত্র সাতটি দিনের একটি কর্মশালা! অথচ, নাগেশ কুকুনুর পরিচালকই হয়ে গেলেন, বেশ কয়েকটি ছবিতে দুর্দান্ত অভিনয় করেও ক্যামেরার পিছন থেকে ‘অ্যাকশন’ আর ‘কাট’ বলাতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করলেন।
“আসলে, আমি গল্পটা বলতে খুব ভালবাসি। সেটা দু’ভাবে বলা যায়। অভিনেতা হয়ে, আর পরিচালক হয়ে। অভিনেতার কাজটা তুলনায় সংক্ষিপ্ত। ক্যামেরার সামনে এসে নিজের যেটুকু করণীয়, করে চলে যাও। আর কোনও দায়দায়িত্ব নেই। কিন্তু, পরিচালককে একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গোটা জিনিসটার সঙ্গে জুড়ে থাকতে হয়। প্রি-প্রোডাকশন-এর ভাবনা থেকে শুরু করে সেই পোস্ট-প্রোডাকশন পর্যন্ত। ছবির সঙ্গে এই জড়িয়ে থাকাটাই আমার ভাল লাগে, তাই...”
এতটাই ভাল লাগে যে, লোকেশন দেখতে নাগেশ কোথায় না কোথায় চলে যান। এক বার একটা সাক্ষাৎকারে নাগেশ বলেছিলেন, ছবির মধ্যে যেটা তাঁকে সবচেয়ে বেশি টানে, তা হল ‘জার্নি’, একটা অভিযাত্রা। ধরা যাক, প্রেমের ছবিতে প্রেম হল, তার পরে বিচ্ছেদ বা মিলন যাই হোক, যে ভাবে সেই ভালবাসাটা এগোল, সেই যাত্রাপথটা তাঁর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্ন ওঠে, অভিযাত্রা এত ভালবাসেন যিনি, তাঁর নিজের জীবনটাও কি আশ্চর্য একটা অভিযাত্রা নয়?
“এ ভাবে ভাবিনি, কিন্তু এটা ঠিকই যে, হয়তো সেই কারণেও আমার কাছে ‘জার্নি’ জিনিসটা খুব জরুরি। আমেরিকায় যখন ছিলাম, তখন একটা স্বপ্ন দেখতাম। সেই স্বপ্নটা সত্যি হল এক সময়, কিন্তু সেই পথটা খুব মসৃণ ছিল না। ব্যাপারটা করে তোলার জন্য জীবনে বেশ খানিকটা দাম দিতে হয়েছিল। অনেকেই হাহুতাশ করেছিল, বিদেশে পাকা চাকরি ছেড়ে কেউ দেশে সিনেমা করার জন্য ফেরে?”
নাগেশ, একটা জিনিস খেয়াল করেছেন। এক দিকে আমরা দেখছি, ‘ইকবাল’ ছবিটা থেকে আস্তে আস্তে গ্রামাঞ্চলের কথাই উঠে আসতে থাকল আপনার ছবিতে। আবার, একই সঙ্গে, যে সব দর্শকের কাছে আপনার ছবির টান থেকেই গেল, তাঁরা কিন্তু মূলত ‘মাল্টিপ্লেক্স ক্রাউড’, একেবারেই শহরের লোক।
“এটা কিন্তু মজার। ঠিক মনে হয়, একটা ধাঁধা, প্যারাডক্সের মতো। তবে, সত্যিই কি প্যারাডক্স? আমার একটা কথা মনে হয়, জানেন, যদি ছবিটা আপনি ঠিক করে করতে পারেন, তা হলে কিন্তু গ্রাম আর শহর ভাগাভাগিটা থাকে না। আমি নিজে এক সময় আর্বান সিনেমা করেছি, শহরের আলো-আঁধার নিয়ে ছবি, ভেরি ডার্ক, গ্রিটি টেলস, কিন্তু আমিই আবার যখন সরে গিয়ে ইকবাল করলাম, মানুষ তো দেখল ছবিটা। গ্রামও দেখল, শহরও দেখল। মাল্টিপ্লেক্স শহরের জিনিস ছাড়া দেখবে না, এ রকম ভাবার কোনও কারণ নেই।”
শেষ প্রশ্ন ছিল এই যে, নাগেশ কুকুনুর একদা বলেছিলেন, সমান্তরাল, ছোট বাজেটের ছবিকে উৎসাহ দিতে গেলে তার টিকিটের দামটাও একটু কমিয়ে দেওয়া হোক। এখনও কি তাই ভাবেন?
“একশো বার ভাবি। একটু ভেবে দেখুন। ছোট বাজেটে একটা ছবি করলেন। তেমন বিরাট কোনও স্টার কাস্ট নেই। অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েরা কাছেই ঘেঁষবে না। এ দিকে অন্য একটা জিনিসও আছে। অল্পবয়সিরা কলেজ-টলেজ থেকে বেরিয়ে সিনেমায় গেল, তাদের কাছে সিনেমাটা ততটা জরুরি নয়, একসঙ্গে খানিকক্ষণ থাকা যাচ্ছে, সেটাই আসল। তার জন্যে মুভি থিয়েটার ইজ দি আইডিয়াল প্লেস। গিয়ে দেখল, একটা ছবি হচ্ছে, বড় স্টার-টার কেউ নেই বটে, কিন্তু, টিকিটের দামটা কম। ভাবল, ঠিক আছে, পঞ্চাশটা টাকা দিয়ে গিয়েই দেখি না, খারাপ হলেও বেশি তো গচ্চা যাবে না। তার পরে, দেখতে দেখতে হয়তো ভাল লেগে গেল ছবিটা। হতে তো পারে!”
হতে তো পারে! এটাই নাগেশ কুকুনুরের জীবনের ধ্রুবপদ। এ ভাবেই এক দিন ভবিষ্যতের ছকটা বদলে দিয়েছিলেন তিনি। ভারতীয় ছবির ধারাও বদলে গিয়েছিল। সেই ভাবনাটা তিনি ছাড়েননি।
হায়দরাবাদ আছে হায়দরাবাদেই!




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.